বিশ্ব মাতানো আরব দুনিয়ার সুগন্ধি ‘লোবান’
একই সুগন্ধি যে দুজন মানুষের নাকে হুবহু একই ঘ্রাণ নিয়ে ধরা দেয় না, তা বিস্ময়কর শোনালেও সত্য বলে মানতে হবে আমাদের। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একমাত্র জমজ দুজন মানুষই শুধু একই বস্তুর ঘ্রাণ একই রকম পেতে পারেন। নয়তো সামান্য হলেও তফাৎ থাকবেই। বিজ্ঞানীরা এ কথা নিশ্চিত করছেন যে, শতকরা পাঁচ শতাংশ মানুষের ঘ্রাণেন্দ্রিয় না থাকলেও প্রায় সব গাছপালারই ঘ্রাণশক্তি রয়েছে। এ শক্তি কাজে লাগিয়ে পোকায় আক্রান্ত গাছ তার আত্মীয় আরেকটি গাছকে সতর্ক করে দিতে পারে। হুঁশিয়ার করতে পারে খাদ্যঘাটতি বা খরার ব্যাপারেও। গাছেদের এই যোগাযোগ যতটা হয় জড়মূল বা শিকড়ের সাহায্যে, তারচেয়ে বেশি হয় ঘ্রাণ সৃষ্টি করে সংকেত পাঠানোর মাধ্যমে। অবাক করার মতো তথ্য হলেও বিজ্ঞানীরা এ কথাই বলছেন।
বিজ্ঞানীদের কথা সত্য বলে ধরে নিলে মানতেই হবে, সুগন্ধির অস্তিত্ব পৃথিবীর জন্ম থেকেই বিদ্যমান। তবে হ্যাঁ, কোন অঞ্চলের মানুষ সর্বপ্রথম সুগন্ধি ব্যবহার করা শিখেছে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বোধহয় আরবদেরকে সুগন্ধির আবিষ্কারক বলা গবেষকদের সংখ্যাই বেশি। প্রাচীন মিশর ও মেসোপটোমিয়ায় সুগন্ধির ব্যবহার শুরু হয় বলে অনেকে বলছেন।
আরবে সুগন্ধি:
ইয়াকুবের সন্তান ইউসুফকে যে বণিকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তার সৎ ভাইয়েরা, তারা নাকি গন্ধবণিক ছিলেন। অর্থাৎ ইউসুফকে মিশরের আজিজের কাছে বিক্রি করেছিলেন যেসব সওদাগর, তারা মূলত ছিলেন সুগন্ধির ব্যবসায়ী। এ কথা সত্য বলে ধরে নিয়ে গবেষকরা বলছেন, আরবে সুগন্ধির ব্যবহার অন্তত ছয় হাজার বছর বা তারচেয়েও বেশি পুরোনো।
সুগন্ধিকে সবসময়ই পবিত্র ও অভিজাত বস্তু হিসেবে ধরা হতো। ফলে ধর্মালয়ে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনায় এর ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। এছাড়া রাজ-রাজড়া, ক্ষমতাবান গোত্রপতি কিংবা বীরযোদ্ধারা রুচি ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতেন উৎকৃষ্ট সুগন্ধি।
আরব অঞ্চলের প্রাচীন রাজা-বাদশারা কেমন সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, তার ধারণা পাওয়া যায় মিশরীয় ফারাওদের দিকে তাকালে। ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার ১৯২২ সালের ৪ নভেম্বর মিশরীয় অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩৩-১৩২৪) তুতেনখামেনের মমি আবিষ্কার করেন। পিরামিডের ভেতর তুতেনখামেনের সমাধিস্থল আবিষ্কার করলে দেখা যায়, মমিটি থেকে তীব্র ও ঝাঁঝাল সুগন্ধ বের হচ্ছে। তুতেনখামেনের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪১ অব্দে। মৃত্যু খ্রিস্টপূর্ব ১৩২৩ অব্দে। সে হিসেবে মমিটি তিন হাজার বছরের পুরনো। তবুও অটুট সুবাস!
রানি ক্লিওপেট্রার সুগন্ধি ব্যবহারের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। শুরুতে সুগন্ধি ব্যবহার করা হতো ধূপের মাধ্যমে। অর্থাৎ বিশেষ পদ্ধতিতে সুগন্ধি ধোঁয়া গায়ে মাখা হতো। সুগন্ধি শব্দটির ল্যাটিন প্রতিশব্দ Perfumare; এর আক্ষরিক অর্থও 'ধোঁয়া'। রানিও সেভাবেই মাখতেন। তখনও আজকের মতো তরল সুগন্ধির প্রচলন শুরু হয়নি। ধূপ থেকে মোম, মোম থেকে আরও নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পাওয়া আজকের আধুনিক তরলাকারে সুগন্ধি ব্যবহারের পদ্ধতি চার হাজার বছরের ক্রমাগত গবেষণার সুফল।
রানি ক্লিওপেট্রা কারিগরদের দিয়ে উৎকৃষ্টমানের বিশেষ একটি সুগন্ধি বানাতে সক্ষম হন। তার সেই সুগন্ধি বিখ্যাত হয় 'কিফি' নামে।
আল-কিন্দি ও ইবনে সিনা, আধুনিক সুগন্ধির দুই আদি পিতা:
আরবের সুগন্ধি ব্যবহারের ইতিহাস বহু পুরনো হলেও সপ্তম শতকে রসায়নবিদদের হাত ধরে এটি এক অন্যমাত্রা লাভ করে। আব্বাসী শাসনামলের বিখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্র—গবেষণা ও অনুবাদ প্রতিষ্ঠান 'বায়ত আল-হিকমাহ' বা 'হাউস অব উইজডম' হয়ে উঠে উন্নত সুগন্ধি তৈরির ল্যাবরেটরি হিসেবে। 'ফাদার অব আরব ফিলোসফি'খ্যাত রসায়নবিদ আল-কিন্দি এখানে বসেই লিখেন সুগন্ধি তৈরির সবচেয়ে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বইটি।
দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, চিকিৎসক, সঙ্গীতজ্ঞ ও রসায়নবিদ আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আস-সাব্বাহ আল-কিন্দির (৮০১-৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ) লিখিত 'দ্য বুক অব দ্য কেমেস্ট্রি অব পারফিউম অ্যান্ড ডিসটিলেশনস'-এর দুটো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, তার শিরোনাম থাকে 'আল-তারাফফুক ফি আল-আতর', এবং মিশরে যে নুসখা পাওয়া যায়, তার নাম 'কায়ফিয়্যাত আল-আতর ওয়া আল-তাসয়িদাত'। আধুনিক সুগন্ধিবিদ্যায় রসায়নবিদদের কাছে এখনো সমান গুরুত্বপূর্ণ এই বই।
এ বইয়ে লেখক সুগন্ধি তৈরির একশ সাত রকম পদ্ধতি ও রেসিপির উল্লেখ করেছেন। আল-কিন্দি এই রেসিপির মাধ্যমে সুগন্ধি তৈরির বিস্তারিত রাসায়নিক পদ্ধতি বাতলে গেছেন। ইউরোপীয় সুগন্ধি বিশেষজ্ঞদের কাছে আল-কিন্দি তাই 'ফাদার অব পারফিউম' নামে সুপরিচিত।
আল-কিন্দির আগে আরেক মুসলিম বিজ্ঞানী ও আলজেব্রার স্রষ্টা জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২১-৮১৩ খ্রিস্টাব্দ) নতুন পদ্ধতি নিয়ে হাজির হন। তার সেই পদ্ধতি সুগন্ধি তৈরিকে আরও সহজ করে দেয়। জাবির সুগন্ধি উপাদানকে বাষ্পীয়করণ, পরিস্রাবণ ও পাতনের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
আল-কিন্দির পর আরেক পার্সিয়ান মুসলিম চিকিৎসক ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) ফুল থেকে পাতন পদ্ধতিতে তেল আহরণের আধুনিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এখন পর্যন্ত এ পদ্ধতি ব্যবহার করেই সুগন্ধি তৈরি করা হচ্ছে। ইবনে সিনাকে ধরা হয় আধুনিক সুগন্ধি তৈরির আরেক আদিপিতা।
আরবের ঘ্রাণে মোহিত ইউরোপ:
একটি সূত্র বলছে, মরোক্কান পরিব্রাজক ইবনে বতুতার ইউরোপ ভ্রমণের আগে ইউরোপীয়রা সুগন্ধি যে ব্যবহার করার মতো বস্তু, তা-ই জানত না। সূত্রটি কতটা নির্ভযোগ্য, তা নিশ্চিত বলা না গেলেও এ কথা নিশ্চিত, ইউরোপ সুগন্ধির আধুনিক ব্যবহার শিখেছে মূলত আরবের মুসলমানদের কাছ থেকে।
ঐশ্বরিক শহর জেরুসালেমকে মুসলমানদের কাছ থেকে মুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে পোপের নেতৃত্বে যে ধর্মযুদ্ধ শুরু করে ইউরোপ, তার মাধ্যমে মুসলমানদের কাছাকাছি আসার সুযোগ তৈরি হয় তাদের। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে ধর্মযোদ্ধারা আরবের সুগন্ধি নিয়ে বাড়ি যেতেন। সুগন্ধির সঙ্গে মূলত ব্যাপক আকারে এভাবেই তাদের পরিচয় হয়।
ইউরোপে আরবের সুগন্ধি প্রবেশের আরেকটি বড় দরজা হিসেবে কাজ করে আন্দালুসিয়া। গ্রানাডায় মুসলমানদের শাসনের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা আরব্য শিল্প-সংস্কৃতি, মুসলমানদের রুচি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হয়। আরবের ঘ্রাণ তাদের মোহিত করে।
আন্দালুসিয়ার বিখ্যাত আরব চিকিৎসক, সার্জন ও রসায়নবিদ আল-জাহরাবি (আবুল কাসিম খালাফ ইবনে আল-আব্বাস আল-জাহরাবি আল-আনসারি, ৯৩৬-১০১৩ খ্রিস্টাব্দ) লিখিত 'দ্য মেডিসিন অব বিউটি' বইটি ইউরোপ হাতের নাগালে পেয়ে পুরোপুরি কাজে লাগায়। কর্ডোভার এই বিজ্ঞানীকে বলা হয় 'ফাদার অব সার্জারি'। তার লিখিত 'আদয়ুয়িয়াত আল-জিনাহ' বা 'মেডিসিনি অব বিউটি'তে তিনি প্রসাধনকে ওষুধের একটি শাখা হিসেবে দেখিয়েছেন। এই বইয়েই সুগন্ধি সম্পর্কে তার বিস্তারিত চিন্তা বিবৃত হয়েছে। সুগন্ধিকে গোলাকার লাঠির আকৃতি দেওয়ার চিন্তা তার। আজ যে লিপিস্টিক বা ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তার উদ্ভাবকও আল-জাহরাবি।
একাদশ শতকে ইউরোপে আরবের সুগন্ধির মোটামুটি আগমন ঘটে। মুসলমানদের সঙ্গে মিলে দ্বাদশ শতকে ইউরোপীয়রা বাণিজ্যিকভাবে সুগন্ধির ব্যবসা শুরু করে। কুইন এলিজাবেথ অব হাঙ্গেরি (১২০৭-১২৩১ খ্রিস্টাব্দ) ইউরোপে সুগন্ধি বা পারফিউমকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এলিজাবেথের ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়। ২০ বছর বয়সেই তিনি বিধবা হয়ে যান। বেঁচে থাকেন মাত্র ২৪ বছর। তার নির্দেশনায় সর্বপ্রথম সুগন্ধি তেলের সঙ্গে এলকোহল মিশিয়ে পারফিউম তৈরি করা হয়। তার এই সুগন্ধি 'হাঙ্গেরি ওয়াটার' নামে পরিচিতি পায়। বলতে গেলে এর পর থেকেই সারা ইউরোপে এলকোহলনির্ভর সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে।
আরবের সুঘ্রাণে রুচিশীল ইউরোপীয়রা মেতেছিল। শেক্সপিয়রের নাটকেও তাই পাওয়া যায় আরব্য সুগন্ধির কথা। লেডি ম্যাকবেথের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়: Here's the smell of the blood still. All the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand. Oh, Oh, Oh!
আরবের মৃগনাভী জাদুকরি লোবান:
বাঙালিদের কাছে লোবান শব্দটি অপরিচিত নয়। আর কিছু না হোক, লোবান যে একটি সুগন্ধির নাম, তা সবার জানা। পৃথিবীর সুনির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চলে এটি উৎপন্ন হয়ে থাকে। লোবান নানা কিসিমের হয়। লোবান বিশেষজ্ঞ ও ওমান সরকারের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ডক্টর আহমদ ইবনে সুলায়মান আল-হারাসি দুই বছর আগে আল-আরাবিয়া ডটনেটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, অন্তত ১৯ প্রকারের লোবান রয়েছে। যার মাঝে সাত প্রকারের দুর্লভ লোবান গাছ রয়েছে।
লোবানের রেজিন সংগ্রহ করা হয় যে গাছ থেকে, তার নাম বসওয়েলিয়া স্যাকরা। কাঁটাদার এই গাছ দেখতে অনেকটা তেঁতুল গাছের মতো। উচ্চতায় যদিও অনেক ছোট। পাতাও তেঁতুলপাতার মতোই। পেকে গেলে এর কাঁটা ও পাতা লাল হয়ে যায়। গোলাকার লাল রঙের ফল হয়। গাছ থেকে যে আঠা বের হয়, তাকেই লোবান বলে। গাছের গায়ে আঁচড় দিলে এই আঠা বের হয় এবং বাতাসের কারণে জমে যায়। লোবান যত বেশি ধকধবে সাদা হবে, ততই দামি। এই গাছের সন্ধান পাওয়া যায় ইয়েমেন, দক্ষিণ ওমান, ইথোওপিয়া, সুদান, সোমালিয়া, মাদাগাস্কার, ভারত ও দক্ষিণ চীনের কোনো কোনো এলাকায়।
তবে বিশ্বের সেরা লোবান সংগ্রহ করা হয় দক্ষিণ ওমানের পাহাড়ি অঞ্চল জাফফার থেকে। এক টুকরা উৎকৃষ্টমানের লোবানের ঘ্রাণ কয়েক হাজার বছর ধরে অটুট থাকে। বিশেষজ্ঞরা তুতেনখামেনের মমি আবিষ্কারের পর তাতে যে সুবাস পান, তা ছিল টাটকা লোবানের ঘ্রাণ। যে ঘ্রাণ অন্তত তিন হাজার বছরের পুরনো।
জাফফার, আরদুল লুবান কিংবা জাদুকর তালমুশ ও শাজারাতুত দুর:
দক্ষিণ ওমানের জাফফারের পাহাড়ি অঞ্চল। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ। লোবানের ঘ্রাণে ম ম করছে চারপাশ। বাগানের গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে গলে গলে পড়ছে শুভ্র আলো। কাফেলার সওদাগরদের সতর্ক দৃষ্টি শাজারাতুত দুরের ওপর। অপরূপ সুন্দরী। চেহারায় বুদ্ধির ছাপ। এই মূল্যবান তুর্কি নারীকে একবার দাসী হিসেবে বাজারে তুলতে পারলে সোনার দিনারের অভাব হবে না। কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। আমির-উমারারা কেনার জন্য একের পর এক দিনারের থলে ছুঁড়ে মারতে দ্বিধা করবেন না। তার ওজনের সমান সোনা দিয়ে হলেও এই সুন্দরীকে পেতে চাইবে যে কেউ।
সওদাগর যখন এসব ভাবছেন, তখন চাঁদের আলোয় হিরের মতো জ্বলতে থাকা জ্যোতিষীকন্যা পিতার দেওয়া বিশেষ সৌভাগ্যের বস্তুটি হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে। চোখ তার নক্ষত্রের ওপর। লোবানে আকুলকরা ঘ্রাণ যেন তাকে নিরুদ্বিগ্ন করে রেখেছে। কিন্তু বাইরে থেকে যাই দেখা যাক না কেন, সুন্দরী শাজারাতুত দুর তারা দেখে গুনে নিচ্ছেন—শুভ সময় কখন। জন্মের পর মেয়ের মাঝে সৌন্দর্য আর সৌভাগ্যের আলামত দেখতে পেয়ে জোতিষী পিতা মেয়ের নাম দিয়েছিলেন শাজারাতুত দুর বা মনিমুক্তোর বৃক্ষ। সেই মেয়ে আজ নিকৃষ্ট দাস ব্যবসায়ী সওদাগরদের হাতে বন্দী হয়ে বাজারে ওঠার অপেক্ষায়।
বিশ্রামের জন্য কাফেলা বিরতি নিয়েছে দক্ষিণ ওমানের এই জাফফারের পাহাড়ের লোবানের বাগানে। যে বাগানের প্রতিটি গাছে রয়েছে জাদুকর তালমুশের প্রহরী—বিষধর সাপের বসবাস। সামান্য সুযোগ পেলে ছোবল দিতে ছাড়বে না।
শাজারাতুত দুর অপেক্ষা করছেন, কখন সওদাগর পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সুগন্ধির বাগানে বসে আরবের আভিজাত্যের প্রতীক জাফফারের শরাব পান করে শরীর ঢিলে করে ঘুমের কোলে হারিয়ে যাবেন। এর মাঝে নক্ষত্রের মাধ্যমে যদি পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, তাহলে জাদুকর তালমুশ তাকে কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করলেও করতে পারেন।
শাজারাতুত দুর কি পালাতে পেরেছিলেন? লোবানের বাগানে কি জাদুকর তালমুশ তাকে কোনো সাহায্য করেছেন? জানতে হলে পড়তে হবে উর্দু কথাসাহিত্যিক রিয়াজ ফরসবির উপন্যাস 'শাজারাতুত দুর'। বইটি খুব সম্ভবত এক যুগ আগে পড়েছিলাম। ওপরের লেখাটুকু স্মৃতি থেকে নিজের মতো লেখা। উপন্যাসটি হাতের কাছে নেই বলে সেখান থেকে হুবহু তুলে দিতে পারলাম না।
লোবান, জাফফার বা শাজারাতুত দুর—এ কয়টি শব্দ মনে পড়লেই রিয়াজ ফরসবির সেই উপন্যাসের শুরুর পৃষ্ঠাটির কথা মনে পড়ে যায়। শাজারাতুত দুর পরবর্তীকালে মামলুক সালতানাতের আমলে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নারী শাসক হিসেবে নাম লিখিয়ে মিশরের সম্রাজ্ঞী হয়েছিলেন।
দক্ষিণ ওমানের জাফফারের পাহাড়ি অঞ্চল এখনো দুনিয়ার সেরা লোবানের বাগানের জন্য বিখ্যাত। সবচেয়ে মূল্যবান প্রজাতির লোবান বলে পরিচিত 'হোজারি' লোবান শুধু এই জাফফারেই পাওয়া যায়। খিস্টপূর্ব চার হাজার বছর থেকে এখানে লোবান উৎপাদিত হচ্ছে। বাইবেলেও এ জায়গার উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের বণিকগণকে উৎকৃষ্ট লোবান সংগ্রহের জন্য এখানেই আসতে হতো। এজন্য জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো এই জায়গাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে বলেছে, বহু শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলে লোবানের ব্যবসা চলে আসছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে যেসব বাণিজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়, তার মধ্যে অন্যতম এখানকার এই ব্যবসা।
ইউনেস্কো জাফফারকে 'আরদুল লুবান' বা লোবানভূমি বলে ঘোষণা করেছে।
স্বর্ণের চেয়েও দামি:
রোমান ইতিহাসবিদ ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানী প্লিনি দ্য এল্ডার (২৩-৭৯ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন, এই লোবান ব্যবসাই দক্ষিণ আরবের বাসিন্দাদেরকে সারা দুনিয়ার ধনাঢ্য মানুষে পরিণত করেছে।
সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর আহমদ আল-উবুদি বলেন, আরবের সর্বত্র রয়েছে সুগন্ধির সীমাহীন কদর। উপাসনালয় থেকে শুরু করে বসত ঘর—প্রায় সব জায়গাতেই সুগন্ধি ধূপের ব্যবহার আরবে জনপ্রিয়। এই ধূপ আরব ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ।
ওমানের স্থানীয় এক ব্যক্তি বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে জানান, তারা বিষধর সাপ থেকে বাঁচার জন্য লোবানের ধূপ ব্যবহার করেন। তাছাড়া ধূপ বা সুগন্ধিকে দেখা হয় পবিত্র বস্তু হিসেবে। প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করত, লোবান হচ্ছে ঈশ্বরের পবিত্র ঘাম। জন্মের পর যিশুকে যে তিনটি জিনিস উপহার দেওয়া হয়েছিল, তার একটি ছিল লোবান। মুসলমানদেরও অনেকে মনে করেন, লোবানের ধূপের মাধ্যমে জীন-ভূতের হাত থেকে বাঁচা যায়।
এই ধূপের কারণে পোকা-মাকড়, মশা-মাছির হাত থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে খুব সহজেই রেহাই পাওয়া যায়। জীবাণু ধ্বংসে, এমনকি মহামারি রোধেও লোবান ব্যবহার হয়। তাছাড়া লোবান হচ্ছে আভিজাত্যের প্রতীক।
১৯২২ সালে ফারাওরাজ তুতেনখামেনের মমি থেকে যে সুবাস বেরিয়েছিল, তাতেও ছিল লোবান। পাওয়া গিয়েছিল লোবানের তৈরি মলমের অস্তিত্ব। এ থেকেই বোঝা যায়, লোবানের ব্যবহারকারীরা অভিজাত ও ক্ষমতাবান।
লোবান অ্যারোমাথেরাপি, ওষুধ ও প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহার হয়। কার্যকারিতা, মান, সুবাস, আভিজাত্য এবং চাহিদা ও প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদনের স্বল্পতার কারণে লোবান আজও স্বর্ণের চেয়ে দামি।
লোবান যখন তেল ও প্রসাধনী:
লোবানকে বলা হয় 'কিং অব দ্য এসেন্সিয়াল ওয়েল'। বসওয়েলিয়া স্যাকরা গাছের ছাল, জটপাকানো ডাল ও পাতাগুচ্ছ থেকে আঠা বের করে তা থেকে উন্নতমানের রেজিন বের করে আনা হয়। এ থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় লোবানের সুগন্ধি তেল।
এই তেল ত্বক, মস্তিষ্ক এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য দারুণ উপকারী। গর্ভকালীন কষ্ট থেকে বাঁচতে এবং মেধাবী সন্তান প্রসবের জন্য আরবের গর্ভবতী মায়েরা লোবান গ্রহণ করে থাকেন।
লোবানের ব্যবহার সকল ধরনের জীবাণু থেকে রক্ষা করে। এর কোনো ক্ষতিকারক দিক নেই।
লোবান ও মিরাহ (এক প্রকার বৃক্ষজ আঠা) পুড়িয়ে, গুঁড়ো করে ত্বকের সৌন্দর্যের জন্য ব্যবহার করা হয়। মিশরীয় নারীরা লোবানকে ঘন সুগন্ধি কাজল হিসেবে ব্যবহার করে।
অ্যাসপিরিন থেকে ভায়াগ্রা—সর্বরোগের মহৌষধ লোবান:
ক্রিস্টোফার পিবেকার লিখেছেন, আধুনিককালে ব্যথানাশক বা রক্তক্ষরণ রোধে যেভাবে অ্যাসপিরিন, পেনিসিলিন ও ভায়াগ্রার ব্যবহার হচ্ছে, প্রাচীনকালে তেমনি নানা চিকিৎসায় ব্যবহার হতো লোবান। পাইলস, ঋতুস্রাবের ব্যথা ও মেলানোমার প্রতিষেধক হিসেবে এটি ব্যবহার করা হতো।
গ্রিক সেনাবাহিনীর চিকিৎসক পেডানিয়াস ডায়োসোর্সাইডস লোবানকে এক বিস্ময়কর ওষুধ বলে উল্লেখ করে লিখেন, লোবানের আঠালো রেজিন আলসারের ক্ষত সারিয়ে তুলতে পারে কিংবা বাজেভাবে ভেঙে যাওয়া হাড় একসঙ্গে জুড়ে দিতে পারে।
জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব লাইপজিগ-এর লাইব্রেরিতে থাকা প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল 'দ্য ইবারস প্যাপিরাস'-এ (১৫৫০ খ্রিস্টপূর্ব) লোবানকে শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, গলার সংক্রমণ এবং বমি-বমিভাব দূর করার প্রতিষেধক বলা হয়েছে। এছাড়াও মিশরীয়রা শরীরে গভীর লোমকূপ পরিষ্কার করার জন্য সারা গায়ে নেইত্রনের সঙ্গে লোবান মালিশ করে।
চীনা চিকিৎসাবিদ্যায় লোবান ব্যবহার করা হয়ে আসছে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে।
এন্টি-ব্যাকটেরিয়ার উপাদান ও রক্তসঞ্চালনের চিকিৎসা হিসেবে আজও ব্যবহার হচ্ছে লোবান ও মিরাহ। গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসের শিক্ষক এলেইন তোয়েইদ বলেন, 'ফাদার অব মেডিসিন'খ্যাত গ্রিক চিকিৎসক কস হিপোক্রেটস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০ অব্দ) মিরাহকে অন্য যেকোনো ঔষুধী উদ্ভিদের চেয়ে অধিক কার্যকরি লিখে গেছেন।
রোমান ইতিহাসবিদ ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী প্লিনি দ্য এল্ডার লোবানকে হেমলক বিষের এন্টিডট হিসেবে লিখেছেন।
বর্তমানে চিকিৎসাবিদগণ কর্তৃক লোবান এন্টিসেপটিক, এন্টি-ইনফ্ল্যামাটোরি এবং ব্যথানাশক ঔষুধী উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। বদহজম, পুরনো কাশি, অর্শ্বরোগ এবং শ্বাসকষ্টের ওষুধ হিসেবে লোবান ব্যবহৃত হচ্ছে।
গত দুই দশকের ধারাবাহিক ক্লিনিকাল ও ল্যাবরেটরি গবেষণায় দেখা গেছে, লোবান ও মিরাহ কয়েকটি নির্দিষ্ট অসুখের প্রতিষেধক হিসেবে ভালো অবদান রাখছে। ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালের দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসার, অ্যালসেরাটিভ কোলাইটিস, দুশ্চিন্তা ও অ্যাজমা রোগের চিকিৎসায় লোবান উপকারী।
হুমকির মুখে লোবান:
'কালটিভেশন অব বসওয়েলিয়া' গ্রন্থের লেখক ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী জোশুয়া ইসলামিহ বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে সুগন্ধি তেল এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় সুগন্ধি লোবানের প্রতি মানুষের অধিক চাহিদার কারণে বসওয়েলিয়ার প্রাকৃতিক বৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।'
১৯৯৮ সালে ইন্টারনেশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) সতর্ক করে দিয়ে বলে, লোবানের উৎস বসওয়েলিয়া স্যাকরা গাছ হুমকির মুখে রয়েছে। ২০০৬ সালে ওয়াগেনিনজেন ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড রিসার্চ-এর একজন ইকোলজিস্ট দাবি করেন, ১৯৯০-এর দশকে ইরিত্রিয়ায় বসওয়েলিয়া গাছ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছিল। ২০১৯ সালে একটি গবেষণাপত্র দাবি করেছে, আগামী দুই দশকে ৫০ শতাংশ লোবান গাছ বিলুপ্ত হয়ে পড়বে। এর আগে 'নেচার' ম্যাগাজিনও একই কথা বলেছে।
মানুষের মাত্রাতিরিক্ত লোভ, চাহিদা, দেশে দেশে সহিংসতা ও সংঘাত ছয় হাজার বছরের পুরনো এই অতুলনীয় উপকারী সুগন্ধিটির বিনাশ করে চলেছে।
স্বীকারোক্তি:
এ লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে নিচে উল্লেখকৃত ওয়েবসাইটসমূহ থেকে তথ্যের সাহায্য নিয়েছি। এর বাইরেও কোনো কোনো ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে থাকতে পারি। সবার কাছে কৃতজ্ঞতা।
www.academia.edu
www.theperfumist.com
www.dailysabah.com
www.alarabia.net
www.bbc.com
www.history.com
www.decleor.co.uk
www.wikipedia.org
www.mukaalma.com
www.archive.org