রশিদ শিল্পকর্তার লগে চিন পরিচয়
এক শিল্প সর্বস্ব জীবন বলতে যা বুঝায় তা শিল্পী রশিদ চৌধুরীর আরাধ্য ছিল বলাই যায়। কত শুনেছি তাঁকে নিয়ে, কবি বেলাল চৌধুরী, মীজানুর রহমান, শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক, জুনাবুল ইসলাম, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, হাসি চক্রবর্তী, মুহম্মদ মহসিন, রফিকুল আলম, মতলুব আলী, প্রণবরঞ্জন রায়, জুলফিকার চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সহ তাঁর কাছের দূরের অনেকের কাছে।
রশিদকে ছানি না পড়া চোখেও চাক্ষুষ দেখতে অপারগ হলাম, তাই বলে তা আমার অক্ষমতা? না, আমি তাঁকে কস্মিনকালেও সাক্ষাৎ দেখি নাই। ফলে তাঁর চেনা শুদ্ধ অবয়ব নির্মাণের দায় নেই। বিপরীতে তাঁকে দেখার আদলে অদেখা বহুধা নির্মাণের পুরোধা হিসেবে হাজির হতে দেখি। নানা বিভঙ্গে। বাংলাদেশের গত ৭৩ বছরের চারুকলার ইতিহাসের আমিও গত ৩৫ বছরের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী, পাইলে পাইতে পারি যৎসামান্য অংশীদারিও। তথাপি আমার হিস্যা নিয়ে আমি সরব হতে গিয়ে নিজেকে মৌরুসি দাবির অধিক ভাবতে কুন্ঠিত হই। সেসব কুন্ঠা মাড়িয়ে এই এজমালি ইতিহাসের থান বুনতে গিয়ে পোড়েনের রকমফের হতে পারে! হোক, সে আমার পোড়েন। যেখানে কিছু সংবেদন- ইঙ্গিত -রসদ ইত্যাদি জারি হইলো জবান খোলাসা করার তাগিদে। এই মর্মে কথাসক্কল কওনের জন্য ইজাজত চাইতেছি।
রশিদ আমাগো কে হন? প্যারিসের বিখ্যাত শিল্প শিক্ষালয় থেকে পাঠ নিয়ে আন্তর্জাতিক শিল্পভাষার নতুন ভাবের, অভিপ্রায়ের আর ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞার উপযুক্ত কইরা তুলতে মতাদর্শিক নেতৃত্বে হুট্ কইরা কিন্তু তিনি আসেন নাই। এই আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হইছিলো ঢাকা আর প্যারিসে! তারপর তো নয়া ইতিহাসের পাতা লেখা হইতে থাকে। জ্ঞানের নবতর সামর্থ্য আর বলি নয়া জমানার মুকাবিলার জন্য সমাজের বাসনা রহস্য ঠাহর করবার জন্য শিল্পশাস্ত্রকে নয়া তর্জমায় দাঁড় করাইয়া দেন। কেননা তিনি জানতেন ভবিষ্যৎকে তো তাহাই স্বপ্রাণ অস্তিত্ববান কইরা তুলতে কাজে লাগবে- ভাবে-ভাষায়, আকারে-আদলে।
গত শতকের মধ্য আশিতে আমার মামা এক শীত সকালে চট্টগ্রামের ওয়াসা মোড়, দামপাড়া, চট্টেশ্বরী রোড হয়ে বাদশামিয়া সড়কের গন্তব্যের রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন শিল্পী রশিদ চৌধুরীর কথাও। কিন্তু এ পর্যন্তই। যখন তাঁকে চিনবার দেখবার মতো সুযোগ হলো তখনই সব সুযোগ সম্ভাবনারে অসম্ভবের কাতারে রাইখা তিনি গত হইলেন। তবে একদিন এই রশিদ যে দায়িত্ব নিয়া আমার পরের চলার পথ বাৎলাইবেন তা গোচর হওয়ার কথা না সেই সবে শুরু হওয়া চারুশ্রমণকালে।
দেখি তাঁর অনিবার্য অবয়ব
চারুকলায় 'বর্ণপাঠ' যে বছর শুরু হল সেটা ১৯৮৬ সাল, রশিদ সেই বছরেই পরলোকে যাত্রা করেন। তার আগে ৬৮ সালে তিনি যখন ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরেন সেই বছরে আমার জন্ম। শুরু ও শেষের এ কেমন যোগ? ৬৮ থেকে ৮৬ আমি জানিনা রশিদ কে ছিলেন, কি তার মাহাত্ম্য! কিন্তু সেই যে বীজ রোপিত হলো রশিদের স্বপ্নের বীজতলায় সেখান থেকে অংকুরিত হচ্ছে চারাগাছেরা, কত বিচিত্র পত্র পল্লবের! ক্রমেই আলোর ইশারারূপে তিনি বাতিঘর হয়ে উঠেন। শুরুতে সঙ্গে থাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমুদ্রের স্বাদ, জীবনানন্দ দাশের বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুনশ্চঃ কাব্যের বাঁশি কবিতা, অবন ঠাকুরের সুন্দর অসুন্দর। সাথে শিল্পকলার ইতিহাস, ইংরেজি ও সমাজতত্ব।
`আমার হাতে একটি
রঙপেন্সিল
যা দিয়ে কেবল স্বপ্ন আঁকা যায়`১
'গত তিরিশ বছরে অর্থাৎ যেদিন থেকে ট্যাপেস্ট্রির সাথে আমার আলিঙ্গন, সেদিন থেকে একটি বেদনা ক্রমশঃই বেড়েছে। সেই যে আতুড় ঘরে এই শিল্প মাধ্যমটি বালাই আক্রান্ত হলো তার আর মুক্তি হলো না বলে! আমরা তাঁর শুরু করে যাওয়া শিল্প মাধ্যমটিকে যত্ন-আত্মি করতে চেয়েছি হয়তো অনেকটাই বিমাতৃত্বের ছলে। রশীদ চৌধুরীর কর্ম তথা সৃষ্টি চেতনার ধারাবাহিক উন্মেষ একটি সচেতন প্রক্রিয়া। একজন সৃজক তাঁর বিশ্বাস, চেতনা আর উপলব্দিতে জারিত হন লাবন্যে ও নিশ্চিত ছন্দে। আমার অন্বেষন তাঁর সময়, প্রেক্ষাপট সর্বোপরি কেমন করে গ্রামের ধুলো মাখা শৈশব ডিঙ্গিয়ে চেতনার রঙে রাঙিয়ে নেন নিজের জীবন আর লালিত্য ভরা চিত্রপট। শিল্পের স্থির নিশ্চিত লক্ষ্যে প্রাগ্রসর এ কর্মমুখরতা উত্তর প্রজন্মের জন্য অনুসরনীয় কেন্দ্রবিন্দু। আর সেই বিন্দুকে কেন্দ্র করেই আমার যাত্রা। যা একজন 'বুনকর' এর টানা-পোড়েনের মিশেলে, নকশার পরতে পরতে যে জমিন ফুলছাপ জামদানী শাড়ির আঁচলের মতোন ধারাবাহিক বিন্যাসে ব্যপ্ত।'২
গত শতাব্দীর ৯০ সাল, ঢাকা চারুকলায় বিদ্যার্থী, শিল্পের প্রকাশ মাধ্যমের খোঁজে হন্য তখন। চিনে নেবার কোশেশ সৃষ্টির চারপাশ-দৃষ্টিকে যা প্রসারিত করবে, বীক্ষণ বিস্তৃত করবে পরম মমতায়। তখনকার শহর যাপন, স্পন্দন ও তার যাবতীয় অস্থিরতা অনুভব করে আবেগে যখন টলমল তখন রশিদের ট্যাপেস্ট্রি অস্থির আবেগে সংহতি এনে দেয়। তারপর একসময় জানা হয়ে গিয়েছিল যে, তাঁত বয়নের সংবেদনশীল মন 'টুলো পন্ডিতের মাস্টারি'র ভার সইতে অপারগ, কেননা সে ক্ষেত্রে তথাকথিত শৃঙ্খলা শৃঙ্খল হয়ে উঠতে চায়। ফলে আমার রশিদ চিন পরিচয়ের নিখুঁত টানাপোড়েন। এই টানা পোড়েন সঙ্গত অনেকটা প্রথাগত শিল্পবুদ্ধি সঞ্জাত। এসব স্ব-কানুন, না কানুন, অর্থাৎ যতটা না কানুনে 'নিখুঁত খেউড়ি করা গাল আর আঁচড়ানো চুল' হয় ঠিক তার বিপরীত। যেসব বাংলার হাতের কারিগরি কৌশল, তার তুখোড় বয়ন, রঙে রেখায় টানটান, সবকিছুই যেন ব্যবহৃত আদিম নিজস্বতাকে উস্কে দেবার জন্য। রশিদ আশ্রমের স্ব-যাচিত অতিথি হয়ে আদল চিহ্নে রশিদের লগে চিন পরিচয় হয়। আদল বান্ধা পরে তাঁর শিল্প নিরঞ্জনে! বিরাজ করেন আত্মবোধ ও ভাবজগতের মাস্টার হয়ে।
চলতি শতকের গোড়ায় কেবল বঙ্গজ টানা পোড়েন জ্ঞান নিয়ে ইউরোপে অভিবাসী হলাম আচমকা। সঙ্গে রইলেন রশিদ তাঁর শিল্প অস্তিত্বের অনুভব হয়ে আমার বয়নসঙ্গতে। তাঁর অনুকরণ বা নকল নয়। মহীরুহের নকল মানে অক্ষমের অক্ষমতা। আদর্শের স্বার্থকতা, আদর্শ হয়ে যদি তা বিরাজ করে। রশিদ তো তেমনই আদর্শ! যে আদর্শ আদর্শ হইয়াই বিরাজিত। আদর্শের অনুকরণ না, অনুসরণ হয়।
আমার নিজস্ব 'আমি' আর শিল্পের মানুষের 'আমি'র কাছে সমাজ-কাল-প্রজ্ঞার রূপ তার প্রতিভূ স্বত্বা হিসেবে দুইয়ের সম্পর্ক ও ফারাক বিষয়ে টনটনে হুশ রেখেই রশিদীয় বোধ-বুদ্ধির উপযোগিতার সন্ধান আয়াস। সাধারণত কোন খ্যাতিমান লোক প্রয়াত হলে 'তিনি কত কাছের ও মহৎ লোক ছিলেন, আমি তার কত প্রিয় ছিলাম' প্রমানের কসরত দৃশ্যমান হয়। আর সেই দৃশ্যমানতার মধ্যে নানা বানানো গল্প প্রচ্ছন্ন থাকে। পরিষ্কার করে বললে সেইসব প্রচ্ছন্নতার মধ্যে আপাত নিরীহ বদ ইচ্ছা কার্যকরী থাকে। রশিদ নিয়েও তেমনটা যেমন আছে আবার অনালোচিত রাখবার ও অপচেষ্টা ছিল, আছে। এহেন ইচ্ছেকৃত চেষ্টা বিস্মরণের কর্মসূচিতে লুকিয়ে থাকে, প্রবর্ধিত হয়, যা বহুগুণে এক আত্মঘাতী প্রবণতা। যা নিরীহ বেখেয়াল নয় মোটেও। কম কথায় কাজ সারি, এই বাগ বিস্তারের প্রতি অপক্ষপাত আপনার পক্ষকে সুমিতি দান করলে করতেও পারে। তবে মরম কথা মরমে রেখে যা শোনাতে চাই পরম যত্নে সেইটুকু উস্কানি অনবদ্য ভোক্তার জন্য শ্রুশুষার আরক হইলে হোক, না হইলে ক্ষতি কি?
বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্দোলনের আলোচনায় শিল্পী রশিদ চৌধুরীর 'ম্রিয়মান' উপস্থিতি ধার্য্য রাখার অপচেষ্টাটা হয়তো নেহাত কতিপয়ের অস্তিত্ব সংকট মোকাবিলার আশংকা, ফলে বিবেকের অভাব তাড়িত এসব 'স্বসেবী'রা নিজের চরকাতেই তেল দিতে উদগ্রীব ছিলেন জনমভর। এখানে তাদের এসব গান্ডুলীলার কথা উল্লেখে হয়তো কাউকে কাউকে বিব্রত করতে পারে! তথাপি এসব আধখেঁচড়া বিব্রত কালের কথা হয়ে থাকুক না হয়।
রশিদ আমার অদেখা রাজ্যের মিথ হয়ে বসবাস করেন। তাঁর নজর বলয় এতো বিস্তৃত যে, তার বাইরে যাওয়ার 'এক্তিয়ার' সহজসাধ্য ছিল না। ট্যাপেস্ট্রির জগতে তাঁর নজরবন্দি মুন্সিয়ানা যে মোহনীয় বোধের ভাষ্য তৈরী করেছে তার লক্ষণ রেখার বাইরে দ্রষ্টব্য হতে গেলে বিশেষ এলেম থাকা চাই। তবে সেই এলেম রশিদকে পাশ কাটিয়ে নয়, হুবহু তাঁর শেখানো নামতায় ও নয়, তবে সে অংকের ফলাফল নিহিত থাকে শুদ্ধ সনাতন বয়ন গণিতের কায় কারবারের মত। তা দিয়েই আসবে টানা পোড়েনের যোগ বিয়োগ ভাগ ফলাফল। কেউ কেউ সানন্দে 'রশিদ ট্যাপেস্ট্রির তহবিল তছরুপের ওস্তাদি কাজে' পারঙ্গমতা সিদ্ধ করে নিয়েছে!! আমরা এসব দেখার তাপেও না দেখার ভান কইরা শিল্পবোধের জাবর কাটি!
শিল্পী রশিদ তাঁর যাপনকালে যেমন প্রতিনিধিত্বমূলক সৃজনকর্মের ঐশ্বর্যময় ভুবনের স্রষ্টা তেমনি পূর্ব ও উত্তরকালে উত্তরণ ও সিদ্ধি অর্জনে শিল্পকলা দৃশ্যপট পাল্টে দিতে অনুকূল হাওয়া বইয়ে দিতে তৎপর হয়েছিলেন তা সকলেরই কম বেশি জানা হইলেও এটুকু বলা সঙ্গত যে, তাঁর শিল্পী সংবেদ তাড়িত ব্যাকুলতা স্বপ্নময়তার দ্বান্দিকতায়। তাঁর সামনে ছিল স্থান ও কালের সঙ্গে নিজের শিল্পতৎপরতাকে সম্পৃক্ত করবার সংগ্রাম। সমকালীন যুগশিল্পী হয়ে ওঠার তৎপরতা। যা সমকালকে ছাড়িয়ে ভবিষ্যতবাদী সৃজন কল্পলোক এর প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। তাঁর সমকালে সহপাঠীদের কাউকেই কার্যত তাঁর সমধর্মী ভূমিকায় দেখা যায়নি। এই না পাওয়া যাওয়া অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু 'দায়' এড়াতে যারা অক্ষয় আলোর কৌটোয় চোখ সেঁধিয়ে দেখেন প্রাত্যহিকের 'বিপ্লবের স্তর' তারা সেখানে অন্ধকারের প্রলেপ দেখতে পান- অথচ রূপকথার কৌটোর মত সে চোখের মিছিলে আলো ছড়ায়, মায়া দিগন্তের অভ্যুদয়ের ইতিহাস তৈরী করে তা দেখেন না। তখন ছিল ইতিহাস সৃষ্টির পূর্বরাগ। বাংলার বুকে তখন সত্তুর দশকের রাজনৈতিক হিংসা, বোমা, খুন, তান্ডব, বিদ্রোহ, দখলের আখ্যান-উপাখ্যানের উপত্যকায় চট্টলার শিল্পের কুরুক্ষেত্রে তখন সুদূর প্রসারী পরিপ্রেক্ষিতের সামনে বুক চিতিয়ে যিনি দঁড়িয়ে যান তিনি বোধ উপনীত রশিদ স্বয়ং।
ঢাকায় শিল্পী জয়নুল প্রতিষ্ঠিত আর্ট কলেজে আর প্যারিসে শিল্পী রুডলফ জুলিয়ান প্রতিষ্ঠিত শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করে তিনিও দেশে উচ্চতর শিল্প শিক্ষা কার্যক্রম প্রসারে পথ নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের চিত্রকলার খতিয়ানে কৃতি বিবরণী দাখিল কেবল নয়, লক্ষ্যভ্রষ্ঠ ফ্রিল্যান্স অধ্যাপকীয় পার্টটাইম আর্টিস্টদের বেশিরভাগের উদ্দেশ্যহীন কুচকাওয়াজ এর ভিড় ঠেলে পুনঃবীক্ষণের আলোতে ঝার-মোছ করে নিতে হলে সেখানে এক উজ্বল উদ্ধার রশিদ। চট্টগ্রামের শিল্প গেরস্থালির ঐশ্বর্য তখন দেখার অপেক্ষা কেবল। শিল্পপাঠের টেকসই জমিন তৈরী আর কর্ষণের মুন্সিয়ানায় ভাবি শিষ্যকুলকে রশিদ সনাতনী নাজুক চাষবাসের কান্ড থেইকা সজ্ঞান সচেতন প্রয়াসে বাস্তব বোধের জমিতে দাঁড় করায়।
'শিল্পী তার মনটাকে পল কাটা হীরের মত প্রস্তুত করবেন। যা পৃথিবীর সমস্ত কোন থেকে আলো গ্রহণ করে নিজের অভ্যন্তরের কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে তা বিকিরিত করতে থাকে'। রশিদের ক্ষেত্রে তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়, রতনদিয়া থেকে ঢাকা, কলকাতা, স্পেনের মাদ্রিদ, ফ্রান্সের প্যারিস, যুক্তরাষ্ট্র আবার ফিরে আসা স্বদেশের চট্টগ্রামে - আলোর বিন্দুর কারবারি হয়ে। রাজধানীর 'অনূকূল' ছেড়ে চট্রগ্রামের 'প্রতিকূলে' এসে পৌঁছুলেন জয়নুল সৃষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক পঠন পাঠন এর চেয়ে অগ্রসর শিক্ষার সুযোগ তৈরির দায়িত্ব নিয়ে। রীলে রেস এর মত। জয়নুল সৃষ্ট শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পর তাঁর ভাবশিষ্য শিল্পের উচশিক্ষার অবকাঠামো তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। আমাদের আলোচ্য কনটেস্টে তিনিই বিবেকের চাবুক খেয়ে সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন, শিক্ষকের উছিলায়, প্রশিক্ষণের প্রচ্ছন্ন সম্পাদনে।
'জীবন কখনো জীবিতকে তুলোর বাক্সে শুইয়ে রাখে না, মারে আর কতটা আঘাতসহ হয়েছে তা পরখ করে দেখে নেয় প্রত্যহ'।৩
প্রতিকারহীন বঞ্চনা আর অন্তহীন প্রতারণার ঘা নিয়েই তিনি একসময় চট্টগ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন। এখানেও তিনি গুরু জয়নুলের অনুসারী। দায় এর প্রশ্ন এখানেও! তবে দায় এড়াতে না কি তা ছিল দায়বোধের আরেক প্রপঞ্চ? বর্তমানের অবক্ষয়ের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে আমরা কি এই দু:খবাদী প্রশ্নের কাছে আজ দায়বদ্ধ নই? আমাদের এতদ্বিষয়ে আলোচনা রুদ্র বাস্তবের আঁচে পুড়তে পুড়তে হলেও স্মৃতি খেকো বাঙালির স্বপ্ন-দোষের নিদ্রাঘরে কড়াঘাত করে প্রবেশাধিকার কনফার্ম করুক।
মানুষ কেবল তার আয়ুষ্কালেই বাঁচে না, কারো কারো বেঁচে বর্তে থাকা হয়তো কেবল বর্তমানে বলয়িত। আর এক পদের মানুষ বাঁচেন অনিবার্য বর্তমানে আর তার যোগসূত্রে অনাগত ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সীমাহীন আয়ুষ্কাল পকেটে পুড়ে। তেমনি একজন ক্ষণজন্মা শিল্পী রশিদ চৌধুরী। যিনি একার স্বার্থপর শিল্পযাত্রায় নয় সমষ্টির শিল্পপুরাণ পালার বিবেক হয়ে বেঁচে থাকেন।
মাত্র ৫৪ বসন্তের যাপন পরিধিতে রশিদের সাংগঠনিক সামর্থ্য ও সফলতা বিবেচনায় নিলে তাঁর সমসাময়িকদের যাপিত জীবনদৈর্ঘ্যের তুলনায় নি:সন্দেহে ঈর্ষা জাগানিয়া। আমাদের চেনা জানার মধ্যেই সন্তুষ্টির উন্মাদনার সিনড্রোম আক্রান্ত শিল্প সংশ্লিষ্টদের আকছার নানা বিশেষযোক্তি যখন আসলে 'থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়' তখন রশিদের জন্য গলা খাক্কারি দিয়ে কোন 'ক্লিশে বিশেষণের' প্রয়োজন অবান্তর।
শিল্পী রশিদ চৌধুরী, তাঁর চিত্রকল্পখচিত প্রস্বর গহন স্বভাবেরই উপহার হিসেবে আমাদের চিরচেনা পরমাত্মীয়জন হয়ে বেঁচে থাকেন! এই রশিদীয় আইকনই আমাদের সময়ে তাঁর পাসপোর্টের ছবি, প্রবেশাধিকারের ভিসা। তাঁর সর্বায়ত প্রকাশ শক্তি শিল্পের সাবলীল প্রক্রিয়াটুকুতে কেন্দ্রবদ্ধ হয়েছে, তাঁর আদল চিহ্ন যেন মিতাক্ষরে ঝুকে পড়ে বলে উঠে: এভাবেই `চিন পরিচয়` আঁকা থাক।
এ আমাগো রশিদ শিল্পকর্তার লগে চিন পরিচয় বা তর্কাতীত তর্পণ খায়েশ! জনারণ্যে লোপাট হয়ে যাওয়া থেকে তাঁর নির্মিতির গহন- গড়ন, ন্যায্যতা, আলোক-অনালোকের বয়ন, ইত্যকার আচ্ছন্ন গল্পের কুহক আমাদের আবিষ্ট করে আজও। আমরা চাইলে পষ্টাপষ্টি প্রত্যক্ষ করতে পারি সাল-সাকিন চিহ্নিত সিলমোহর সহ পোস্টাল এড্রেস। যে ঠিকানায় আমাদের গর্বের মৌরুসি বসত। প্রযত্নে থাকেন শিল্পী রশিদ চৌধুরী।
সেলাম শিল্পপথপ্রদর্শক।
১. জহর সেনমজুমদার, আমাদের টেলিফিল্ম, ত্বষ্টা, ১৯৯৬
২. মোহনএষণা- শফিকুল কবীর, অভিসন্দর্ভ, কলাভবন, শান্তিনিকেতন, ১৯৯৯
৩. শিল্পী গণেশ পাইন