মতিঝিলের বেগম
ঘসেটি বেগম, নওয়াব আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, যার আসল নাম মেহেরুন্নেসা, ১৮ শতকের বাংলার ইতিহাসে একটি প্রধান জায়গা জুড়ে আছেন তিনি। এমন কিছু ঘটনার সঙ্গে তার জীবন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়েছিল যার কারণে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং নওয়াব সিরাজ-উদ-দৌলার সম্পর্কের মধ্যে বিরাট ফাটল ধরিয়েছিল; যে ফাটল চরম আকার ধারণ করেছিল পলাশীর যুদ্ধে, নবাবের পতন হয়েছিল এবং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
ঘসেটিকে তার বাবা আপন ভাইপো নওয়াজিশ মুহাম্মদ খানের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন যাকে নবাব ঢাকার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। তারুণ্যের দুরন্ত নওয়াজিশ বিবাহিত জীবনে ছিলেন নিঃসন্তান। তারা সিরাজের ছোটভাই ইকরাম-উদ-দৌলা (ফজল কুলি)-কে নিজেদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন যা ছিল তাদের জীবনের একমাত্র আনন্দের জায়গা।
সিরাজ-উদ-দৌলার বাবা, জৈন-উদ-দ্বীন (হায়বৎ জং)-কে একদল ভাড়াটে রাজদ্রোহী আফগান হত্যা করে (১৭৪৭) এবং সাথে তাঁর বাবা হাজী আহমদও মারা যান।
নবাব আলীবর্দী, বেঁচে থাকা দুই ভাইপো সাইয়্যিদ আহমদ, যিনি ছিলেন পূর্ণিয়ার গভর্নর এবং নওয়াজিশ মুহম্মহদকে পাশ কাটিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলাকে ১৭৫২ সালে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। সে সময় থেকেই নওয়াজিশ মুর্শিদাবাদে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন, স্ত্রী ঘসেটি বেগমের সঙ্গে।
ঘসেটি সিরাজকে অত্যন্ত অপছন্দ করতেন যেখানে নওয়াজিশ মুহম্মদের মন্ত্রীরা- হোসেন কুলি এবং তার উত্তরসূরি রাজবল্লভ ঘসেটির উচ্চাভিলাষের পথে সিরাজকে তাদের পথের কাঁটা হিসাবে চিহ্নিত করতে সহায়ক হয়েছিল। আপন চাচা বিষয়ে সিরাজের উৎকণ্ঠার যথার্থ কারণও ছিল। নওয়াজিশের সম্পদ ছিল অঢেল, পাশাপাশি দরিদ্র ও বন্ধুহীন ব্যক্তির প্রতি তাঁর ক্ষমাশীল মনোভাব এবং বিভিন্ন ধরণের দাতব্য কাজের কারণে তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু বেশি দিন বেঁচে থাকা তার নিয়তিতে ছিল না। দত্তকপুত্র ইকরাম-উদ-দৌলা (ফজল কুলি)'র মৃত্যুর পর গভীর হতাশায় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। আলীবর্দী, যিনি ইতিমধ্যে তাঁর এক ভাইপোকে হারিয়েছেন, নওয়াজিশের ভঙ্গুর শারীরিক অবস্থা জানতে পেরে শোকাহত ছিলেন।
আলীবর্দী নওয়াজিশকে প্রাসাদে নিয়ে আসেন এবং তৎকালের প্রসিদ্ধ চিকিৎসকদের ডাকেন, কিন্তু কোনও ফল হয়নি। ঘসেটি, তখন বাবার বাড়িতে ছিলেন; সিরাজের ভয়ে ভীত হয়ে পড়লেন; আশঙ্কা করলেন যে তাকে এখানেই বন্দী করা হতে পারে এবং তিনি এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। স্বামী নওয়াজিশের সঙ্গে তিনি একটি পর্দাঘেরা চৌপায়ায় ঢুকে পড়লেন। নওয়াজিশ সেখানেই, ১৭৫৫ সালের ডিসেম্বরে, মারা যান। তাঁর মরদেহ মতিঝিলে নেওয়া হয়, যা ছিল মুর্শিদাবাদ শহরের একটুখানি বাইরে। যে-মতিঝিলকে তিনি নয়নাভিরাম রূপে সাজিয়েছিলেন, সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
নবাব আলীবর্দী শেষ বয়সে পেটের শোথ রোগ এবং স্বজন হারানোর বেদনায়, শোকে ভেঙে পড়লেন। তখন থেকেই যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ কার্যত সিরাজ-উদ-দৌলার হাতে পড়ে। নওয়াজিশ ছিলেন তাঁর প্রকাশ্য শত্রু এবং ঘসেটি স্বামীর ধন সম্পদ সমস্ত কিছু মতি ঝিলে স্থানান্তর করেছিলেন। সিরাজের তখন অর্থের জরুরি প্রয়োজন ছিল, যুদ্ধের সময় অর্থও শক্তিশালী অস্ত্র। সিরাজ খালার কাছ থেকে সাহায্য পাবেন আশা করেছিলেন। কিন্তু ঘসেটি সিরাজকে কিছুই দিবেন না জানিয়ে দেন। এ নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ছিল। সিরাজ ঘসেটিকে জানান যে মীর নাজির আলীর মাথা কেটে তাকে উপহার দেওয়া হবে। নাজির আলী তখন ঘসেটির প্রিয়ভাজন, তিনি প্রতি রাতেই মহলে ঘসেটির সঙ্গে দেখা করতেন। ঘসেটি মনে করেছিলেন সিরাজ কখনও এত অমানবিক হতে পারবেন না। তবে তিনি ভীত হয়ে পড়েন। ব্যাপারটি বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দীর কানে পৌঁছালে খালার সঙ্গে সিরাজের বিরোধ নিরসনের চেষ্টা করেন, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।
ঘসেটি এই আশঙ্কায় ছিলেন যে সিরাজ একবার যদি মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন তাহলে তার সঙ্গে কেবল নির্দয় ব্যবহারই করবে না, তার ধন সম্পত্তিও কেড়ে নেবে। তিনি মুরাদ-উদ-দৌলাকে (ইকরাম-উদ-দৌলার শিশুপুত্র), যাকে তিনি তার একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং সিরাজের বিরুদ্ধে সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ঘোষণা করেন। তিনি তার মৃত স্বামী নওয়াজিশ মুহাম্মদ খানের সৈন্যবাহিনীকে হাতি এবং কয়েক লক্ষ টাকা দেন, এবং সেই বাহিনিকে একটি বিশাল বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। মতিঝিল দুর্গে মীর নাজির আলীর সঙ্গে মিলে নিজের শক্তিকে সুগঠিত করেন। ঘসেটির দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ তাকে সহায়তা করেছিলেন, যাকে সিরাজই নওয়াজিশের মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন চাচার বিষয়আশয় দেখভালের জন্য।
সিরাজ তার মন্ত্রী রাজবল্লভকে মুর্শিদাবাদে ডেকে ঢাকার এস্টেট এবং রাজস্ব সম্পর্কে সরকারের কাছে বিবরণী পেশ করতে নির্দেশ দেন, কিন্তু দেওয়ান রাজবল্লভ ঘসেটির বিপদ হতে পারে মনে করে অসহযোগিতা করলেন। সে জন্য তাকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হলো। কিন্তু সিরাজের মা আমিনা বেগমের অনুরোধে তাকে মুক্ত করা হয়।
রাজভল্লভ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত ছিলেন, ঘসেটির প্রতি তিনি যে আনুগত্য প্রকাশ করেছেন তার ফলে সিরাজ তাকে শত্রু মনে করবেন এবং সিংহাসনে আসার পর চরম প্রতিশোধ নিবেন। নিজেকে তিনি ঘসেটি বেগমের একজন অনুগত এবং সমর্থক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
প্রবীণ নবাব জীবনের অন্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন বলে রাজল্লভ সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকায় তার সম্পত্তি এবং পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। দেরি না করে তিনি ইংলিশ ফ্যাক্টরি অফ কাশিমবাজারের প্রধান মি. ওয়াটসকে চিঠি লিখলেন এই বলে যে, তার পরিবার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে কলকাতায় আসবেন; তাদেরকে কলকাতায় কয়েক মাস থাকার অনুমতি প্রার্থনা করছেন। ঘসেটির ওপর রাজবল্লভের যথেষ্ট প্রভাব ছিল এবং তার নিজের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ইংরেজদের পক্ষে থাকলে কোম্পানির লাভ হতে পারে। সিরাজ কোম্পানির শত্রু আর যদি ঘসেটি সিংহাসনে আরোহণের চেষ্টায় সফল হোন, তবে ইংরেজদের পক্ষে তা খুব উপকারে আসবে।
দেওয়ান রাজবল্লভ ঘসেটির ডান-হাত ছিলেন বলে কোম্পানি তার প্রস্তাবে অনায়াসে সম্মতি জানায়; কলকাতায় তার ছেলে কৃষ্ণ দাসসহ তার পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়।
মৃত্যুর এক দীর্ঘ সারি সিরাজ-উদ-দৌলার মসনদে আরোহনে সহায়ক হয়েছিল। ঘসেটি বেগমের অনুগ্রহভাজন মুরাদ-উদ-দৌলা এবং পূর্ণিয়ার গভর্নর, খালাত ভাই শওকত জং, যিনি তার পিতার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন- এরা ছাড়া সিরাজের আর কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। তবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কেউই তেমন শক্তিশালী ছিলেন না যদিও তাদের মিলিত শক্তি সিরাজের জন্য বিপজ্জনক ছিল। শওকত সিরাজের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করতেন, এবং এ সন্দেহ করা হয় যে, ঘসেটির সঙ্গে মসনদ নিয়ে তার গোপন অভিসন্ধি ছিল। ইংরেজরা মনে করেছিল যে শেষ পর্যন্ত সিরাজ মসনদে বসতে ব্যর্থ হবেন।
নবাব আলীবর্দী পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্যোগী হলেন। প্রিয় দৌহিত্রের উত্তরাধিকারিত্ব নিশ্চিত করার জন্য তিনি সিরাজের পক্ষে তার জ্ঞাতি মীর জাফরসহ দরবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একত্রিত করেছিলেন; সিরাজের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মীর জাফর সেদিন কোরআন ছুঁয়ে শপথ করেছিলেন। কিন্তু সিরাজের সঙ্গে ঘসেটির দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যর্থ হন আলীবর্দী। তিনি মারা যান ১০ এপ্রিল ১৭৫৬ তারিখে। সিরাজ-উদ-দৌলা নিজেকে বাংলার নবাব ঘোষণা করার পরই আলীবর্দীকে গোপনে সমাহিত করা হয়। ঠিক তার পরদিন, খালার ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য সিরাজ মতিঝিল দুর্গ অবরুদ্ধ করেন এমনভাবে যেন বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
কয়েক দিন পর শরফ-উন-নিসা, আলীবর্দীর স্ত্রী, তার মেয়ের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির সুরক্ষার আশ্বাস দিয়ে শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণে রাজি করাতে মতিঝিলে প্রবেশ করেছিলেন। ঘসেটি প্রস্তাবে রাজি হন, এবং তিনি আরও দাবী করেন যে- তার বর্তমান প্রেমিক মীর নাজির আলিকে বাংলায় নিরাপদে চলাফেরার নিশ্চয়তা দিতে হবে। তরুণ নবাব দাবী মেনে নিলেন। ঘসেটি কথা দিলেন নিজের সৈন্যবাহিনী ভেঙে ফেলবেন এবং হারেমে যাবেন।
সেনাধ্যক্ষ এবং সৈনিকদের বন্দী করা হয় এবং পরে তাদেরকে ক্ষমা করে সিরাজের অধীনে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়; ঘসেটির প্রাসাদ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাজ্যের তত্বাবধানে নেওয়া হয়।
সিরাজ তখন পূর্ণিয়ার গভর্নর শওকত জং এবং ঘসেটি বেগমের সহযোগী ইংরেজদের সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন মনস্থ করলেন। ইংরেজরা তখনও কলকাতার চারপাশের দূর্গগুলি বন্ধ করেনি যে, দূর্গগুলি এ দেশের প্রচলিত আইনগুলির বিপরীতে গিয়ে আলীবর্দীর অসুস্থতার সময় নির্মিত হয়েছিল। ইংরেজরা কলকাতায় রাজভল্লভের পুত্র কৃষ্ণ দাসকেও আশ্রয় দিয়েছিল- এরা সবাই ছিল ঘসেটি বেগমের পক্ষের লোক। কৃষ্ণ দাসকে ইংরেজরা সিরাজের হাতে তুলে দেয়নি, তিনি তাদের এ ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু নবাবের কাছে তাঁকে সমর্পণ করতে অস্বীকার জানায় ইংরেজরা। সিরাজ কোম্পানির কাশিমবাজারের কারখানাটি দখল করে কলকাতায় যাত্রা করেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম অধিকার করেন, ১৭৫৬ সালের জুনে। প্রতিশোধপরায়ণ ইংরেজ ব্যবসায়ীরা মাদ্রাজে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন প্রতিশোধ নেওয়ার উপযুক্ত সময়ের জন্য। কাশিমবাজারের পর সিরাজ শওকত জংয়ের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হন; নিহত হন ঘসেটি বেগমের প্রিয় শওকত জং।
পূর্ণিয়ার গভর্নর শওকত জং নিহত হওয়ার সঙ্গে সিরাজ বিরোধীরা অনুভব করেন, এখন কেবল ইংরেজরাই তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে; এটা ভেবেই তারা কোম্পানির ব্যবসায়ীদের সাথে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়, যেখানে সিরাজের পুরোনো শত্রু ঘসেটি বেগম একজন ক্রীড়নকের ভূমিকায় ছিলেন। মীরজাফর, দেওয়ান রাজভল্লভ, জগৎ শেঠ সকলকে নিয়ে ঘসেটি সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতার চরম প্রকাশ ছিল পলাশীর যুদ্ধ যেখানে বাংলার ভাগ্য ইংরেজদের পক্ষে চলে গিয়েছিল, মীর জাফর মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন। মীর জাফরের বর্বর পুত্র মিরণের আদেশে সিরাজকে হত্যা করা হয়। আলীবর্দীর সামনে সিরাজকে রক্ষার যে শপথ মীর জাফর একদিন করেছিলেন তা ততোদিনে তিনি আর মনে রাখেন নি। তিনি নবাব আলীবর্দীর স্ত্রী এবং দুই মেয়ের পাশাপাশি সিরাজ-উদ-দৌলার সদ্য বিধবা স্স্ত্রী লুৎফুন-নিসা ও তাঁর শিশুকন্যাকে, সিরাজের মা আমিনা বেগম এবং সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী তার আপন খালা ঘসেটি বেগমকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করে।
মীর জাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে ঘসেটি আর আমিনা বেগম দুই বোনকে কথিত আছে বুড়িগঙ্গায় মাঝনদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
সূত্র: বেগমস অফ বেঙ্গল