ভালোবাসায় মাখা চিঠির সেই নীল খাম?
ভালোবাসায় মাখা সেই চিঠির নীল খাম আর উড়ে আসে না! ঘুঘু ডাকা দুপুরে যখন ঝি ঝি পোকার যন্ত্রসংগীতে বাড়িটা অর্ধ মাতাল ঠিক তখন সেই মোক্ষম সময়ে খয়েরি রং এর প্যান্ট পরে ইস্টি কুটুম পাখির মত ডাক দিয়ে পিয়ন আর হাক দিয়ে বলে না, "চিঠি, চিঠি, চিঠি এসেছে!!" সেই সোনালি সময় এখন শুধুই কল্পনা আর শুধুই নষ্টালজিক বেদনা ছাড়া আর কী? এই নষ্টালজিক বেদনাকে আত্মায় বন্দী করে আমরা নিত্যই ঘুরে বেড়াই। সত্যি! চিঠি লেখা এখন যেন রূপকথার কোন গল্পের মতই!! রূপকথার গল্প যেভাবে শুরু হয়! 'অনেক অনেক আগের কথা। মানুষ তখন পরস্পরকে চিঠি লিখতো" অথবা ওয়ানস আপন এ টাইম'! চিঠির জায়গা দখল করেছে মেসেঞ্জার, ফেসবুক, টেক্সট মেসেজ, টুইটার, ইমেল আর কত রকমের পদ! মাঝে মাঝে মনে হয় এত তাড়াতাড়ি আমরা ডিজিটাল দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে গেলাম কীভাবে?? লেখক বুদ্ধদেব বসু এ কারণেই কি খেদ থেকে বলেছিলেন "সভ্যতার চন্ডালবৃত্তি"?
বর্তমান সময়ের নতুন প্রজন্ম প্রশ্ন করতেই পারে। "হাতের লেখা চিঠিতে এমন কী যাদু আছে যে এত নষ্টালজিক হতে হবে"? বটে! আমরা যারা ছেলেবেলা থেকেই চিঠি চালাচালি করে বড় হয়েছি আমরা বুঝতে পারি চিঠির গুরুত্ব যে কত! উল্টো করে আমরাই যদি বলি কী ছিল না সেই চিঠির শরীর জুড়ে? একটি চিঠি হাতে আসা মানেই সেই চিঠির ভাঁজ থেকে খসে পড়ত কত না বলা গল্প, হাসি-কান্না, স্বপ্ন-ভালোবাসা আরো কত কী! সেই চিঠির প্রতিটা শব্দে খুঁজে পেতাম প্রাপকের হাতের ছোঁয়া। সেই সাথে ছিল ভালোবাসায় মাখা গোলাপের পাঁপড়ি, হাতের তরতাজা ঘ্রাণ! তারপর সেই চিঠিটা যখন পড়া হত মনে হত চিঠির লেখক বুঝি স্বয়ং আমার দিকেই দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসছে। চিঠি পড়তে পড়তে চিঠির লেখককে তখন কল্পনায় দেখতে পেতাম, ছুঁতে পারতাম। সত্যি বলছি, তাকে ছোঁয়া যেত, ধরা যেত, তার সাথে কথাও বলা যেত। সেই চিঠির শব্দগুলো নিয়ে তখন চলত কতই না খুনসুটি!
খুব জানাতে ইচ্ছে করে হাতের লেখার চিঠির সেই নীল খাম কী আর এখন আগের মত পাওয়া যায়? এই মেসেঞ্জার আর টেক্সট মেসেজের যুগে কেউ কী এখন খুব আদর যত্ন করে চিঠি লিখেন? ভাবুন, এই আমরাই একসময় দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে ভীন দেশের কোন শহরে বসে একটি নীল খামের দিকে তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে ছিলাম! কবে আসবে সেই চিঠি? আর একটা চিঠি কী শুধুই চিঠি? বিষয়টা ভাবলে এখনো নষ্টালজিক হয়ে পরি। এখনো মনে হয় চিৎকার করে বলি, "ফিরিয়ে দাও সেই অরণ্য লও হে নগর"। নোবেলজয়ী তুর্কিলেখক ওরহান পামুক তাঁর স্মৃতি বিস্মৃতি নিয়ে পুস্তক 'ইস্তাম্বুল' গ্রন্থে এই স্মৃতিকাতরতাকে তাঁর গ্রন্থে তুর্কি ভাষায় বলেছেন "হুজুন" যার বাংলা করলে দাঁড়ায় "মিষ্টি বিষাদ"। চিঠি মানেই এখন আমাদের কাছে একটি মিষ্টি বিষাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই লাল নীল খামগুলো জোনাকী পোকার মত এখনো যেন নিত্যই মনে প্রাণে সুগন্ধি বিলিয়ে যায়।
সেই ধুলোয় মলিন হয়ে যাওয়া ডাক বাক্সের কথা আপনাদের মনে আছে? সেই ডাকবাক্সটি ছিল সাক্ষাৎ কোন এক দেবদূত! সেখানে চিঠি ফেলতে মানুষ কত পথ দুর থেকে কত কষ্ট করে চলে আসতো! কিন্তু সেই কষ্টে ছিল আশা, ছিল স্বপ্ন। কত আশা সেই চিঠিকে ঘিরে? একটি চিঠি যেন একটি স্বপ্নপুরনের হাতিয়ার! আর সেই ডাকবাক্সটি ছিল যেন একটি যাদুর কলস! আমাদের সব রঙিন স্বপ্নগুলো সেই যাদুর কলসে বন্দী হয়ে থাকতো। মনে হত এইতো সেই বাক্স যার মাধ্যমে আমি চোখের পলকে উড়ে যেতে পারবো দেশ থেকে দেশান্তরে! আমার স্বপ্ন দেখা রাজকন্যাটির কাছে!
আমার আমেরিকা দীর্ঘ প্রবাস জীবনের শুরুর দিকে প্রতি মাসে আম্মা আমাকে দুটো করে চিঠি লিখতেন। বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কের পাথুরে মাটিতে প্রতি মাসে দুটো তরতাজা চিঠি হস্তগত করা চাট্টিখানি কথা নয়! তারপর ধীরে ধীরে সেটি হল মাসে একটি। তারপর দুমাসে একটি। তারপর তা ডিজিটাল দুনিয়ার দাপটে বিলুপ্ত হয়ে শূন্যের কোটায় চলে গেল। এখন আম্মার সাথে কথা হয় টেলিফোনে, স্কাইপে অথবা কখনো কখনো ফেসবুকের মেসেঞ্জারে। আফসোস! ভালোবাসায় মাখা আমার মায়ের কাছ থেকে আর চিঠি আসে না, বাবার চশমার আড়ালে ঝাপসা চোখের সেই ইস্পাত কঠিন হাতের স্পর্শ আর আমি চিঠির খাম খুলে দেখতে পাই না।
না, অতি আদরের ছোট্ট বোনটিও তার হাজারটা আবদার নিয়ে সেই ভালোবাসায় লুটোপুটি খাওয়া চিঠি আর ডাক বাক্সে ফেলেনা। আসে না আমার প্রিয়ার অতি সযত্নে ভালোবাসায় সিক্ত, চোখের জলের কালিতে লেখা সেই মোহনীয় নীল রঙের খামটি। যে খামের প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকত একটি ছোট্ট গল্প, একটি নদী, একটি ঘুঘু ডাকা উদাস দুপুর অথবা বৃষ্টির মত কান্নাভেজা না বলা সেই গল্প! হায়! এখন চিঠির গায়ের রং পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন চিঠি আসে তার ভীন্ন চেহারা নিয়ে। চিঠি আসে বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রামের মনু মিঞার সাইবার কাফের ইন্টারনেট থেকে, চিঠি আসে সেল ফোনের টেক্সট মেসেজে ভর করে, চিঠি আসে ইয়াহু মেসেঞ্জারের কঠিন চেহারা নিয়ে, ফেসবুকের মেসেজে, ইনস্ট্রাগ্রামে। না, সেখানে প্রাণ নেই, আদরের কোন ছোঁয়া নেই, জীবনের কোন রং নেই, ভালোবাসার গভীরতা নেই, আবেগ নেই, কোন আর্তিও নেই। আছে শুধু লৌকিকতায় ভরা কিছু জাগতিক চাওয়ার পাওয়ার কঠিন হিশেব নিকেশ। আর আছে এই পার্থিব জীবনের কিছু অবাক করে দেওয়া লেন-দেন!!
সুকান্তের সেই বিক্ষ্যাত গান আপনাদের সবারই নিশ্চয়ই মনে আছে! "রানার ছুটেছে খবরের বোঝা হাতে, হাতে লন্ঠন, করে ঠনঠন তবু রানার ছোটে"। অথবা কবি কলিদাসের সেই বিখ্যাত কবিতা 'মেঘদুত" এর কথা? মেঘকে বাহন করে প্রিয়ার কাছে চিঠিতে কতই না তার ভালোবাসার আর্তি, কতই না সেই কল্পনার ডুবসাঁতার খেলা? ভাবা যায় আজ থেকে প্রায় দুহাজার বছর আগে ভারতবর্ষের কোন এক কবি এভাবেই মেঘকে দূত বানিয়ে তার প্রিয়ার কাছে সুখ-দুখের সমস্ত কথা বলতে পেরেছিলেন!
তবে এ কথা বলা যায় যে চিঠির আপাতত কাজ যোগাযোগ রক্ষা হলেও এই ছোট্ট শব্দটি আমাদের মত সাধারন মানুষের মননে, রুচিতে, আত্মায় আর নিত্যদিনের গার্হস্থ্য জীবনে এক বিশাল জায়গা দখল করে বসে আছে। একটি চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন একেকটি প্রাণ আর একেকটি চলন্ত গল্প! আর সেই গল্পের ভেলায় অবলীলায় ভেসে বোড়ানোর আনন্দ আর অন্য কোনভাবে কি পাওয়া যায়, নাকি পাওয়া সম্ভব? আর সে কারনেই একটি চিঠি হল একটি প্রাণ, একটি চিঠিতে থাকে ভালোবাসায় মাখা মায়ের আদর, বাবার শাসন আর প্রেয়সীর হাজারো কথা মালার গোপন আকুলতা নিয়ে এক গোপন আয়োজন!
কিন্তু সময় বদলায়। আর সেই সাথে বদলায় মানুষের মন। বিজ্ঞানের কাছে মানুষের হৃদয় রক্তাক্ত হয় বারবার। উপেক্ষিত হয় আবেগ আর ভালোবাসার বিনিসুতায় গাঁথা হৃদয়ের হাজারো আর্তি। এখন আর লালা-নীল ডোরাকাটা সেই লোভনীয় খাম আসে না। সেই খামের জন্য ডাক পিয়নের পথের দিকে আর কেউ চেয়ে থাকে না। চাঁদের আলোর উপর জায়গা করে বসে আছে শহরের বেহায়া নিয়ন বাতি। ভালোবাসাও ধীরে ধীরে যান্ত্রিক হয়ে যায়, পাথর হয়ে যায়। ইন্টারনেট, টেক্সট মেসেজ, ফেসবুক সহ নানা রঙের মাধ্যমই হল একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম। মানুষের চিঠি লেখার সময় কোথায়? না, এখন আমাদের কারো হাতেই সময় নেই, কথা বলার সময় নেই, গল্প বলার সময় নেই, মান-অভিমান করারও সময় নেই। আর চিঠি লেখার সময়তো নেই-ই। নীল খামে সেই রঙিন স্বপ্ন ভরা চিঠি এখন মরা গাঙের মত একটি সুখের স্মৃতি ছাড়া আর কি?
সেদিন কথায় কথায় স্ত্রীকে বললাম ঠিক আগের মত কি আবার চিঠি লেখা শুরু করা যায় না? আমি নীল খামটির অপেক্ষায় আবার দিন গুনতে চাই। অথবা সুদুর বাংলাদেশ থেকে এক নিশ্চুপ দুপুরে গোটা গোট অক্ষরে লেখা একটি লাল-নীল ডোরাকাটার ইনভেলাপ কি আমার নিউইয়র্কের বাসার ঠিকানায় আসতে পারে না? সেই ইনভেলাপটি খোলার আগে আমি বার কয়েক খামটির ঘ্রাণ নিব, কচলাবো, প্রাণভরে দেখবো। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ইনভেলাপটি অনেক ভালোবাসায় খুলবো!! সময়কে কোন যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না? সেই সময়টায় খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সত্যি সেই লোভনীয় সময়টাকে খুব ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। হায়! কেউ কী আর আমাকে চিঠি লিখবে না? কিন্তু আমিতো চিঠি লিখতে চাই। চিঠি লেখার জন্যে প্রাণটা সারাক্ষণ আনচান করে। কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির মত আমিও বলতে চাই:
"I'll write to you. A super-long letter, like in an old-fashioned novel"