যত ছদ্মনামা লিখিয়েরা
১৯৭১।
আনুষ্ঠানিকভাবে তখনো দেশের নাম পাকিস্তান। দেশবিরোধী হিসেবে যারা চিহ্নিত হয়েছেন তাদের একজন ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ঢাকা কলেজ পুরোপুরিই সরকারি। সরকারের বুকে বসে সরকারের গিবত করা বড় গুনাহ, এমন অপরাধীকে ছাড়া যায় না। সুতরাং সামরিক আইন কার্যালয় শওকত ওসমান নামের এই শিক্ষক সম্পর্কে বিষদ অবহিত করার জন্য ডিরেক্টর পাবলিক ইনস্ট্রাকশন- ডিপিআই সাহেবকে লিখল।
ডিপিআই মোহাম্মদ ফেরদৌস খান সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেও পরিচিত। শওকত ওসমান তারও পরিচিত। নিষ্ঠাবান সরকারি চাকুরে হিসেবে সত্যটা জানানোই তার দায়িত্ব। তিনি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেন। তিনি চিঠির জবাবে সামরিক কর্তৃপক্ষকে বলে দিলেন শওকত ওসমান নামে ঢাকা কলেজে কোনো শিক্ষক নেই। এই নামে তার নিয়ন্ত্রণাধীন অধিক্ষেত্রে কোথাও কোনো শিক্ষক নেই।
শওকত ওসমান ততোদিনে ভারতবর্ষে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লেখালেখি করছেন। ফেরদৌস খান ভুল জবাব দেননি। বাস্তবিকই কাগজে কলমে শওকত ওসমান নামে কোনো কলেজ শিক্ষক অন্ততঃ ১৯৭১ সালে বিরাজ করতেন না। কাগজে কলমে যিনি বিরাজমান ছিলেন তার নাম শেখ আজিজুর রহমান। কিন্তু ততদিনে শেখ আজিজুর রহমান তলিয়ে গেল, এই নাম ছাপিয়ে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো ছদ্মনাম শওকত ওসমান।
'নামে কী এসে যায়'
সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ প্রণয়-মোহবন্ধনে আটকে পড়া জুলিয়েটকে দিয়ে শেক্সপিয়র বলিয়েছেন, 'নামে কী এসে যায়।' গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক, সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণের কোনো কমতি হবে না। গোলাপকে ধুতুরা ফুল বললে পুষ্পরাজ্যে কী প্রতিক্রিয়া হবে, তা হয়তো আমাদের জানা হবে না; তবে আমাদের 'বনফুল'কে ধুতুরা বললে তার ভক্তরা তেড়ে আসবেন এবং বলবেন, তার চেয়ে সেই বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ঢের ভালো।
নামে নিশ্চয়ই কিছু এসে যায় নইলে তিনিইবা বনফুল হতে চাইবেন কেন। 'শেক্সপিয়র-স্কেপটিক'রা তো জোর গলায় বলেন, শেক্সপিয়র বলে কেউ নেই, হেনরি নেভাইল কিংবা ক্রিষ্টোফার মারলোর ভিন্ন একটি লেখক নাম উইলিয়াম শেক্সপিয়র।
ছদ্মবেশ ধারণ এবং ছদ্মনাম গ্রহণের ইতিহাস প্রায় সমানবয়সী। নিজের নামকে কারণে-অকারণে আড়াল করে অনেক লেখক ও শিল্পী ভিন্ন নামে খ্যাতিমান হয়েছেন।
ভানুসিংহ ঠাকুর নামধারী পদ্যকার খ্যাত হয়েছেন নিজ নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়েই। বাংলাদেশেও শেখ আজিজুর রহমানের কোনো লেখা পড়ছেন কি-না জিজ্ঞেস করা হলে চুলকাতেই হবে, শওকত ওসমান বললে আর সমস্যা নেই। মৈনাক নামের গদ্যকার কবি শামসুর রাহমানকে ছড়িয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু মার্ক টোয়েন ছাড়িয়ে গেছেন টমাস জেফারসনকে : মার্ক টোয়েন প্রকৃত নাম নয়, এটিও ছদ্মনাম। মূল নাম স্যামুয়েল ল্যাঙ্গহোর্ন ক্লেমেন্স।
মনীষ ঘটক ছদ্মনাম এনেছেন মান্ধাতার বাবার আমল থেকে। মান্ধাতার বাবা যুবনাশ্ব সেজে মনীষ ঘটক দীর্ঘদিন লিখেছেন। একাধিক ছদ্মনামও ব্যবহার করে থাকেন কোনো কোনো লেখক। নীললোহিত বা কালকুট (যথাক্রমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং সমরেশ বসু) ক'নামে লিখেছেন জানা নেই; কিন্তু এডওয়ার্ড অ্যালেকজান্ডার ক্রাউর (১৮৭৫-১৯৪৭) মোট ১৫০ টি ছদ্মনাম ব্যবহার করে লেখালেখি চালিয়েছেন।
বাবাকে এড়াতে ছদ্মনাম
বিংশ শতকের এবং এ পর্যন্ত একবিংশ শতকেরও সবচেয়ে বেশি পঠিত ও অনূদিত কবি নোবেল বিজয়ী ল্যাটিন আমেরিকান পাবলো নেরুদা। চিলির এই কবির নাম আদৌ পাবলো নেরুদা ছিল না। বাবা নাম রেখেছিলেন রিকার্দো নেফতালি রেইস ব্যাসোয়ালতো। লিখতে শুরু করেন চৌদ্দ বছর বয়সে।
'আমার বয়স মাত্র তের কিংবা চৌদ্দ। আমি যে লিখতে চাই এটা আমার বাবাকে ভীষণ অসন্তুষ্ট করল। ছেলের জন্য সদিচ্ছা নিয়েই তিনি ভাবলেন, লেখালেখি পরিবারের জন্য ধ্বংস টেনে আনবে, ধ্বংস আনবে আমার জন্যও- বিশেষ করে এ কারণে আমার জীবনটা পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে পড়বে। গার্হস্থ কারনেই তিনি তা ভেবেছেন, কিন্তু সে কারণ আমার উপর তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। বাবার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমি আমার নামটা বদলে ফেললাম।'
ঠিকই তো, পাবলো নেরুদা নামে রেলওয়ে কর্মচারী হোসে দেল কারমেন রেইস মোরালেসের কোনো পুত্র নেই।
বলা হয়ে থাকে তিনি কবি পল ভ্যালরির নামের অংশ নিয়ে হয়েছেন পাবলো, আর চেকোস্লোভাকিয়ার লেখক ইয়ান নেরুদার কাছ থেকে নিয়েছেন নেরুদা। ইয়ান নেরুদা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন:
আমি তার একটি ছোটগল্প পড়েছি। আমি কখনো তার কবিতা পড়িনি। 'মালা স্ট্রানা থেকে গল্প' নামে তার একটি বই আছে, প্রাগের কাছাকাছি বসবাস করা দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে এই বই। হতে পারে আমার নতুন নামটি তার কাছ থেকেই এসেছে। পুরো ব্যাপারটা অনেকদিন আগেকার, আমার স্মৃতিতে নেই যে স্মরণ করব। তবু চেকরা আমাকে তাদের একজন মনে করে, তাদের জাতির একটি অংশ। তাদের সাথে আমারও বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
বাবার কারণেই তিনি পাবলো নেরুদা হয়েছেন এবং নামটি আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাবলো নেরুদার নাম সর্বাধিক উচ্চারিত নামগুলোর একটি।
মার্ক টোয়েন, ও'হেনরি, লুই ক্যারল, পল এলুয়ার, লু শুন, ইউকিউ মিশিমা, মলিয়ের, জর্জ অরওয়েল-এসব খ্যাতিমান লেখকের পিতৃপ্রদত্ত নাম তলিয়ে গেছে ছদ্মনামের দৌরাত্মের কাছে।
মার খাওয়া ছদ্মনাম
ভানুসিংহের পদাবলী যখন আছে ভানুসিংহ পুরোপুরি মার খাননি। তাকে ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বনামেই বাংলা সাহিত্যের প্রধান স্রষ্টা ও অবিভাবক হয়ে আছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরে আবার আসবেন, তার আগে আইজাক বিকারস্টাফের কথা বলা দরকার। বিখ্যাত জ্যোতিষী এবং মানচিত্রকার জন পারট্রিজকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করার জন্য 'গালিভার্স ট্রাভেলস'-এর লেখক জোনাথন সুইফট এই নামটি নিলেন এবং '১৭০৮ সালের জন্য ভবিষ্যৎবাণী' প্রকাশ করলেন। তার ভবিষ্যৎবাণীর মধ্যে একটি ছিল : প্রচন্ড জ্বরে জ্যোতিষী জন পারট্রিজের মৃত্যু হবে।
ঠিক দু'মাস পর অন্য ছদ্মনামের একজন লিখলেন, জ্যোতিষী জন পারট্রিজ সত্যিই ইন্তেকাল করেছেন। এই দ্বিতীয় জনও আসলে একই ব্যক্তি, আইজাক বিকারস্টাফের আড়ালে সেই জোনাথন সুইফট। জ্যোতিষীর মৃত্যু সংবাদে তার ভক্ত ও স্বজনেরা রাতের বেলা তার বাড়ির জানালার বাইরে কান্নাকাটি করেছে। তার শেষকৃত্যের জন্য ফিউনারেল আন্ডারটেকার এসে হাজির হয়েছেন, তার জন্য শোকগাথা প্রকাশিত হয়েছে, এমনকি কবরের পাথরও খোদাই করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি সংবাদপত্রে বিবৃতি দিতে বাধ্য হন যে তিনি বেঁচে আছেন। এই সংবাদের জন্য আজীবন তাকে বিব্রত হতে হয়েছে। জোনাথন সুইফটের পক্ষের ভাষ্য ১৭০৮ সালের জন্য ভবিষ্যৎবাণী প্রকাশিত হয়েছে এপ্রিল ফুল দিবসে, ১ এপ্রিল ১৭০৮, কাজেই এটাকে সিরিয়াসলি যারা নিয়েছেন তারাই ভুল করেছেন।
গালিভারের সফরনামা ধ্রুপদ সাহিত্য, সুইফটকে ভোলা সম্ভব নয়।
রিচার্ড বাখমানের মৃত্যু ছদ্মনামের ক্যান্সার
এ কালের সেরা বেস্ট সেলিং লেখক স্টিফেন কিং-এর নাম শোনেননি একটি কি দুটি বই হাতে নেননি, এমন ইংরেজি জানা পাঠক খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। কিন্তু ঢাউস আকারের কারণে আমার মতো হয়তো আরো কারো পড়া হয়ে উঠেনি।
স্টিফেন কিং যখন লেখক হয়ে উঠেছেন, ভালো প্রকাশকও পেয়েছেন, সে সময় প্রকাশকরা লেখকদের এমন একটা ধারনা দিতেন যে বছরে একটার বেশি বই প্রকাশিত না হওয়াই উত্তম। একাধিক বই হলে পাঠক কোনটা ফেলে কোনটা কিনবেন তাতে বিভ্রান্ত হন, লেখকের বইয়ের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্টিফেন কিং একটি বই প্রকাশ করে থামতে রাজি নন তিনি তার প্রকাশক সিগনেট বুকসকে বলে কয়ে রাজি করালেন তিনি ছদ্মনামে বই লিখতে শুরু করবেন। সেই লেখকের নাম রিচার্ড বাখমান। ১৯৮৪ সালে বাখমানের বই থিনার ২৮০০০ কপি বিক্রি হলো, এই বইয়ের বিক্রি বাড়াতে স্টিফেন কিং কোনো উদ্যোগ নেননি। কিন্তু পরে যখন জানা গেল বাখমান আসলে স্টিফেন কিং অমনি বিক্রি ঠিক দশগুণ বেড়ে গেল। 'আমি কেন বাখমান ছিলাম' এই শিরোনামে স্টিফেন কিং তার জীবনের বাখমান পর্বটি বর্ণনা করেছেন। অনেক পরে তিনি জানান আসলে ১৯৮৫ সালে রিচার্ড বাখমান সুডোনিম ক্যান্সার রোগের কারণে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। লক্ষ্য করুন : সুডোনিম ক্যান্সার মানে আসলে ছদ্মনামের ক্যান্সার।
নোবেল লরিয়েট চোলে আর্ডেলিয়া ও ফোর্ড
ভীষণ খটকা লাগারই কথা। এ নামের কেউ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আমিও শুনিনি।
কিন্তু তিনি পেয়েছেন ভিন্ন নামে--টনি মরিসন। ১২ বছর বয়সে যখন খ্রিস্টিয় ক্যাথলিসিজমে দীক্ষিত হন তার প্যাট্রন সেইন্ট অ্যান্থনির নাম থেকে গ্রহণ করেন টনি, ডাকনাম। তার প্রথম স্বামীর নাম থেকে আসে মরিসন।
সাথে তার দাম্পত্যকাল ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪। নিজের আসল নাম ছেড়ে টনি মরিসন হয়ে তিনি স্বস্তি বোধ করেননি, কিন্তু ততোদিনে নামটা এতো বিখ্যাত হয়ে উঠে যে, এখান থেকে সরে আসারও উপায় ছিল না। তিনি চোলে নামেই প্রিয়জনদের কাছে পরিচিত। তিনি বলেন যারা আমাকে সবচেয়ে ভালো করে জানে তারা আমাকে চোলে ডাকে। তিনি বলেন চোলে বই লিখেন আর টনি মরিসন ঘুড়ে বেড়ান, সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বলেছেন, আমি দ্বিভাজিত হয়ে গেছি, আসলে আমার নাম চোলে।
পথের রাজা ব্যাঙ্কসি
একালের একটি নাম বলি--ব্যাঙ্কসি। তিনি ঠিক লিখিয়ে না, আঁকিয়ে। আসলে আঁকাআঁকিও লেখা, কলমটা ভিন্ন, কালিটা ভিন্ন, ধরণটা ভিন্ন।
১৯৯০-এর দশক থেকে ইংল্যান্ডের রাজপথের শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী এবং খানিকটা দৃষ্কৃতকারীও (কারো কারো মতে) এই মানুষটি। গ্রাফিতি--রাস্তার পাশের দেয়ালে আঁকা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, যৌনতাশ্রয়ী, বিভিন্ন ধরণের বক্তব্য দেয়ালে আঁকা ছবিতে মূর্ত হয়ে উঠে, এতে রাষ্ট্র ক্ষিপ্ত হয়, জনগণ এ ধরনের ছবিকে স্বাগত জানায়।
কিন্তু ব্যাঙ্কসি আসলে কে?
২০১৪-র অক্টোবরে সামাজিক মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ল ব্যাঙ্কসি গ্রেফতার হয়েছেন এবং তার আসল পরিচয় বেরিয়ে এসেছে।
এ খবরটি সঠিক ছিল না।
২০১৭-র জুনে রবিন নামের একজন নিউ ইয়র্কের একটি হোটেলে উঠেছিলেন, দাবি করা হয় তিনিই আসল ব্যাঙ্কসি।
২০০৩ সালে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিবেদক সিমন হ্যাটেনস্টোনকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। প্রতিবেদক তখন তাকে ২৮ বছর বয়স্ক সাদা যুবক, অপরিচ্ছন্ন জিনস আর টি শার্ট পরা সিলভার বর্ণ দাঁতের, সিলভারের চেইন এবং সিলভারের কানের দুল পরিহিত বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি চৌদ্দ বছর বয়সে আঁকাআঁকি শুরু করেন, ছোটখাট অপরাধের জন্য জেলও খেটেছেন।
মনে করা হয় রবিন গানিংহ্যাম তার নাম, ব্রিস্টলে জন্ম। গ্রাফিতি শিল্পী রবার্ট ডেল মাজাই ব্যাঙ্কসি এটাও কারো কারো দাবি। কমিক আর্টিস্ট ও কার্টুনিষ্ট জেমি হিউলেট হচ্ছেন আসল বাঙ্কসি, এটাও কেউ মনে করেন।
ছদ্মনাম নয়, তবুও ছদ্ম
মাইকেলেঞ্জোলোর মতো শিল্পীকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান ডোমেনিকো থিওটোপোপালো নামের স্পেনদেশীয় এক শিল্পী। কিন্তু স্পেনিশরা তাকে নিজেদের বলে মেনে নিতে নারাজ। কারণ এই চিত্রশিল্পীর জন্ম গ্রিসে, ক্রিট নগরে। স্পেনিশরা এই শিল্পীকে যে নাম ধরে ডাকবে তাতেও তেমন সুবিধে করতে পারল না--কারণ নামের থিওটোকোপোপালো অংশইর বেশ খটমটে। কিন্তু তাকে এড়িয়ে যাবারও সুযোগ নেই কারণ ছবি একে তিনি অনেক নাম করে ফেলেছেন। তারা তাকে ডাকতে শুরু করল : গ্রিসের লোকটি- এল গ্রেকো ।
হিস্পানিক রেনেসা প্রধান স্থপতি পেইন্টিং, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যে নবজাগরণ সৃষ্টিকারী এই শিল্পী কোনো ছদ্মনাম চাননি। তবুও তিনি হয়ে উঠলেন এল গ্রেকো নামে ষোড়শ শতকের অন্যতম প্রধান শিল্পী। এই শিল্পীকে সম্মান জানাতে পিকাসো এঁকেছেন ' পোর্ট্রেট অব অ্যা পেইন্টার আফটার এল গ্রেকো'।
ক্ষুদে রং কারিগর
ইতালির বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী তিনতরোত্তোর নাম তার বাবামা তিনতরেত্তো রাখেনি। এমন নাম রাখার কথাও নয়। আর শিল্পী নাম বদলে নিজেকে তিনতরেত্তো নামে পরিচিত করাবেন- এটাও মেনে নেওয়ার মতো নয়। ১৫৫৮ সালে তার জন্ম, ইতালির ভেনিসের তুসকানিতে, নাম জ্যাকোপা কমিন। বাবা জিওভান্নি কমিন পেশাগতভাবে ছিলেন তিনতরে--কাপড় রং করার কারিগর। জিওভান্নি সিল্কের কাপড়ে রঙ করতেন। একুশ সন্তানের সবচেয়ে বড়টি ছোটবেলা থেকে বাবাকে রঙের কাজে সাহায্য করতেন। এটা কে? এ প্রশ্নের জবাব ছিল রং কারিগরের ছেলে, মানে তিনতরের ছেলে।
তাকে বলা হতে থাকে তিনতরেত্তো--ছোট তিনতরে। জিওভান্নি দেখলো ছেলে রঙ নিয়ে ছবি এঁকে দেয়াল ভরে ফেলেছে। ছবিগুলো বেশ উঁচুমানের বলেই তার মনে হয়েছে। বাবা তখন তিনতরোত্তোকে শিল্পী টিশ্যানের অধীনে শিক্ষানবিসী করতে নিয়ে গেলেন। মাত্র দশ দিনের মাথায় টিশ্যান তিনতরেত্তোকে বিদায় করে দিলেন। কারো কারো মতে বালকের আঁকা ছবি দেখে টিশ্যান ঘাবড়ে গিয়েছিলেন-- তাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে এই বালক তিনতরেত্তো, সুতরাং তাকে প্রত্যাখ্যান করতেই হলো। তিনতরেত্তোই বিশ্বে পরিচিত নাম, জ্যাকোপা কমিনের নাম তলিয়ে গেছে। তিনতরেত্তো প্রমাণ করলেন তিনি টিশ্যানের চেয়ে কমকিছু নন।
পুরুষের পোশাকে
জর্জ স্যান্ড নিশ্চয়ই কোনো ইংলিশ আমেরিকান বা অস্ট্রেলিয়ান কোনো পুরুষ হবার কথা। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী আফ্রিকানও হতে পারেন। কিন্তু কথাসাহিত্যের জগতের জর্জ স্যান্ড একজন ফরাসি নারী, নাম আমান্তিনে লুসিলে অরোরা দুপে। জন্ম জুলাই ১৮০৪, মৃত্যু ৮ জুন ১৮৭৬। জীবদ্দশায় জর্জ স্যান্ড ছিলেন ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকদের অন্যতম। এমনকি ইংল্যান্ডে তিনি ভিক্টর হুগো এবং বালজাকের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। অল্প বয়সেই একই সঙ্গে ভালো লেখক এবং জনপ্রিয় লেখক হিসেবে অনেক জ্যেষ্ঠ লেখককে ডিঙ্গিয়ে যান। বালজাক, ফ্লুবেয়র তার প্রশংসা করলেও তার সমকালীন কবি শার্ল বোদলেয়র তার সম্পর্কে খুব বাজে ধরনের নিন্দা করেছেন।
১৯ শতকের প্যারিসে পুরুষের পোশাক পরে জনসমাগমস্থলে আগমন ছিল অবাঞ্ছিত একটি বিষয়। তারপরও কাউকে পুরুষের পোশাক পরতে হলে পুলিশের পারমিট গ্রহণ করতে হতো। স্বাস্থ্য, পেশা ও ক্রীড়া যেমন ঘোড়দৌড় ও যৌক্তিক কোনো কারণে পারমিটের আবেদন করা যেত। কিন্তু জর্জ স্যান্ডস কোনো পারমিট না নিয়েই পুরুষের পোশাকে ঘুরে বেড়াতেন। তার যুক্তি : পুরুষের পোশাকের দাম কম, বেশি টেকসই, এবং চলাচলের জন্য সুবিধেজনক।
জনসমক্ষে সিগারেট ফুকেও যথেষ্ট নিন্দেমন্দ শুনেছেন। বিবাহিত থাকা অবস্থায় তার চেয়ে ৭ বছরের কমবয়সী জুলে স্যান্ড-এর সাথে মিলে জে স্যান্ড নাম নিয়ে 'রোজ অ্যান্ড ব্লাশ' রচনা করেন, বইটি খ্যাতি লাভ করে, জুলে স্যান্ড-এর সাথে সম্পর্ক শিথিল হয়ে গেলেও পুরুষ নামটি আরো খানিকটা মার্জিত করে জর্জ স্যান্ড নামে লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। তার যুক্তি পাঠক পুরুষের লেখা বেশি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। তিনি মনে করলেন সাহিত্যে স্থান করে নিতে হলে পুরুষ নাম নিয়েই এগোতে হবে। ১৮৩২ সালে ইন্ডিয়ানা উপন্যাসে তিনি প্রথম জর্জ স্যান্ড হিসেবে আবির্ভূত হলেন।
পুরুষ নামে আরো নারী
নারীর পুরুষ নাম নিয়ে সাহিত্যে জয়জয়কার। তাহলে উল্টোটা কোনো হবে না? সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভের আগে সঙ্গোপনে নারী নামে অনেক পুরুষ লেখক লেখা ডাকযোগে সম্পাদনকে পাঠিয়েছেন। কেউ কেউ নারী নামে প্রকাশিতও হয়েছেন, শরৎচন্দ্র তাদের একজন।
একালের সফল আলজেরিয়ান ঔপন্যাসিক ইয়াসমিনা খাদ্রা স্বনামখ্যাত হবার পর জানা যায় লেখক আসলে পুরুষ, সেনাবাহিনীর মেজর, চাকরিজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই আশঙ্কা থেকে স্ত্রীর নামে প্রকাশিত হতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে এসে জানিয়ে দেন তিনিই ইয়াসমিনা, তার আসল নাম মোহাম্মদ মুলেসেজুল। ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদকে জড়ানোর পাশ্চাত্য প্রবণতার তিনি বিরোধী, তার কাছে এটা পশ্চিমে 'রিলিজোপ্যাথি।
'মিডল মার্চ' 'সাইলাস মার্নার' কিংবা 'দ্য মিল অন দ্য ফ্লস'এর মতো ধ্রুপদ উপন্যাস লিখেও ম্যারি অ্যান এভান্স হয়ে রইলেন জর্জ এলিয়েট।
ম্যারি অ্যান এভান্স (নভেম্বর ১৮১৯-মৃত্যু : ডিসেম্বর ১৮৮০), যখন লিখতে শুরু করেন তখন ব্রিটেনের অভিজাত নারী লেখকরা স্বনামেই লিখছেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশের রচনাই হালকা রোমান্স। তিনি মনে করলেন নারী নাম নিয়ে লিখলে পাঠক তার লেখাকে হালকা রোমান্স মনে করবে এবং গুরুত্বের সাথে নেবেন না। সুতরাং পুরুষ নাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন।
ম্যারি এভান্স এ পুরুষ নামটিকে মহিমান্বিত করেছেন।
চানক্যগণ ও চে গুয়েভারাগণ
প্রকৃত চানক্যের মৃত্যু হয়েছে খ্রিষ্ট জন্মের ২৮৩ বছর আগে পাটালিপুত্র নগরে। তার জন্ম তক্ষশীলা। ভারতীয় ম্যাকিয়াভেলি নামে খ্যাত এই চানক্য অর্থশাস্ত্র লিখে খ্যাতিম্যান। চানক্য যতটা না বুদ্ধিমান অর্থে ব্যবহৃত হয় তার চেয়ে বেশি ব্যবহার ধুরন্ধর অর্থে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলার নেহেরু নিজের বুদ্ধিমত্তার সাথে সঙ্গতি রেখেই লেখালেখির জন্য চানক্য নামটি বেছে নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে রাজনীতিবিদ ও লেখক এমন আরো যারা ছদ্মনাম নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন, হার্বার্ট আর্নস্ট কার্ল ফ্রাম--তিনি উইলি ব্রান্ডট নামে খ্যাত, জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন। তার আত্মজীবনীর শুরুটা অসাধারণ। তার মা ছিলেন বন্দরের যৌনকর্মী-- 'বন্দরে কতলোক যায়, আসে। কিন্তু কোন লোকটি যে আমার বাবা তা আমার মাও সনাক্ত করতে পারেননি।'
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ তিনিই ভ্লাদিমির লেনিন। লেভ দাভিদোভিচ ব্রনস্টেইন হচ্ছেন লিওন ট্রটস্কি। ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজনীতিতে যথেষ্ট বিতর্কিত, ব্যক্তিজীবনেও, তার কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও আছে, তিনি জন ব্যারন, জন মিলার এবং ডেভিড ডেনিসন ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। চিয়াং কাইশেক নিয়েছেন জিয়াঙ্গ জেসি ছদ্মনাম, নগুয়েন সিন চাঙ্গই হলেন হো চি মিন। তার কবিতা বাংলায় অনূদিত হয়েছে।
আর্নেস্তো র্যাফায়েল গুয়েভারা ডে লা সার্না-ই একদা পৃথিবীর তারুণ্যের রোল মডেল চে গুয়েভারা।
কেনো এই ছদ্মনাম
শুধু ছদ্মনাম গ্রহণই নয়, ছদ্মবেশও ধরেছিলেন মহাভারতের পঞ্চপান্ডব। দ্রৌপদীও সাথে ছিলেন। অজ্ঞাতনামে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন কঙ্ক ছদ্মনাম, হয়েছিলেন রাজসভায় সভাসদ। ভিন্ন নাম নিয়েছিলেন বল্লভ, তিনি হয়েছিলেন রান্না ঘরের পাচক; অর্জুন হয়ে গেলেন বৃহন্নলা এবং তিনি হলেন রাজকন্যা উত্তরার গানের ওস্তাদ, মহাদেব গ্রন্থিক নাম নিয়ে রাজার অশ্বশালার নিয়ন্ত্রক। দ্রৌপদী নাম নিলেন সৌরন্ধ্রী, তিনি হলেন বিরাটরাজের স্ত্রী সুদেষ্ণার পরিচারিকা।
কাজেই এক কথায় বলা যায় আত্মগোপনের জন্য, নিজেকে আড়াল করার জন্যই ছদ্মনাম। লেখকদের বেলাতেও তাই, সাথে আরো অনেক কারণ যা লেখকরা বলে থাকেন।
ক. বিব্রতকর অবস্থা এড়ানো যায়
খ. ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ে
গ. সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লিখতে সুবিধে হয়
ঘ. আমার নামটা পুরোনো ধাচের, আনস্মার্ট
ঙ. আমার প্রকৃত নামের বানান ও উচ্চারণ কঠিন
চ. বাজারজাত করার জন্য সুন্দর একটা নাম চাই
ছ. একই নামের আরো একজন লেখক আছেন
জ. আমি বুঝতে দিতে চাই না যে আমি নারী
ঝ. আমি বুঝতে দিতে চাই না যে আমি পুরুষ
ট. একই লেখকের বই পাঠক একাধিক কিনতে চায় না, তাই
ঠ. আমার বাবা/স্ত্রী/স্বামী/অফিসের বস যাতে বুঝতে না পারেন এটা আমারই লেখা
ড. আমি বিভিন্ন শাখায় আলাদাভাবে পরিচিত হতে চাই।
কুৎসা রটাতে ছদ্মনাম
ভারতবর্ষে ছাপার হরফে ছদ্মনাম লেখার সূচনাটি তেমন শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে জেমস হিকির সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বেঙ্গল গ্যাজেট। এই পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন, নাম জুনিয়রস। ' লেটার্স অব জুনিয়রস' কলামে এই লেখকের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা। কুৎসার সাহিত্য এতটা নিচে নেমে যায় যে, বড়লাট হেস্টিংস দু'বছর পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। অনেকেই মনে করেন, কুৎসামোদী এই লেখক হচ্ছে স্যার ফ্র্যান্সিস ফিলিপ।
ব্যবহারিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনে লেখক ছদ্মনাম গ্রহণ করে থাকেন। ছদ্মনামের প্রধান সুবিধা, নিজেকে আড়াল করে রাখা, কিন্তু খ্যাতি বেড়ে গেলে আর অন্তরালবাসী থাকা হয়ে ওঠে না। লেখালেখির মাঝপথে নাম বদলে ছদ্মনাম ধারণ করাটাকে 'রিব্র্যান্ডিং' বলা যেতে পারে। সমস্যা একটাই-এতে নামই বদলায় খোলনলচে বদলানো হয়ে ওঠে না। নাম বদলে মেধা ও সৃজনশীলতায় রাতারাতি তুঙ্গে উঠে যাবে মনে করার কারণ নেই। বস্তুত অন্তরালবর্তী হওয়ার জন্য নয়, বাজারে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যই একালের লেখকরা নাম বদল করে থাকেন। 'শুড এ রাইটার অ্যাডপ্ট পেন নেম' শীর্ষক একটি রচনায় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে : একটি অ্যাকশন থ্রিলারের নাম যদি হয় 'রিভার্স অব ব্লাড' এবং গ্রন্থকার যদি হন মারে ফিশবাইন্ডার কিংবা ট্যাঙ্ক ম্যাকথান্ডার, তাহলে দ্বিতীয় নামটিই বাজারে বেশি সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে। একটি ভালো ছদ্মনাম প্রকাশকের জন্য বই বাজারজাত করার একটি উত্তম হাতিয়ার। নাম গ্রহণে দুর্বলতা প্রকাশনাকেই প্রভাবিত করে।
সৃজনশীল লেখকের সঙ্গে রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গগুলোর একটি সাংঘর্ষিক হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়েই ছদ্মনামে কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করা ও গালাগাল দেওয়ার নাজির রয়েছে।
পারিবারিক প্রয়োজনেও ছদ্মনাম কখনও কখনও অনিবার্য হয়ে ওঠে। সিলভিয়া প্লাথ তার 'দ্য বেল জার' উপন্যাসটি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রন্থ ছিলেন। তার মনে হয়েছে, এটি প্রকাশিত হলে তার মা কষ্ট পেতে পারেন। সুতরাং তিনি ভিন্নপথ ধরলেন। 'দ্য বেল জারে'র প্রথম সংস্করণে লেখকের নাম ভিক্টোরিয়া লুকাস।
'এনিমেল ফার্ম, 'নাইটিন এইটটি ফোর'খ্যাত লেখক ধরেই নিলেন, প্রকাশিত হলেই কিছু লোক তার পেছনে লাগবে। তাকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে। সুতরাং এরিক আর্থার ব্লেয়ার নতুন নাম নিলেন জর্জ অরওয়েল।
ফাঁপা সমাজ ও সমাজের মুখোশ আঁটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে বিদ্রুপাত্মাক লেখা শেষ করার পর লেখকের মনে হলো, আড়ালে থাকাটাই তার জন্য নিরাপদ। অতএব ফ্রাঁসোয়া-মারি অরওয়ে নিজের নামকে লুকিয়ে ফেলে আবির্ভূত হলেন ভলতেয়ার হিসেবে। দিনবদলের লেখক ভলতেয়ারের নাম এতই জনপ্রিয়, এটা যে ছদ্মনাম হতে পারে, তাও অনেকে মনে করেন না।
সমালোচক ও প্রকাশকদের আচরণ পরীক্ষা করার জন্য নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী ডোরিস লেসিং তার দুটি পাণ্ডুলিপিতে লেখকের নাম দিলেন জেইন সোমার্স। তার পাণ্ডুলিপি কয়েক জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পরে, জেইন সোমার্সের নামেই প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে ডোরিস লেসিং লিখেছেন 'নতুন লেখকের ভোগান্তি'। অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক ষ্টিফেন কিংয়ের ৭টি উপন্যাসের লেখকের নাম রিচার্ড বাখম্যান। এক্ষত্রে প্রকাশকদের একটি ব্যাখ্যা আছে ষ্টিফেন কিং জেমস মিশেনার, আর্ল স্ট্যানলে গার্ডনার ও ম্যারিও পুজোর মতো লেখকদের বছরে একাধিক বই প্রকাশিত হয়; কিন্তু যদি একজন লেখকের একটি বই কেনার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে একাধিক বই নিয়ে প্রকাশককে সমস্যায় পড়তে হবে। কাজেই ভিন্ন একটা নাম থাকলে ক্ষতি নেই; তবে সে নামটির জনপ্রিয়তা না থাকলে লেখক ও প্রকাশক উভয়ের বইয়ের বাজারে মার খাবেন। রিচার্ড বাখম্যানের হরর উপন্যাস যখন প্রকাশিত হতে শুরু করে, কারণ তাদের মনে হয় এই লেখক ষ্টিফেন কিংকে নকল করে লেখেন। এক সময় প্রকাশককে স্বীকার করতে হয়, দু'জনই এক ব্যক্তি।
গণিতজ্ঞ ও ফ্যান্টাসি ধারার লেখক হিসেবে চার্লস ডজসন সুপরিচিত ছিলেন, কিন্তু এলিস সিরিজের বই লেখার সময় তিনি হয়ে গেলেন লুই ক্যারল। 'এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড', 'এলিস থ্রু লুকিং গ্লাস' পৃথিবীর প্রায় সব সচল ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সি এন লিউইস স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক; কিন্তু দুটি কাব্যগ্রন্থ স্পিরিটস অব বন্ডেজ এবং ডাইমার ছেপেছেন জনৈক ক্লাইভ হ্যামিল্টনের নামে।
AE (ইংরেজি হরফ A ও E এর সংযুক্তি) নামে খ্যাত ছিলেন আইরিশ কবি ও থিওসোফিস্ট জর্জ ইউলিয়াম রাসেল (১৮৬৭-১৯৩৫)। রোমেইন গ্যারি ও এমিল আয়ার-দু'জন ফরাসি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার 'গোকুর' পেয়েছেন। দু'জন একই ব্যক্তি। এমিল আয়ার ছদ্মনাম। একই সঙ্গে মূল নাম ও ছদ্মনামকে মহিমান্বিত করার নজির খুব বেশি নেই।
ব্রন্টি ভগ্নিদের তিনজনই ছদ্মনামে লিখেছেন অ্যান ব্রন্টি (অ্যাস্টন বেল), শার্লট ব্রন্টি (কিউরার বেল) এবং এমিলি ব্রন্টি (এলিস বেল); কিন্তু শালর্ট ও এমিলি শেষ পর্যন্ত কীর্তিমান নিজ নামেই। 'রিপভ্যান উইঙ্কল'-এর লেখক ওয়াশিংটন আরভিং লিখেছেন জিওফ্রে ক্র্যায়ন নামে। বিংশ শতকের সুররিয়েলিস্ট কবি পল এলুয়ারের প্রকৃত নাম ইউজিন গ্রিন্দেল। আইজ্যাক আসিমভ লিখেছেন পল ফ্রেঞ্চ নামে।
ছোটগল্পের আমেরিকান অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ও'হেনরি হচ্ছেন উইলিয়াম সিডনি পোর্টার। বিংশ শতকের দু'জন অন্যতম চায়নিজ সাহিত্যিক লু শুন এবং মাও দুন ছদ্মনামেই খ্যাত। লু শুন হচ্ছেন ঝাও সুরেন এবং মাও দুন হচ্ছেন শেন ডেয়ং। ১৯৪৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের প্রকৃত নামে ৪২টি অক্ষর এবং ছোট-বড় মিলিয়ে ৯টি শব্দ। ১৯৭১ সালের নোবেল বিজয়ী কবি পাবলো নেরুদার পিতৃপ্রদত্ত নামটিও বেশ দীর্ঘ। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগের ব্রিটিশ লেখকের Q (কিউ ) মূল নাম আর্থার কুইলার-কোচ। বিদ্রুপাত্মক লেখনীর জন্য খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক 'সাকি' হচ্ছেন হেক্টর হিউ মনরো। বিখ্যাত ললিতার ঔপন্যাসিক ভ্লাদিমির নভোকভ সিরিন ও ভ্লাদিমির সিরিন নামে লিখেছেন।
রবিনসন ক্রুসোর জন্য অমর গল্পকার ড্যানিয়েল ডেফো নিজ নামে সেকালের খ্যাতিমানদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে অনেক শত্রুর মোকাবেলা করেছেন। পরে অ্যান্ড্রু মর্টন, টি টেইলর, মার্চেন্ট ও আই উইটনেস নামে তার বিদ্রুপচর্চা চালিয়ে গেছেন। জেল খাটা এবং ফ্রান্স থেকে নির্বাসিত হওয়ার হুমকির পরই ভলতেয়ার নামের জাঁদরেল সেই লেখকের অভ্যুদয় ঘটে।
ছদ্মনামের অসুবিধা
ছদ্মনামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকায় লেখক সম্মানীর চেকটি প্রকৃত নামেই গ্রহণ করতে হয়। এভাবেই এক সময় জানাজানি হয়ে যায় ছদ্মনামধারী আসলে কে। দ্বৈতসত্তাকে একই সঙ্গে টিকিয়ে রাখা প্রতিভাধরের সংখ্যা ভাগ্যিস তেমন বেশি নয়। নতুবা ইন্টারিভিউ বোর্ডে প্রশ্নের সংখ্যা বেড়ে যেত।
অ্যাডামের নাম যদি ইভ হতো এবং ইভ হতেন অ্যাডাম, তাহলে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট শুনলে হয়তো চোখের সামনে ভেসে উঠত শক্তিমত্ত সুন্দরী এক নারীর ছবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটি হয়তো কোনো গৃহবধূকে মানাত, আব্রাহাম লিংকন হয়ে উঠতেন স্তনবন্ধনী বাজারজাত করার জন্য খ্যাতিমান কোনো পোশাক কোম্পানির মডেল, এডলফ হিটলারের নাম হতো পার্বতী, মুসোলিনী হতেন মেরিলিন মনরো, রিচার্ড বার্টন হতেন নূরজাহান আর শেক্সপিয়রের নাম হতো ফ্লোরেন্স নাইটঙ্গেল। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নামেরও ম্যাসকুলিন ও ফ্যামিনিন সৃষ্টি করা হয়েছে। সেজন্য আব্রাহাম পুরুষ নাম (হিব্রুতে আব্রাহাম মানে বহু সংখ্যাকের পিতা) স্যামসন পুরুষ নাম (মানে সূর্য) এবং শার্লিং স্ত্রী নাম (মানে উজ্জ্বল সবুজ মাঠ)।
লেখালেখির শুরুতে নারী নাম ধারণ করে শরৎচন্দ্র লেখা পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশে অনেক পুরুষ নারী নামে 'বেগম' সাপ্তাহিকীতে লেখা পাঠিয়েছেন, কারও কারও লেখা ছাপাও হয়েছে, কিন্তু একটা সময় ছিল, সন্তান ছাড়া নারী অন্য কিছু সৃষ্টি করবে-এটা এমনকি ইউরোপেও ভাবা যেত না। 'মিডলমার্চ'-এর মতো অনবদ্য সৃষ্টির পরও ম্যারি অ্যান এভান্স জর্জ এলিয়ট হয়েই রইলেন।
একেবারে কাছাকাছি সময়ের ঘটনা। থ্রিলার ঔপন্যাসিক নোরা রবার্টসন নিজের নামেই পরিচিত। তার 'ব্ল্যাক হিলস' নামের উপন্যাসটির পাঁচ লক্ষাধিক কপি এক বছরে বিক্রি হয়। এবার তিনি ডেজি রব নাম নিয়ে বাজারে একটি থ্রিলার ছাড়লেন। হার্ডকভার ও পেপারব্যাক মিলিয়ে একই সময়ে ডেজি রবের বই-বিক্রি হলো ১৩ লাখ কপি। তিনি বললেন, লুকোচুরির কিছু নেই, আমারই লেখা। কিন্তু পুরষ নাম নিয়ে প্রকাশিত বইটির কাটতি বেশি। রব নামটি নিশ্চয়ই নোরার চেয়ে ভালো শোনায় না। তারপরও হয়তো পুরুষ নামের কারণে কাটতি বেশি হয়েছে।
'জেন আয়ার' উপন্যাসখ্যাত শার্লট ব্রন্টি ও তার অন্য দু'বোনও লেখালেখির জন্য পুরুষ নাম নিয়েছিলেন। ক্যারন ব্লিক্সলেনের বাণিজ্যফল গ্রন্থ 'আউট অব আফ্রিকা'র প্রথম সংস্করণে ছিল পুরুষ লেখকের নাম আইজাক ভিনসেন।
মেরি শেলির 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' উপন্যাসটিতে প্রথম লেখকের নামই ছাপা হয়নি। সবাই অজ্ঞাত একজন পুরুষকেই এ চমৎকার রচনাটির লেখক মনে করেছিলেন। জেমস ট্রিপট্রি জুনিয়র (১৯১৫-১৯৮৭) যে একজন নারী হতে পারেন, এটিও তার পাঠকদের জানা ছিল না। মৃত্যুর পরই প্রায় সবাই জেনেছেন তিনি এলিস ব্র্যাডলে। এলিস মেরি নর্টন (১৯১২-২০০৫) লিখতেন আদ্রে জর্টন নামে। বিংশ শতকে এমনকি একবিংশ শতকেও যে পুরুষ নামের আশ্রয় লাভজনক, এটি প্রমাণ করে নারীর অগ্রগতি এখনও তেমন হয়নি। পিতৃতান্ত্রিকতার বাঁধটি রয়েই গেছে।
সপ্তদশ শতকের লেখক মার্ক রিড মূলত মেরি রিড। তিনি পুরুষ নামে লিখতেন এবং শেষদিকে পুরুষের একটি দুর্ধর্ষ পেশাকেই বেছে নিয়েছিলেন-তিনি জলদস্যু হয়েছিলেন।
হ্যারি পটার সিরিজ লিখে জগত বিখ্যাত জেকে রাউলিং। কিন্তু তিনিও ছদ্মনাম গ্রহণ করেছেন। তার ভাষ্য: 'আমার বরাবর পছন্দ ছিল গোয়েন্দা উপন্যাস। আগাথা ক্রিস্টি, রুথ র্যান্ডেল, মারজারি অ্যালিংহাম এবং পিডি জেমস, আমি এদের সবাইকে ভালোবাসি।তাই আমারও ইচ্ছে হলো এই সময়রে পটভূমিকায় গোয়েন্দা উপন্যাস লেখার।' আর এখানেই গোয়েন্দা উপন্যাসে জেকে রাউলিং হয়ে গেলেন রবার্ট গল ব্রেইথ। এটি একটি পুরুষ নাম।
পাদটীকা :
এই নিবন্ধের লেখক আন্দালিব রাশদীর অনেকদিন আগের একটি কিশোর গল্পের নাম স্পনডিলোসিস। ঢাকা শহরে যারা গলায় নেক কলার বেধে চলাফেরা করেন, তারা বলেন, তাদের স্পন্ডিলাইটিস হয়েছে। কিন্তু গল্পের ভূত বলে, মিথ্যে কথা, ভূত তাদের ঘাড় মটকে দিয়েছে। সেই ভূত আন্দালিব রাশদীকে দেখে নাক সিটকে বলল, তোর যা চেহারা তাতে তোর নাম আন্দালিব রাশদী হবার কথা নয়। তোর থাকার কথা আবদুল টাইপের একটা নাম। যাকগে তোর বাবা আর মায়ের নাম বল।
বাবা আ ফ ম আবদুল মোতালেব, মা জাহানারা বেগম।
ভূত বলল, তা হলে আন্দালিব আর রাশদী এলো কোথেকে? এই নাম তোর বাবা মা জানেন? কুপুত্র কোথাকার বলেই ঘাড়টা মটকে দিল। তারপর অনেকদিন আন্দালিব রাশদী নেক কলার বেঁধেছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেছে স্পন্ডিলাইটিস। আ ফ ম আবদুল মোতালেব জীবদ্দশায় জেনে যাননি যে তারই জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম আন্দালিব রাশদী।