মশলা শক্তি ও মশলা লড়াই
মশলার দেশে কলম্বাস
মশলা যার নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর মালিকানা তার।
He who controls spice controls the universe - ফ্রাঙ্ক হারবার্টের এই স্মরণীয় উক্তি অন্তত দু'শ বছরের জন্য অভ্রান্ত সত্য ছিল।
১৬২২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে ক্যাপ্টেন ল্যাঙ্কাস্টার ভারতের মরিচ নিয়ে যখন লন্ডনের বন্দরে ভিড়লেন, রাজ্য বিজয়ের চেয়ে বেশি উত্তেজনা ও উত্তাপ সঞ্চারিত হয় তখনকার বিলেতে। জাহাজ ভর্তি মরিচ। ক্রেতারও কমতি নেই। জাহাজ ভর্তি মরিচ বিক্রি হলো ৭৩০০০ পাউন্ড স্টার্লিংয়ে-- মূল্য সমন্বয়ের পর একালের হিসেবে তা ১৯ মিলিয়ন পাউন্ড ছাড়িয়ে যাবার কথা। ১৬০০ সালে উত্তমাশা অন্তরীপের পূর্বাংশে বাণিজ্যে 'একচেটিয়া অধিকার সনদ' লাভের পর এমন বিস্ময়কর মুনাফা দেখে ভারতীয় মসলার প্রতি ব্রিটিশ তথা ইউরোপিয় আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। মসলার পথ ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেমন করে বাংলা ও ভারত সাম্রাজ্য অধিকার করে বসল সে কাহিনী ভিন্ন এক অভিসন্দর্ভ দাবি করে। সংক্ষেপে এটাই বলা যায় মশলা বাণিজ্যের স্বাদ পেয়ে মসলা নিয়ন্ত্রণ করতে করতে ভারত সাম্রাজ্যই এসে যায় কোম্পানি সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
কেবল ভারত নয় পৃথিবীর মশলাপ্রধান প্রতিটি দেশ প্রতিটি দ্বীপ কোনো না কোনো ইউরোপিয় গোষ্ঠীর ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, স্প্যানিশ কিংবা পর্তুগিজদের অধিকার চলে আসে। অধিকার নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেও লড়াই হয়, দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহৃত হয় স্থানীয় মানুষ ও মশলা উৎপাদনকারীগণ। এই ব্যবসায়ের পাশাপাশি লাভজনক দাস ব্যবসাও চলতে থাকে।
মশলার জন্য সহস্রাব্দের নির্মম কিছু হত্যাকান্ড ঘটেছে ভাস্কো-দা-গামার হাতে, বান্দা ও মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জে, শ্রীলঙ্কায় ভারতে।
যেসব সামুদ্রিক বাণিজ্যপথে আরবীয় ব্যবসায়ীদের আধিপত্য, তা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পর্তুগিজ অভিযাত্রী ভাস্কো দা গামা ভারত মহাসাগরে তার তৃতীয় অভিযানে নেতৃত্ব দিলেন। সময়টা ১৫০২ সাল, তার সঙ্গে ২০টি সশস্ত্র জাহাজ। পর্তুগিজরা ১২টি আরব বাণিজ্য জাহাজ ধ্বংস করে দেয় এবং ভারতীয় বন্দরে কামানের গোলাবর্ষণ করে। ভাস্কো দা গামা ভারতের কানপুরের কাছাকাছি এসে আরব উপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে আক্রমণ ও অবরোধ চালিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তারা 'মেরি' নামের একটি জাহাজ অবরোধ করে, জাহাজটি মিসরীয় হজযাত্রীদের নিয়ে মক্কা থেকে ফিরে আসছিল। এতে ভারতের ও কালিকটের ক'জন বিশিষ্ট ধনী মুসলমান ব্যবসায়ীও ছিলেন। তারা নিরস্ত্র জাহাজটির দিকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
ভাস্কো দা গামা অবরুদ্ধ জাহাজের সব মূল্যবান দ্রব্য উঠিয়ে নেন; জাহাজের ২০ জন শিশুকে নিয়ে যান, তাদের খ্রিস্টীয় চার্চ 'আওয়ার লেডি অ্যাট বেলেম'-এ দীক্ষা দিয়ে যাজক বানাবেন। অতঃপর তার বাহিনীকে 'মেরি' জাহাজের এক অংশে আগুন ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।
আগুন ধরিয়ে ভাস্কো দা গামার বহর চলে গেল। জাহাজের লোকজন আপ্রাণ চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে এবং একপর্যায়ে নেভাতে সক্ষম হয়। দূর থেকে ভাস্কো দা গামা যখন আগুনের শিখা দেখতে পেলেন না, তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বহর নিয়ে আবার ফিরে এলেন।
হজযাত্রীরা তাকে আরো বেশি পরিমাণ মসলা ও সম্পদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করলেন। জাহাজের সব যাত্রীকে ডেকের ভেতর ঢুকিয়ে জাহাজে গান পাউডার ছড়িয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ অবস্থায় জাহাজ যাতে কোনোদিকে যেতে না পারে, সেজন্য গোলাবর্ষণও চলতে থাকে। আগুনে জ্বলতে জ্বলতে তীর্থযাত্রী বহনকারী জাহাজ মেরি ডুবে যায়। নির্মম মৃত্যুর শিকার হয় প্রায় ৪০০ মানুষ।
প্রতিশোধের তৃপ্তি নিয়ে ভাস্কো দা গামা কালিকটের কাছে আসেন এবং তার বাহিনী সন্ত্রাস ছড়াতে ৩০ জন জেলেকে হত্যা করে উপকূলে ছড়িয়ে রাখে। কৃতিত্বের জন্য তাকে পর্তুগালের রাজা ইন্ডিয়ার ভাইসরয় নিয়োগ করেন।
এই নিবন্ধটিতে মশলাদ্বন্দ্ব এবং বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক অধিকারের উপর কিছুটা আলোকপাত করা হবে। একালে তেল সমৃদ্ধ দেশের উপর যেমন বৃহৎ শক্তিগুলোর নজর একসময় মশলাসমৃদ্ধ দেশের প্রতি একই আচরণ করেছে তখনকার বৃহৎ শক্তিগুলো।
মশলার দস্যুতা ও নাইটহুড
জলদস্যু হিসেবে মসলার জাহাজ লুটপাট করে, বণিকদের খুন খারাবি করে এমনকি কেউ কেউ নারী ধর্ষণে লিপ্ত হয়েও যখন অভিযানের সাফল্যের সংবাদ, আবিষ্কারের সংবাদসহ এবং সরকার ও সম্রাট কিংবা সম্রাজ্ঞীর জন্য বিপুল উপঢৌকন নিয়ে হাজির হয়েছেন, ব্রিটেন তাদের নাইটহুড দিয়েছে, স্যার সম্বোধন করেছে। লুটের জাহাজে কেবল মশলা নয় অন্যান্যপণ্যসামগ্রীও থাকত। সেই দস্যুদের নাম সসম্মানে উচ্চারণ করা হয়ে থাকে:
স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক
স্যার ওয়াল্টার রেলি
স্যার রিচার্ড হকিন্স
স্যার মার্টিন ফ্রবিশার
স্যার হামফ্রে গিলবার্ট
স্যার রিচার্ড গিলবার্ট
স্যার রিচার্ড গ্রেনভিল
স্যার জন হকিন্স।
১৬৬০ থেকে ১৭২৫-এই ৬৫ বছর চিহ্নিত হয় জলদস্যুতার স্বর্গযুগ হিসেবে। এ সময় সাগর মহাসাগরের উপর বাস্তবিক অর্থে কোনো রাষ্ট্রীয় শাসন ছিল না। ছিল জলদস্যুদের শাসন কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই তাদের দস্যুতার লাইসেন্স প্রদান করত। বাণিজ্য ও সমুদ্র নিরাপত্তার স্বার্থে এমন কোনো অপকর্ম নেই যে তারা করত না। একালের সমালোচকরা ব্রিটেনের রয়াল নেভিকে জলদস্যুদের উত্তরসূরি বলে থাকেন।
নাইটহুড প্রাপ্ত অনেকের জীবনকাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর নির্মমতা, অসহায় মানুষ খুন, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং নারী অপহরণ ও ধর্ষণ। টাকার বিনিময়ে ব্রিটেনে লর্ডশিপ কেনার কাহিনী ইতিহাস স্বীকৃত এবং বিংশ শতকেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
মশলাযুদ্ধই পৃথিবীর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
ওলন্দাজ বনাম পর্তুগিজ
১৮৪৮ সালে পিপলস জার্নাল নামের একটি স্কটিশ সংবাদপত্র বিশ্বযুদ্ধকথাটি প্রথম ব্যবহার করেছে-- 'পৃথিবীর বড় শক্তিগুলোর মধ্যে যে যুদ্ধ তা অবশ্যই ওয়ার্ল্ড ওয়ার—বিশ্বযুদ্ধ' ১৮৬০ সালের বিখ্যাত 'শ্রেণী সংগ্রাম' প্রবন্ধ সিরিজে কার্ল মার্ক্সস ও তার সহলেখক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস বেশ ক'বার 'বিশ্বযুদ্ধ' ব্যবহার করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার ঠিক দশ বছর আগে ১৯০৪ সালে প্রকাশিত জার্মান কথাশিল্পী গাস্ট ভিলেম অটোর উপন্যাসে বিশ্বযুদ্ধ শিরোনাম হয়ে এসেছে। তার উপন্যাসটির নাম দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়ার। জার্মান ড্রিমস। পরবর্তী সময়ে মূল নাম খানিকটা বদলে দ্য কামিং কনকোয়েস্ট অব ইংল্যান্ড নামে ইংরেজিতে অনূদিত উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এখনকার সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নামের যে দেশ চিহ্নিত হয় চারশত বছর আগে তার অস্তিত্বই অজানা ছিল। মানুষের আকাশে উড়ে যুদ্ধ করার শতবর্ষ পূরণ হতে এখনও বাকী। প্রযুক্তির সনিক বুম ছিল না-- আকাশে গর্জন ছিল মেঘের। স্থলভাগে সাগর নদী পেরিয়ে যুদ্ধ করাটা খুব সহজ ছিল না। সেই জন্য প্রকৃত রণাঙ্গন ছিল সাগর ও মহাসাগর। তখনকার আগ্রাসি শক্তিও ছিল হাতে গুণা ক'টি: পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসি। অন্যান্য শক্তি নিজেদের বাণিজ্য স্বার্থ এবং ভৌগলিক সীমান্ত রক্ষায় ব্যস্ত থাকত।
২০১৯ সালে আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির শতবর্ষ পালন করছি। কিন্তু পিটার এমার, ব্যান্টলে ডানকান, জোনাথান ইজরায়েল, লাইন ম্যাক্যালিস্টার প্রমুখের রচনা মহাযুদ্ধের সংজ্ঞার আলোকেই নতুন করে ভাবতে হবে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির প্রায় সাড়ে তিনশত বছর পূর্তি আমরা ২০১৯-এ পালন করতে পারতাম।
১৫৮৫ সালে স্পেন যখন অ্যান্টওয়ার্প বর্তমান বেলজিয়াম দখল করে নেয় তার আগে পর্যন্ত ওলন্দাজদের ইউরোপের বাইরে তেমন কোনো বাণিজ্যিক অভিজ্ঞতা ছিল না। অথচ ১৬০৯ সালের মধ্যে পৃথিবীজুড়ে তাদের ছয়টি বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়:
১. এশিয়াতে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রাইভেটিয়ার জাহাজে সমুদ্র বাণিজ্যের অধিকার ও অন্যদের বল প্রয়োগ করে প্রতিহত করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়।
২. আফ্রিকান বন্দরের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক।
৩. ব্রাজিল থেকে ক্রমবর্ধমান হারে চিনি আমদানি এর নিজেদের মালামাল রফতানি।
৪. ওয়েস্ট কোস্ট বা গিনির কাছাকাছি স্থানে কয়েকটি উপনিবেশ স্থাপন ।
৫. পর্তুগালের লবনমাঠ থেকে বিতাড়িত হয়ে লবনের জন্য ভেনেজুয়েলাতে অনুসন্ধান। ব্রিটিশ লবণ হেরিং মাছ সংরক্ষণের মতো উঁচু মানের লবন নয়।
৬. উত্তর আমেরিকার সাথে ওলন্দাজ বাণিজ্য।
ওলন্দাজ সম্প্রসারণ পর্তুগিজদের জন্য বিশেষ মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং বিভিন্ন রুটে পর্তুগিজ বাণিজ্য ও একচেটিয়াত্ব সঙ্কুচিত ও রহিত হতে থাকে।
অন্যদিকে পর্তুগিজ ও স্পেনিয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং সেই সাথে কখনো কখনো সাম্রাজ্য বিস্তার সাতটি সার্কিট ধরে এগিয়েছে:
প্রথম সার্কিট: আটলান্টিক দ্বীপপুঞ্জ ও আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল পর্তুগিজদের দখল কিংবা বিজয়ের ইচ্ছে ছিল না। তারা উপকূল বাণিজ্যেই সন্তষ্ট ছিল।
দ্বিতীয় সার্কিট: নিউ ওয়ার্ল্ড যাত্রা। এখানে স্পেন প্রধান শক্তি, ক্যারিবিয় অঞ্চল, মেক্সিকো, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। ষোড়শ শতকে প্রায় আড়াই লক্ষ স্পেনিয় এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ব্যবসা ছিল খনিজ, কৃষিপণ্য ও ক্রীতদাস।
তৃতীয় সার্কিট: পর্তুগিজদের নিউ ওয়ার্ল্ড অভিযান, ব্রাজিলে উপনিবেশ স্থাপন। ৫০০০ হাজার পর্তুগিজ ১৬০০ সালের মধ্যে বসতি স্থাপন করে ওই অঞ্চলে। ব্যবসা ছিল কৃষিপণ্য ও ক্রীতদাস।
চতুর্থ সার্কিট: এশিয়াতে পর্তুগিজ আগমন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ।
পঞ্চম সার্কিট: ৬০০০ পর্তুগিজের এশিয়ায় বিশেষ করে, ভারতে অস্থায়ী বসতি স্থাপন। উপনিবেশ পরিকল্পনা ছিল না। বছরে ৭টির বেশি জাহাজ পর্তুগাল বন্দর ছেড়ে যায়নি। তাদের মূল বাণিজ্য ছিল মধ্যবর্তী দেশগুলোর সাথে, লুন্ঠনও বাণিজ্যের অংশ হয়ে উঠেছে তখন। আরব ও চীনের জাহাজ লুণ্ঠনের শিকার হয়।
ষষ্ঠ সার্কিট: ফিলিপিন্স ও জাপানের সঙ্গে চলছিল মূলত রূপা ও সিল্কের ব্যবসা।
সপ্তম সার্কিট: পশ্চিম আফ্রিকা থেকে পর্তুগিজরা আড়াই লক্ষ ক্রীতদাস ইউরোপ, আটলান্টিক দ্বীপসমুহ স্পেনিশ আমেরিকা ও ব্রাজিলে সরবরাহ করে।
১৫৮৫ সালে স্প্যানিশদের অ্যান্টওয়ার্প দখলের পরই ওলন্দাজরা প্রকৃত অর্থে সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা ভারতে পর্তুগিজ বাণিজ্য সাম্রাজ্যে হানা দিয়ে তছনছ করে ফেলে এবং নিজেদের বানিজ্য ঘাটি স্থাপন করে। পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের বদলে ওলন্দাজ সাম্রাজ্যগড়ে উঠে। তারা পশ্চিম আফ্রিকা দখলে নিয়ে নেয়। তাদের চাপে পর্তুগিজ সামুদ্রিক অধিকার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। তবে স্প্যানিশ অধিকৃত অঞ্চলসমূহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্তুগিজ ব্যবস্থাপনার চেয়ে ভালো ছিল।
ওলন্দাজ ঐতিহাসিক লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার মি এমার, পিট এমার নামে শিক্ষাঙ্গনে বেশি পরিচিত, তার জন্ম ১৯৪৪ সালে নেদারল্যান্ডস-এর আমস্টারডামের বাইরের একটি শহর হার্লেম-এ। তিনি ওয়ার্ল্ড ওয়ার এড়িয়ে সে যুদ্ধকে বলেছেন দ্য ফাস্ট গ্লোবাল ওয়ার। ১৫৯০ থেকে ১৬০৯ পর্যন্ত প্রায় দুই দশক ধরে চলা এই যুদ্ধ সাম্রাজ্য বিস্তারের চেয়ে বেশি ঘটেছে বাণিজ্য সম্প্রসারনের লড়াই, আর এ বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য অংশই ছিল মশলার। তবে যুদ্ধাবস্থার প্রকৃত মেয়াদ প্রায় ৮০ বছর। যথার্থই বলা হতো : মশলা যার দুনিয়া তার। পিট এমারের 'দ্য ফার্স্ট গ্লোবাল ওয়ার: দ্য ডাচ বার্সাস আইবেরিয়া ইন এশিয়া আফ্রিকা অ্যান্ড দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড ১৫৯০-১৬০৯ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
উত্তরপশ্চিম ইউরোপে স্পেন ও পর্তুগাল মিলে আইবেরিয়ান অঞ্চল। আইবেরিয়ান সাম্রাজ্য বিস্তারের ধারণাটি ব্রিটিশ কিংবা ফ্রান্সের ঔপনিবেশিকরণের মতো তেমন প্রকট নয়। আইবেরিয়া প্রধানত বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছে।
ওলন্দাজ পর্তুগিজ লড়াই-ই কালক্রমে তাই পৃথিবীর প্রথম মহাযুদ্ধের রূপ নেয়। যুদ্ধে অংশ নেওয়া ওলন্দাজ বাহিনী মানে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্মিলিত বাহিনী। যেহেতু মশলার অধিকার কেন্দ্র করে এই যুদ্ধের সূত্রপাত একে স্পাইস ওয়ার বা মশলা যুদ্ধও বলা হয়ে থাকে। বিবদমান দেশ দুটো বাদে অন্যরা তাদের কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনা করে মিত্রদের সাথে যোগ দেয় এবং অংশগ্রহণ করে।
রণাঙ্গন: আটলান্টিক মহাসাগর: ব্রাজিল পশ্চিম আফ্রিকা দক্ষিণ আফ্রিকা।
ভারত মহাসগর: পূর্ব আফ্রিকা ভারত, সিংহল বার্মা।
ইস্ট ইন্ডিজ: মালাক্কা প্রণালী ইন্দোচীন
ইস্ট এশিয়া: চীন, ম্যাকাও ফরমোজা
পর্তুগিজ পক্ষ: স্পেন সাম্রাজ্য ১৬৪০ পর্যন্ত কিংডম অব কোচিন, কিংডম অব হরমুজ, মিঙ্গ চীন, টিউপিস (ব্রাজিল) পতিগুয়ারা ব্রাজিলের আদিবাসী অংশ।
ওলন্দাজ পক্ষ: ব্রিটেন ১৬৪০ পর্যন্ত, কিংডম অব ক্যান্ডি শ্রীলঙ্কা, কিংডম অব কঙ্গো, কিংডম অব এনডঙ্গো, রিও গ্রান্ডে (টিউপিস) ব্রাজিলিয়ান আদিবাসী, থাইল্যান্ড।
যুদ্ধের ফলাফল: হেগ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধে সমাপ্তি ঘটে।
১. ওলন্দাজ সাম্রাজ্য গঠিত হয়।
২. স্পেন-পর্তুগাল যুদ্ধের সূচনা হয়, যদিও ১৬৪০ পর্যন্ত স্পেন পূর্ণ সহায়তা করেছে।
৩. ব্রাজিল, অ্যাঙ্গোলা, পূর্ব আফ্রিকা, গোয়া ও ম্যাকাওতে পর্তুগিজ বিজয় নিশ্চিত হয়।
৪. ঘানা, মালাক্কা, সিংহল, ফরমোজা তাইওয়ান এবং ইন্দোনেশিয়াতে ওলন্দাজ বিজয় সম্পন্ন হয়।
এটা সত্য সাড়ে তিন কি চারশত বছর আগের যুদ্ধে বোমা বর্ষণের সুযোগ ছিল না, ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা যেত না। যেহেতু লড়াই সমুদ্রেই হয়েছে স্থল ও আকাশ রক্তাক্ত হয়নি সত্য, কিন্তু এর ব্যাপকতা, স্থায়ীত্ব ও প্রভাব এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চল সমুহের অংশগ্রহণে এটি বিশ্বযুদ্ধই হয়ে উঠেছে।
জায়ফল জয়ত্রীর বিনিময়ে নিউ ইয়র্ক
একালের যে সব মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন তার সূচনা ১৬০২ সালে নেদারল্যান্ডসে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের মধ্য দিয়ে। এই 'ডিইআইসি'ই আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকাভুক্ত পৃথিবীর প্রথম কোম্পানী। শেয়ার বাজারে যে আইপিওর (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) কথা বলি কিংবা বলি ' গোয়িং পাবলিক' কিংবা আরো সহজে শেয়ার ছাড়ার কথা শুনি এ কাজটি ডিইআইসিই প্রথম করেছে। তারা বাজারে শেয়ার ছাড়ে। মশলার বাণিজ্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনায় পুঁজির মালিকরা আকৃষ্ট হন এবং অল্পসময়ের মধ্যে কোম্পানি সাড়ে ৬ মিলিয়ন গিল্ডার উত্তোলন করতে সক্ষম হয়। ডিইআইসির প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি ও সৃজনশীলতাই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিসমূহ এবং মূলধন বাজারের বৈশ্বিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে।
আরো একটি বিশেষ কাহিনী জড়িয়ে আছে এই কোম্পানির ইতিহাসের সাথে। নিউ ম্যানহাটান দ্বীপ ছিল তাদের দখলে, তারা অধিকার করার পর নাম বদলে দেয়, এটা হয়ে যায় নিউ আমস্টারডাম। ১৬৬৭ সালে কোম্পানি এই বিশাল অঞ্চলটি একটি ছোট্ট দ্বীপের বিনিময়ে ইংরেজদের সাথে অদলবদল করে নিল। কোম্পানি পেল মালাক্কা প্রণালীতে ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপপুঞ্জের ক্ষুদ্র একটি দ্বীপ রান--তবে এই দ্বীপে মশলা উৎপাদিত হত। ইংরেজরা ১৬১৬ সালে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে দ্বীপটি পুরো নিজেদের অধিকার নিয়ে নেয়। এখানে জয়িত্রী ও জায়ফলের ফলন ছিল ভালো। বিনিময়ে ডাচরা যা দিল তা হচ্ছে আজকের নিউ ইয়র্কের পুরোটাই। ইংরেজরাই নিউ আমস্টারডামকে নতুন নাম দিল নিউ ইয়র্ক।
এখনকার নিউ ইয়র্ক এবং বান্দা দ্বীপপুঞ্জের সাথে যারা পরিচিত তারা অবশ্যই বলবেন, এটাছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঐতিহাসিক ভুল।
এই কোম্পানি মশলা বেচে অর্থনীতির পাওয়ার হাউস হতে চেয়েছিল, অনেকটাই সফল হয়েছে, সব সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। একালে এসে এই বিনিময়কে ঐতিহাসিক ভুল মনে হলেও সপ্তদশ শতকের জন্য এটা ছিল বাণিজ্যের অন্যতম'বেস্ট ডিল'। ছোট্ট এই দ্বীপটির অর্থনৈতিক গুরুত্বের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের সম্মিলিত আর্থিক গুরুত্বকেও মেলানো সম্ভব ছিল না।
তখনকার যুদ্ধের প্রাথমিক লক্ষ ছিল আর্থিক লাভ, বাণিজ্য কেন্দ্র দখল লুণ্ঠন, ভোগ ইত্যাদি, সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ এবং নতুন বাজার প্রাপ্তিও ছিল অন্যতম লক্ষ্য। সপ্তদশ শতকের অন্যতম দুই নৌশক্তি ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস সমুদ্রে কর্তৃত্বের লড়াই করে গেছে ক্রমাগত, আচরণগত দিক থেকে উভয়েই জলদস্যুর চেয়ে উত্তম ছিল, তারা জলদস্যুর মতো এক চোখে তালি মেরে রাখত না।
উভয় শক্তিই কাছাকাছি সময়ে নিউ মানহাটান দ্বীপ এবং মালাক্কা প্রণালীতে অত্যন্ত ছোট রান দ্বীপ দখল করে নিল। তবে ডাচরা শিঘ্রই রান থেকে ইংরেজ নৌবহর তাড়িয়ে দিতে সমর্থ হলো। কিন্তুশক্তিবৃদ্ধি করে ইংরেজরা পুনরায় আক্রমণ করে ডাচদের ভীষণ ক্ষতি করতে পারে সে আশঙ্কাও রয়ে গেল। ডিউক অব ইয়র্ক ১৬৬৪ সালে মানহাটান দ্বীপ দখল করে নিলেও ১৬৬৫-১৬৬৭ সালের দীর্ঘমেয়াদী অ্যাঙ্গোলা ডাচ যুদ্ধে ওলন্দাজরা একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নেয়। নৌবাহিনীর অবস্থান এবং নৌযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়াতে উভয়পক্ষই ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে, এক পর্যায়ে ইংল্যান্ড এবং ইউনাইটেড প্রভিন্স অব নেদারল্যান্ডস শান্তিচুক্তিতে সম্মতি জানায়। ৩১ জুলাই ১৬৬৭ নেদারল্যান্ডসের ব্রেডা শহরে ট্রিটি অব ব্রেডা সম্পাদিত হয়; ২৪ আগস্ট ১৬৬৭ থেকে তা কার্যকর হয়। তারা ডিউক অব ইয়র্কের দখলকৃত দ্বীপ থেকে সরে যাবে এবং ইংরেজরাও রান দ্বীপ থেকে দূরে থাকবে। সে কালে সোনার বাটখারায় জায়ফল মাপা হতো।
জায়ফল বাণিজ্যের উপর ডাচদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রায় দড় শত বছর অব্যহত থাকে। ১৮১০ সালে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন কোল বান্দার মূল দ্বীপ অধিকার করে নেবার পর রান তাদের অধিকারে চলে আসে, জায়ফলের নতুন উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, গ্রেনাডা ও অন্যান্য ব্রিটিশ কলোনি বেছে নেওয়া হয়। ডাচরা ক্রমেই বিতাড়িত হয় এবং জায়ফল বাণিজ্য থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।
নতুন শতকের শুরুতে স্থাপনাবিহীন ম্যানহাটান দ্বীপের কেবল ভূমির মূল্য ধরা হয় ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। সে তুলনায় রান দ্বীপের মূল্য এক সহস্রাংশের বেশি নয়।
মশলার রুট
আটটি রুট পৃথিবীর ইতিহাস কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে : সিল্ক রুট, স্পাইস রুট, ইনসেন্স রুট, অ্যাম্বার রুট, টি রুট, সল্ট রুট, ট্রান্স-সাহারান ট্রেড রুট এবং টিন রুট। বিশ্ববাণিজ্যে সবচেয়ে খ্যাত সিল্ক রুট--যা চীনের প্রাচীন সভ্যতার রোমান সাম্রাজ্যকে যুক্ত করেছে। বাণিজ্যিক গুরুত্বে দ্বিতীয় স্থানে স্পাইস রুট, এটি সমুদ্রগামী জাহাজের রুট যা প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যকে যুক্ত করেছে। পঞ্চদশ শতকের আগে উত্তর আফ্রিকান ও আরব মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে প্রাচ্যের মসলা পাশ্চাত্যে পৌঁছাতে এবং মসলার জন্য বহুমূল্য প্রদান করতে হতো। পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে 'অভিযানের যুগে' নৌযান নির্মাণ ও চালনা প্রযুক্তির উন্নতির কারণে একদা অকল্পনীয় দূরবর্তী স্থানসমূহে পৌঁছা সম্ভব হয়েছে। ইউরোপীয় বণিকরা চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত পর্যন্ত পৌঁছেছেন এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেছেন, সাম্রাজ্য বিস্তারের বীজ রোপণ করেছেন স্পাইস রুট ব্যবহার করে।
কয়েকটি মশলাগ্রন্থ
একালের কয়েকটি বইয়ের নাম উদ্ধৃত হচ্ছে, এর কিছু মশলার ইতিহাস আর কিছু মশলা ফিকশন:
নাদিয়া আগুইয়ার: দ্য লস্ট আইল্যান্ড অব ট্যামারিন্ড
স্ট্যানলি রবিনসন: দ্য ইয়ার্স অব রাইস অ্যান্ড সল্ট
মার্ক কার্লানস্কি: সল্ট-এ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি
জ্যাক টার্নার: স্পাইস
জন কি: দ্য স্পাইস রুটস
ফ্রেড রেমন্ড জারা: স্পাইসেস : এ গ্লোবাল হিস্ট্রি
অ্যান্ড্রু ডেলবি: ড্যাঞ্জারাস টেস্টস : দ্য স্টোরি অব স্পাইসেস
গাইলস মিলটন: ন্যাথাানিয়েল'স নাটমেগ: অব দ্য ট্রু অ্যান্ড ইনক্রেডিবল অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য স্পাইস ট্রেডার হু চেঞ্জড দ্য কোর্স অব হিস্ট্রি
মারজোরি শেফার: পেপার: অ্যা হিস্ট্রি অব ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল স্পাইস
রিঙ্কু ভট্টাচার্য: দ্য বেঙ্গলি ফাইভ স্পাইস ক্রনিকলস
আয়ান কার্নেট: স্পাইস আইল্যান্ডস
হেইডি বেটস: সিনামন অ্যান্ড রোজেস
লিন্ডা হোলম্যান: দ্য স্যাফ্রন গেট
ডেভেনপোর্ট স্টুয়ার্ট: ব্ল্যাক স্পাইস
বিশ্বনাথ ঘোষ: ট্যামারিন্ড সিটি: হোয়ার মর্ডান ইন্ডিয়া বিগান
উইলা ওকাটি: কার্ডামন অ্যান্ড ক্লোভ
ওসওয়াল্ড উইন্ড: দ্য জিঞ্জার ট্রি
মাইকেল পিয়ার্সন সম্পাদক: স্পাইস ইন দ্য ইন্ডিয়ান ওশেন ওয়ার্ল্ড
চার্লস কর্ন: দ্য সিক্রেট অব এডেন : এ হিস্ট্রি অব স্পাইস ট্রেড
গ্যারিপল নাভান: কামিন, ক্যামেলস অ্যান্ড দ্য ক্যারাভানস: এ স্পাইস অডেসি
জোয়ানা হল ব্রিয়ারলি: স্পাইসেস : দ্য স্টোরি অব ইন্দোনেশিয়ান স্পাইস ট্রেড
বিকাশ খান্না: দ্য স্পাইস স্টোরি অব ইন্ডিয়া।