রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
ইউটিলিটি সার্ভিস
একটা সময়ে আমাদের বিদ্যুতের মালিক ছিল 'পিডিবি', গ্যাসের 'তিতাস', পানির 'ওয়াসা', টেলিফোনের 'টিএন্ডটি', পার্সেলের 'পোস্ট অফিস', শহরের 'ডিআইটি' আর দেশের মালিক ছিল 'উত্তর পাড়া'। এখন বিদ্যুতের নানা কোম্পানি হয়ে নানা রকম ব্যাপার হয়ে গেছে। তখন নিয়মিতভাবে লম্বা সময়ের জন্য বিদ্যুৎ চলে যেত। সন্ধ্যার পরে বিদ্যুৎ চলে গেলে আমরা ছোটরা সবাই এক দৌড়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে যেতাম। অন্ধকারে ছুটোছুটি, গল্প করা, খেলা চলত। কোন কোন বাসার বড়রাও বাইরে এসে হাঁটাহাটি করতেন, গল্প করতেন। আবার বিদ্যুৎ আসলে সবাই এক দৌড়ে ঘরে ফিরতেন। তখন আমাদের মন খারাপ হত। ভাবতাম বিদ্যুতটা আর কিছুক্ষণ পরে আসলে কী ক্ষতি ছিল!
তখন প্রায়ই, বিশেষত ঝড়বাদলের দিনে বিভিন্ন বাসার বিদ্যুতের সংযোগের তার মূল বিতরণ লাইন থেকে কী করে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। সবাই বলতেন, পিডিবির অসাধু কর্মীরাই নাকি আলগা করে তার লাগাতেন। তাদের কথার হয়তো কিছুটা সত্যতা ছিল। কারণ অমন ঘটনায় পিডিবির লোকদের বহু সাধ্যসাধনা করে আনতে হত। তারা দুই চাকার অদ্ভুত ঠেলাগাড়িতে বিশাল এক বাঁশের মই নিয়ে হাজির হতেন। তারপর অনেক ক্ষেত্রে বখশিশের পরিমাণ নিয়ে রফা হলে বিদ্যুতের খাম্বাতে মই লাগিয়ে সংযোগ ঠিক করা হত। খাম্বা প্রথমে ছিল স্টিলের ট্যাপারাড সিলিন্ডার, পরে কংক্রিটের চারকোনা। পিডিবির কর্মীরা ভুক্তভোগীকে 'লাইন টেপ' নামের একটা জিনিস লাগানোর পরামর্শ দিতেন যেটা আবার তাদের কাছ থেকেই কিনতে হবে। লাইন টেপ লাগালে বড় জোর বছর খানেক সংযোগ ঠিক থাকত, তারপর আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেত। আমাদের পাড়ায় আমাদের বাসায় প্রথম মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ টানার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটা নিয়ে পিডিবির কর্মীরা আব্বুর সাথে ব্যাপক ঝামেলা করেছিল। আমাদের বাসার উলটো দিকের বাসার মালিকের পুত্র ছিলেন পিডিবির এঞ্জিনিয়ার। ফলে ঐ বাসায় বিচ্ছিন্ন সংযোগ সারাতে আসা পিডিবির কর্মীদের তারা বখশিশ দিতেন না। তাই আমাদের পাড়ায় কারো সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে পিডিবির কর্মীরা সহজে আসতে চাইতেন না, আগে নিশ্চিত হয়ে নিতেন কোন বাসায় সমস্যা।
তিতাস গ্যাসের সংযোগ নিয়ে এত ঝামেলা ছিল না। গ্যাসের প্রেসার না থাকার ব্যাপারও ছিল না। তখন ওয়াসার পানিও বাড়তি পাম্প ছাড়া দোতলার ছাদের ট্যাংকে চলে যেত। একবার কোন এক নেতা নাকি পোল্যান্ড থেকে বাতিল গ্যাস মিটারের চালান সস্তায় নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো তিতাসের গ্রাহকদের লাইনে বাধ্যতামূলকভাবে লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেসব মিটার সম্ভবত দুই মাসও চলেনি। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হবার পরে মিটার খুলে নিয়ে যাওয়া হয়। টিএন্ডটি'র ফোন নিয়ে কিছু বললাম না - মৃত মানুষের সমালোচনা করার ব্যাপারে আমাদের সংস্কৃতিতে নিষেধাজ্ঞা আছে।
সে আমলে পাড়ায় খুব কম বাসায় টিএন্ডটির ফোন ছিল। আমাদের বাসায় ফোনের সংযোগ পেতে দীর্ঘদিন সময় লেগেছিল। তাও লুব্রিকেশনের দরকার হয়েছিল। কেবল কিনে দিতে হয়েছিল। যে বাসায় টিএন্ডটির ফোন ছিল সেই বাসার প্রতিবেশিরা বাই ডিফল্ট সেটা ব্যবহারের অধিকারী হতেন। ফোন তখন দরকারের জিনিস ছিল, খাজুরে আলাপের জিনিস না। সবাই নিকটস্থ প্রতিবেশির ফোন নাম্বার অন্যদেরকে দিতেন। আমরাই অনেক আত্মীয়ের মৃত্যুর সংবাদ সিকদার বাড়ির ফোনের মাধ্যমে পেয়েছি।
খুব প্রচলন ছিল চিঠি লেখার। অল্প কথার জন্য পোস্টকার্ড, বেশি কথার জন্য খামেভরা চিঠি, বিদেশে পাঠানোর জন্য অ্যারোগ্রাম। বিদেশ থেকে ভারি চিঠি আসলে পোস্টম্যান বখশিশ দাবি করতেন। বেয়ারিং চিঠি বলে একটা ব্যাপার ছিল যেখানে প্রাপককে ডাক মাশুল শোধ করতে হতো। প্রবাসীরা ভিউ কার্ডের পেছনে ডাকটিকেট লাগিয়ে চিঠি পাঠাতেন।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি মতি কাকা দেশ ছেড়ে ক্যানাডাতে স্থায়ী হয়েছিলেন। তখন ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার আর ইংলিশের প্রফেসরেরা চাকুরি করতে সপরিবারে ইরান, ইরাক, লিবিয়া, উগান্ডা, জাম্বিয়া যেতেন। পড়ার জন্য বড়রা আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে যেতেন, তাও সপরিবারে। ব্যবসায়ীরা হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান যেতেন, সেটা একা একা। কেউ কেউ বেড়াতে যেতেন ভারতে, একা একা বা সপরিবারে। সেই প্রথম আমরা দেখলাম কেউ কাজ, পড়া, ব্যবসা বা বেড়ানোর বাইরে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। অটোয়া থেকে কাকা অমন ভিউ কার্ডের পেছনে চিঠি লিখে পাঠাতেন। আমরা সেসব ভিউ কার্ড জমাতাম। তারপরে এক সময় দেশেই ভিউ কার্ড ছাপা হতে লাগল – সুদৃশ্য, কুদৃশ্য, শ্লীল, অশ্লীল সব রকমের। সুবর্ণা মুস্তাফা – আফজাল হোসেন জুটি, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় – আফরোজা বানু জুটি, নায়ক রাজ রাজ্জাকের পরিবার, নায়ক জাফর ইকবালের পরিবার এমন ভিউ কার্ডগুলো সব বাসাতে ছিল।
স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা ডাকটিকেট, ভিউ কার্ড, কয়েন, ম্যাচবক্স, সিগারেটের প্যাকেট, চকলেট-ললিপপের মোড়ক জমাতো। বই বা স্টেশনারির দোকানে মঙ্গোলিয়া, ওমান, ডমানিকান রিপাবলিকের খুব সুন্দর বড় বড় ডাকটিকেট পাওয়া যেত। পরে জেনেছি ওগুলো সব স্থানীয়ভাবে ছাপানো। যারা কয়েন জমাতো তাদের সবার কাছে ইংল্যান্ডের পেনি আর ব্রিটিশ আমলের তামার ফুটো পয়সা থাকত। কারো কাছে এক ডলারের নোট থাকা মানে সে ব্যাপক 'বড়লোক'! এসব সংগ্রহ অন্যদেরকে দেখানোর ক্ষেত্রে একটা ভয় মেশানো গর্ব কাজ করত। ভয়ের কারণ হচ্ছে চুরি হয়ে যাওয়া। সবচে নিরীহ, ভদ্র ছেলেমেয়েটাও অবলীলায় অন্যের এসব সংগ্রহ থেকে চুরি করত। বড়রা জমাতেন বই, পেপার কাটিং, বিশেষ সংখ্যার পত্রিকা, গানের ক্যাসেট বা রেকর্ড, আরও পরে ভিডিও ক্যাসেট।
তখন পাড়ায় পাড়ায় রেশনের দোকান ছিল। সেখানে যা যা দেবার কথা ছিল বেশিরভাগ সময়ে সেগুলো পাওয়া যেত না। কারণটা খুব সরল, রেশনের জিনিস খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়া হতো। আমাদের রেশন কার্ডে যে সব জিনিসের নাম দেয়া ছিল সেখানে 'মিশ্রি' পর্যন্ত লেখা ছিল। দুনিয়ার কোন রেশনের দোকানে মিছ্রি দেয়া হয় এমনটা আমার ধারণায় আসে না। আমরা রেশনের দোকান থেকে সাধারণত কেবল গম আর চিনি নিতাম। সেই গম ধুয়ে, শুকিয়ে পাশের পাড়ার গম ভাঙানোর কলে ভাঙিয়ে আটা বানানো হতো। সেই আটা আবার চালুনিতে চেলে ভুষি আলাদা করা হতো। আরেক রকমের রেশনের দোকান ছিল ঢাকা ভেজিটেবল অয়েল কোম্পানির। সেখানে প্রতি মাসে কার্ডপ্রতি চার লিটার 'পোস্টম্যান' সয়াবিন তেল আর দুই কেজি বনস্পতি ঘি দেয়া হতো। বনস্পতি ঘিকে আমরা বলতাম 'ডালডা'। যেমন ঢাকা ভেজিটেবল অয়েল কোম্পানিকে সবাই 'ডালডা মিল' বলতাম। সত্যিকারের 'ডালডা' দেখেছি তার বহু বছর পরে।
আগে আমাদের বাসায় প্রায় সব রান্না হতো সরষের তেল দিয়ে, আর কিছু রান্না ঘি দিয়ে। প্রতি সপ্তাহে একজন লোক বাসায় সরষের তেল দিয়ে যেতেন। তার কাছে সয়াবিন তেলও ছিল, কিন্তু আমরা কিনতাম না। তখন উৎস নির্বিশেষে সব 'বনস্পতি' তেলকে আমরা 'পাম অয়েল' বলতাম, এবং সেই পাম অয়েলের দুর্গন্ধ আমাদের সহ্য হতো না। সরষের তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা আমরা সয়াবিন তেল খেতে অভ্যস্থ হই। তখনই তেল-ডালডার রেশন কার্ডটা করা হয়। 'কসকর' নামে ন্যায্য মূল্যের একটা দোকান ছিল যেটা বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে সম্ভবত ৩৬০ দিন বন্ধ থাকতো। কেন? কারণ জিনিসের সরবরাহ নেই। সেখান থেকে সাধারণত গুঁড়ো দুধ কেনা হতো। কাপড় কাঁচা সাবানের দোকান ছিল যেখানে লোকে লাইন ধরে তীর মার্কা, নিরালা অথবা জামাল সোপের বল সাবান কিনতেন। গাঢ় বাদামী রঙের চারটা বল সাবানের ভেতরে পাটের সুতলী ঢুকিয়ে নারকেলের কাঁদির মতো করে ঝুলিয়ে বিক্রি করা হতো। সাদা রঙের রাণী বল সাবান এসেছে আরও অনেক বছর পরে। সেই বল সাবান বাসায় এনে বঁটিতে কুঁচি কুঁচি করে কেটে পানিতে সেদ্ধ করে তাতে কাপড় ডোবানো হতো।
আমাদের পাড়ার রেশনের দোকানে একটা বড় পোস্টার লাগানো ছিল যেটাতে কালো চশমাপরা, ফৌজী পোশাকের একজন লোকের ছবি ছিল। তার নিচে ব্যাকব্রাশ চুলের, কালো পুরু গোঁফওয়ালা আরেকটা লোকের ছবিও ছিল। তাদের পাশে বিশাল একছড়া ধানের শীষের ছবি ছিল, আর নিচে 'ইউনাইটেড পিপলস পার্টি' লেখা ছিল। সময়টা ছিল ন্যায্য মূল্যের বা বিনা মূল্যের জিনিস খোলা বাজারে বিক্রি হয়ে যাবার – তা সেটা রেশনের চাল-গম হোক আর রাজনৈতিক দল-নেতা হোক। আমাদের রেশন দোকানটা টেকেনি। সেটার ডিলার জহিরুল ইসলাম (জজ মিয়া) পরে টাকা-পয়সা নিয়ে কী করবেন ভেবে না পেয়ে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে নেতা হয়ে গিয়েছিলেন। ইউনাইটেড পিপলস পার্টি দলটাও এক সময় নাই হয়ে যায়। তার সেই পুরু গোঁফের নেতা লোকটার নামের সাথে রেশন দোকানের 'চিনি' স্থায়ীভাবে লেগে যায়।