মশলা রুট
কালো মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ ও অন্যান্য মশলা এখন এতই সস্তা যে,একসময় যে এগুলো সোনা-রুপার চেয়েও দামি ছিল, এ কথা বিশ্বাস করাই কঠিন।
পুরাতাত্ত্বিকদের ধারণা,৫০,০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকেই খাবারের স্বাদ বাড়াবার জন্য সুগন্ধযুক্ত বিশেষ উদ্ভিদ ব্যবহার করে আসছে মানুষ। আদিম মানুষ খাবারের স্বাদ বাড়াবার জন্য মিষ্টিগন্ধযুক্ত মশলা ব্যবহার করত। সব ধরনের সুগন্ধযুক্ত গাছড়া তারা তাদের আদিম দেবতাদের নামে উৎসর্গ করত। ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করত এসব গাছড়া।সেই থেকে মানবজাতিরইতিহাসে মশলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
প্রাচীন যুগে মশলা বাণিজ্য
প্রাচীন আমলে একেকটা বাণিজ্যকাফেলায় প্রায় ৪,০০০ উট থাকত। প্রাচ্য থেকে আসা হরেক পদের মালসামানে বোঝাই থাকত উটগুলোর পিঠ। এসব মালসামানের অধিকাংশইথাকতমশলা।কালিকট, গোয়াও প্রাচ্যের অন্যান্য জায়গা থেকে ব্যাবিলন, কার্থেজ, আলেকজান্দ্রিয়াও রোমের মশলার বাজারে কাফেলা যেত। শত শত বছর ধরে ব্যবসায়ীরাভারতীয় উপকূল থেকে মশলাভর্তি জাহাজ নিয়ে পারস্য উপসাগর ও দক্ষিণ আরবের উপকূল পেরিয়ে,সবশেষে লোহিত সাগর হয়ে মিশরে প্রবেশ করত। প্রাচীনকালে বাণিজ্য কাফেলার ওপর ডাকাতদের হামলা, ঝড়ে পড়ে জাহাজধ্বংস হয়ে যাওয়া ও জাহাজ জলদস্যুর খপ্পরে পড়া ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। এত সব বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও, এসব মশলার ভীষণ চাহিদা ছিল (বিশেষ করে উন্নত গ্রীক ও রোমান যুগের সময়)। চাহিদা এতই তুঙ্গে ছিল যে, ঝুঁকির তুলনায় লাভ ছিল বহুগুণ বেশি।
এ সময় মশলার ব্যবসা করে সবচেয়ে বেশি লাভ করত আরবরা। প্রাচীন আমলে দক্ষিণ আরব ছিল মশলার সবচেয়ে বড় বাজার। 'দ্য স্টোরি অফ স্পাইসেস'-এ হেরোডোটাস আরবদের দারুচিনি সংগ্রহের 'পদ্ধতি' সম্পর্কে একটা কাহিনি বলেছেন। কাহিনিটা এমন:
'বড় পাখিরা ঠোঁটে করে একধরনেরছোট লাঠি নিয়ে আসে বাসা বানাবার জন্য। এগুলোকে আমরা গ্রিকরা দারুচিনি বলে ডাকি। আরবরা অদ্ভুত একটা উপায়ে দারুচিনি জোগাড় করে। মারা যাওয়া সমস্ত ষাঁড় এবং জন্তুকে কেটে বড় টুকরো করে মাংসগুলো ওসব পাখির বাসার আশপাশে রেখে দেয় ওরা। তারপর খানিকটা দূরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। এরপর পাখিগুলো মাংসের টুকরো নিয়ে বাসায় উড়ে যায়। মাংসের ভার সইতে না পেরে বাসাগুলো মাটিতেভেঙে পড়ে। এবার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দারুচিনি নামের লাঠিগুলো কুড়িয়ে নেয় আরবরা। পরে ওগুলো আরব থেকে অন্যান্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।'
এ সময় লোকে জাদুবিদ্যা, জাদুকর, ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করত। তাদের এসব অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আরবরা প্রাচীন বিশ্বের অন্যান্য বাসিন্দাদের বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছিল যে, একমাত্র তাদের সাথে ব্যবসা করলেই মূল্যবান মশলা পাওয়া যাবে। মশলাগুলোর প্রকৃত উৎস গোপন করার জন্যতারা পৌরাণিক কাহিনি ফেঁদে বসত। এ কারণেই মশলা বাণিজ্যেআরবরাই প্রথম একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিল।
ভারতে পর্তুগিজরা
তখন সারা বিশ্বেই নতুন নতুন আবিষ্কারের হিড়িক পড়ে গেছে। সে সময়ই, ১৪৯৮ সালে, ভারতের কালিকটে পৌঁছান ভাস্কো দা গামা। বন্দরে পা রেখেই বদলে দেন ইতিহাসের গতিপথ। ভারতবর্ষে আসার বিকল্প পথ আবিষ্কার করেন দা গামা। ফলে মশলা ব্যবসায়অল্প সময়ের জন্য আধিপত্য বিস্তার করতে পারে পর্তুগিজরা। মশলা বাণিজ্যের কল্যাণে পর্তুগাল আঞ্চলিক ও বাণিজ্যিকভাবে বড় শক্তি হয়ে ওঠে। ১৫১১ সাল নাগাদ, ভারতের মালাবার ও সিলন উপকূলের মশলা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে আসেপর্তুগিজদের হাতে।ষোলো শতকের শেষ অবধি ভারতে একচেটিয়া মশলা ব্যবসা করে অস্বাভাবিক লাভ করে তারা।
লিসবনে ফিরিয়ে আনা প্রধান পণ্যটি ছিল কালো মরিচ। সে যুগে কালোমরিচ ছিল সোনার মতোই মূল্যবান। ষোড়শ শতাব্দীতেপর্তুগালের বাৎসরিক আয়ের অর্ধেকেরও বেশিআসত পশ্চিম আফ্রিকার স্বর্ণ এবং ভারতীয় মরিচ ও অন্যান্য মশলা থেকে। মশলা থেকে আয়ের আনুপাতিক হার ছিল সোনার চেয়ে অনেক বেশি।
অন্যান্য প্রতিযোগী ও মরিচ চাষিদের বিরোধিতার কারণে মরিচ ব্যবসায় পর্তুগিজদের একচেটিয়া আধিপত্য অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। ১৫৮০-র দশকের মধ্যে ভেনিসে মরিচ আমদানি বেড়ে যায়—পর্তুগালে তা কমে যায়। যেসব জায়গায়মরিচ চাষ হতো, সেখানে পর্তুগালের কোনো প্রভাব ছিল না। অনেক ধরনের 'অবৈধ' ব্যবসা ও কর্মকাণ্ড হতো তখন। মালবাহী জাহাজ ও গরুর গাড়িরকর্মচারীরাই মাল ছিনিয়ে নিত। ১৫৯০-এর দশকেডাচদের হাতে পর্তুগিজদের একচেটিয়া রাজত্বের অবসান ঘটে।
রেনেসাঁ যুগে ইউরোপে মশলার ব্যবহার
রেনেসাঁ যুগে লোকে মশালার হরেক রকম ব্যবহার আবিষ্কার করে। রেনেসাঁ অর্থনীতির প্রাথমিক ভিত্তিই ছিল মশালার ব্যবসা। মাংস সংরক্ষণ ও স্বাদ ঠিক রাখার জন্যগোলমরিচ ব্যবহার করা হতো। পরিচ্ছন্নতা আর বায়ুচলাচলের বিকল্প হিসেবেব্যবহৃত হত লবঙ্গ ও দারুচিনি। ঘর থেকে পায়ের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য মেঝেতে ছিটিয়ে দেয়া হতো এসব।বিস্বাদ খাবারের স্বাদ বাড়াবার জন্য লোকে জায়ফল ব্যবহার করত। সে আমলেশ্বাসকষ্ট, রোগবালাই ও দুর্গন্ধ দূর করবার জন্য অনেক বাড়িতেইনানা ধরনের সুগন্ধিযুক্ত মশলাভর্তি ছোট ছোট পাত্র ঝুলত।ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের মশলার জোগান আসত ভারত থেকে। গোলমরিচজন্মাত কোচি ও মালাবার উপকূল থেকে, দারুচিনি ও এলাচ চাষ হতো সিলনে, এবং লবঙ্গ জন্মাত বঙ্গোপসাগরের উপকূলে।
ভারতে ডাচ ও ইংরেজরা
মশলা বাণিজ্যে পর্তুগিজদের ক্ষমতা কমে আসার সুযোগটা নিল ডাচ ও ইংরেজরা। ১৬ শতকের শেষ দিকে বিপুল উদ্যমে মাঠে নেমে পড়ে ডাচরা । ডাচ অভিযাত্রী ভ্যান হাউটম্যান ও ভ্যান নেক স্থানীয় সুলতান ওবাণিজ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। এর সুবাদে ১৭ শতকের গোড়ার দিকে হল্যান্ড এ ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে।১৬৫৮ সালে সিলনের দারুচিনি ব্যবসা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৬৬৩ সালে মালাবার উপকূলের সেরা মরিচ বন্দরগুলোও তাদের ছিল। আমস্টারডামে দারুচিনি বা অন্যান্য মশলার দাম একেবারে পড়ে গেলে তারা মশলা পুড়িয়ে ফেলত।
প্রথমে পর্তুগিজদের জন্য বড় হুমকি ছিল ইংল্যান্ড। পরবর্তীতে শক্তিশালী নৌবাহিনীর কল্যাণেতাদের সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে ডাচরা। ১৬০০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ব্যবসা চালু করার সনদ দেন রানি প্রথম এলিজাবেথ। সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য ছিল মশালাবাহী বাহনগুলোর দখল নেওয়া। ডাচদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য ধীর-স্থিরভাবে কাজ করে যেতে থাকে ব্রিটিশরা। অবশেষে ১৭৮০ সালে যুদ্ধ বেধে যায় ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের মধ্যে। এ যুদ্ধের পরিণতিতে ভারতে ডাচদেরক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে সমস্ত ক্ষমতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে।
আধুনিক বাণিজ্য
মশলা চাষিরা তাদের পণ্য এখন নিজস্ব সংস্থা বা রপ্তানি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দেশের বাইরে পাঠায়। এখন মশলার বিপণন করে খাবার প্রস্তুতকারী, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে ভারতের মতো আবহাওয়া আছে যেসব অঞ্চলে, সেখানেও মশলার চাষ করা যায়।
তথ্যসূত্র:
১। Baker, J.N.L. 'A History of Geographical Discovery and Exploration.' London: George G. Harrap & Co. Ltd., 1931.
২। Boxer, C.R. 'The Portuguese Seaborne Empire.' London: Hutchinson, 1969, 1415-1825
৩। Disney, A. R. 'Twilight of the Pepper Empire.' Cambridge: Harvard University Press, 1978.
৪। King, Leonard W. 'Babylonian Magic and Sorcery.' London: Luzac & Co., 1896.
৫। Parry, John W. 'The Story of Spices.' New York: Chemical Publishing Co., Inc., 1953.
৬। Pearson, M.N. 'The Portuguese in India.' Cambridge: Cambridge University Press, 1987.