লিখিও উহা ফিরত চাহো কি না
ভাতের সাথে 'মলুয়া'গীতিকায় মোড়ল চাঁদ বিনোদকে পরিবেশন করেছিল কী কী মনে আছেতো? মানকচু ভাজা, চালতার অম্বল, জিরার সম্ভার দেয়া মাছের সুরুয়া, বেগুন ও কালোজিরা দিয়ে কই মাছের চচ্চড়ি, শুঁটকি পোড়া, শুক্তো ইত্যাদি বত্রিশ ব্যঞ্জন। 'দ্বিজমাধব' কাব্যে লহনা ঘিয়ে মুগডাল রেঁধেছেন, সাথে জাতি কলা আর ঝুনা নারকেলের নিরামিষ, রুইমাছ, জলপাইয়ের অম্বল; মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর কাব্যে খুল্লনাকে দিয়ে সেকালের রন্ধনপ্রণালীও জানিয়েছেন, রন্ধনপ্রক্রিয়ার জানান দেয়া আছে রঞ্জাবতীর সাধভক্ষণের বিবরণে (মানিকরাম গাঙ্গুলি)- সর্ষেবাটা দিয়ে সুশনিশাক, পুঁইডাঁটা দিয়ে কচু-কলার মূলের ঘন্ট, কাঁঠালবিচি দিয়ে চিংড়ি আর নটেশাক, ফুলবড়ি দিয়ে কৈমাছের চচ্চড়ি। 'মানিক তারা বা ডাকাইতের পালা' গীতিকায় আছে, ভাতের সাথে পরিবেশন করা হচ্ছে আলুভাজা, বেগুনপোড়া, তিলের বড়া, কলাইশাক দিয়ে সরপুঁটির ঘন্ট, লাউয়ের বেশ্বরী, খলসে-পুঁটির চচ্চড়ি, মাষকলাইয়ের ডাল, মুগডালের মুড়িঘন্ট, বোয়ালের পেটির ঝোল, অম্বল ইত্যাদি। পঞ্চব্যঞ্জন- ষোড়শব্যঞ্জনে ভরা আমাদের দক্ষিণারঞ্জনের রূপকথা। 'মেঘবৃষ্টিরোদ'এ বুদ্ধদেব বসুর লেখা ভাতের পাতের ব্যঞ্জনগুলির কথা আর লিখতে চাই না, এইসব মেনু পড়লেই আমার জিভের স্বাদ কোরকগুলি উছলে উঠতে থাকে। তার ফল ভাল হয় না। এদেশে লোকে বলে, 'গ্লাটনি ইজ আ সিন'।
কেউ খেতে এলে মেনু বা ক্রমনী তৈরি করাটা একটা বেশ ঝামেলার কাজ। ঈদের মেনু দেখতাম সব কুটুমবাড়িতে একই রকম থাকতো। মেনু বিষয়ে আমার প্রথম জ্ঞানার্জন সিদ্দিকা কবীরের 'রান্না খাদ্য পুষ্টি' বইটির মাধ্যমে।কতকাল আগে তিনি কত দরদ দিয়ে বাঙালী রাঁধিয়েকে শিখিয়েছেন, মেনু তৈরির প্রাথমিক শর্ত তিনটি— সুষম আহার, পরিমিত খরচ আর আকর্ষণীয় পরিবেশন।
মৌসুম অনুযায়ী বদলে যেতে পারে মেনু, বদলাতে পারে উপলক্ষ্য এবং সুযোগ সুবিধা অনুসারে। মেনুতে নানান রঙ-আকার-প্রকৃতি এবং পাকপ্রণালী দিয়ে বৈচিত্র আনা যায়, এইসব বলেই তিনি থেমে থাকেননি। আনাড়ির চোখকে দেখিয়েছেন বিভিন্ন রঙের খাবার (লাল/ লালচে বেগুনি— বীট, টোমাটো, জাম, কালোজাম ইত্যাদি), বিভিন্ন আকারের খাবার (গোলাকার— যেমন লুচি, ভাপা পিঠা, প্যানকেক, বনরুটি), বিভিন্ন স্বাদের খাবার (নোনতা— যেমন নিমকপারা, চিঁড়েভাজা, পাঁপড়ভাজা, পনির) এবং বিভিন্ন প্রকৃতির খাবার (মসৃণ- যেমন দই, ফিরনি, দুধসেমাই, কাস্টার্ড, জেলী, ফালুদা) ইত্যাদি। অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেনু সাজিয়েছেন তিনি, স্কুলের বাচ্চাদের পিকনিক, বিয়ে বা টিপার্টির মেনু, জন্মদিনের মেনু। দৈনিকের উদাহরণ দিয়েছেন, শীতকালের একটি দিনের মেনু—
সকালের নাস্তা- আটার রুটি, সিম আলুভাজি, সুজির মোহনভোগ বা পিঠা, চা
দুপুরের খাবার- লাউ শোলমাছের তরকারি, লালশাকভাজি, ছেঁচকী, ভাত
রাতের খাবার- তাজ কাবাব, মূলার স্যালাড, কপিমূগ, ভাত/রুটি
মেনুটা এতকাল পর দেখে আমি ঘাবড়ে গেছি রীতিমত, কী পরিমাণ শ্রমঘন্টা রান্নার পেছনে দিতে হবে এই মেনু পালন করতে গিয়ে সেটা ভেবেও আমার খারাপ লেগেছে। অবশ্য যেকালে এই মেনু দেয়া হয়েছিল, তখন বাড়িতে বাড়িতে কাজের মানুষ ছিল, একজন বা একাধিক। আটার রুটি এখন বেলবে কে? কে কুচি কুচি করে কাটবে সিম আর আলু? সুজির মোহনভোগ নাড়বে কে অবিরত? মেনুর সিংহভাগ খানা রান্না করা, এক মূলার স্যালাড বাদে। অবশ্য তখন প্রিকুকড বা প্রিপ্যাকড বলে কিছু ছিল না, ভেজাল জুস- চিনিঠাসা সিরিয়াল আর হিমায়িত খাদ্যে ছেয়ে যায়নি বাজার, রোগভোগের শংকা ছিল কম। আমাদের মেনুতে রাঁধা খাদ্যের বাড়াবাড়ির আরেকটা কারণ কাঁচা সবজি বা ফলমূলে ভেজাল এবং বিষ মিশানোর অপরিহার্য্য বিপণনবিধি। সে বড় দুঃখের গল্প।
আচ্ছা, আরেকটু পিছিয়ে যাই, উনিশ শতকের শীতকালীন মেনু দিচ্ছেন মিসেস বীটন, সেটি সপ্তাহের একেকদিনে একেকরকম, আমি রবিবারের মেনু দিচ্ছি—
সকালের ব্রেকফাস্ট:
গ্রিলড কিডনি, বেকড হ্যালিবাট মাছের স্টেক, ঠান্ডা হ্যাম, ডুমুরের স্টু, মার্মালেড, জ্যাম, মাখন, ড্রাই টোস্ট, টোস্টেড স্কোন, পাউরুটি, কফি, চা, ঠান্ডা এবং গরম দুধ
দুপুরের লাঞ্চ:
বাছুরের মাংসের কাটলেট, কোল্ড রোস্ট বীফ, বেকড আলু, আপেলের টার্ট, কাস্টার্ড, বীটের পিকল, মাখন, পনির, পাউরুটি, বিস্কুট, মৌসুমের ফল
রাতের ডিনার:
স্বচ্ছ স্যুপ, বেকড টার্বটমাছের ফিলে, ফেজেন্টের স্যালমি, মাটন, টোমাটো দিয়ে শাক, আলুভাজা, আপেল বা কমলার জেলি, পুরভরা জলপাই
কেমন শোনালো? ওহো, খাবার পরিবেশনের টেবিলে ফুল সাজাবার সময় যেন কখনো দৃষ্টিপথ বরাবর ফুল বা ফুলদানি না পড়ে কেমন? হয় একটু নীচে, নয় একটু ওপরে ফুলগুলি ছড়িয়ে থাকা চাই।
তারপর ধরুন পিকনিকের মেনু। এই পিকনিকের মেনু সিদ্দিকা কবীর দিয়েছেন দুই ধরণের, একটিতে স্যান্ডউইচ-কলা-কোমল পানীয়-চিনাবাদাম, আরেকটিতে আলু মাংসের কালিয়া-পোলাও/খিচুড়ি- তাজা সবজির স্যালাড- রসগোল্লা। পিকনিকের মেনু লীলা মজুমদারও দিয়েছিলেন দু'রকম, কোল্ড রোস্টেড চিকেন- আলুসেদ্ধ- মটরশুঁটিসেদ্ধ- ডিমসেদ্ধ- স্যালাড- ব্রেডরোল-প্লেনকেক কিংবা লুচি- শুকনো আলুর দম- মাছের চপ- মাংসের বড়া, আর বলেছিলেন, "সব চাইতে মজা হয় যদি সেখানে (পিকনিকে) গিয়ে খিচুড়ি, বেগুনভাজা, আলুর দম, টোমাটো চাটনি রাঁধা যায়। কেউ কেউ মাংসও রাঁধেন..."
গরমকালে লোক খাওয়ানোর মেনু দিয়েছেন দই-ভাত, মাছের মালাইকারি, চিকেন মেয়নেইজ, আলু-নারকেল-সিমবিচি-কারিপাতার ঘুগনি আর বাদামের পুর ভরা টোমাটোর স্যালাড। সাথে ছানার পায়েস। ওঁর মেনু লিখবার ভঙ্গিটি ভারী মিষ্টি, "প্রধান পদ করলে মস্ত একটা টক-মিষ্টি চীনে পদ্ধতির মাছ। তার সঙ্গে দিলে ভাজা ভাত। আর করলে ছোট্ট ছোট্ট মটন-চপ ক্রাম্ব দিয়ে ভাজা, তার সঙ্গে দিলে আলু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আর একটা স্যালাড... ছানা দিয়ে পটলের দোলমা কর আর পাতলা পরটা। আমের চাটনি করে রেখেছ নিশ্চয়? তাই একটু দিও। শেষে খুব ভাল করে ফ্রুট স্যালাড দিও।" শীতকালের মেনুতে একটু গুরুপাক খাদ্য যোগ করা যায়- মাংসের ভিন্দালু, আখনি পোলাও, দই ফুলকপি। মেনু তৈরিতে প্রজ্ঞাসুন্দরীকে কেউ টেক্কা দিতে পারবেন না, ওঁর আমিষ ও নিরামিষ আহারের শেষে ত্রিশখানা ক্রমনী দেয়া, একটি পড়ে দেখা যাক, "মেকারনি স্যুপ, মাছের গ্রীল, আন্ডা কাবাব, হ্যারিকট মাটন, শসা ও বীটের স্যালাড, কপি আলু সিদ্ধ, মুরগীর কান্ট্রি কাপ্তেন, ভাত ও পুরি, রুটির ভ্যানিলা পুডিং, জেলী।"
ব্যক্তিগতভাবে আমি একপাতে মাছমাংস খেতে ভালবাসি না- একটি শৌখিন মাছ বা মাংসের গুরুপাক পদের সাথে একটু আলাদা রকম ভাত (ঘোলের পোলাও, লেবু-ভাত), একটি দেখনহাসি স্যালাড, চাটনি আর ভারী দর্শনধারী মিষ্টি পদ- এই দিয়েই দিব্যি লোক খাওয়াবার মেনু হতে পারে; এখানে শেফরা বলে, মেনুতে রোস্টিং-বেকিং এবং স্টুইং এইধরণের কয়েকটি রন্ধনপদ্ধতির বৈচিত্র আনলে সেটা দেখতে বেশ ভাল হয়। টেবিলের মাঝখানে ফুলদানিতে বা জলের ভান্ডে বাছাই করা ক'টা ফুল কিংবা ভিন্টেজ বাসনে মরসুমের ক'খানা ফলের স্যালাড, সাথে মেনুমাফিক নুন-লঙ্কার- জলপাই তেলের- ভিনেগারের শিশি, কাঁচের বাসনে মাখন বা ঘি... সাথে মেনু অনুযায়ী টাটকা ব্রেডরোলস বা ভাজা/সেঁকা পাপড়, এইসব সাজ আমার খুব পছন্দ। মনে আছে তো, তারাশংকরের 'গণদেবতা'তে নায়ককে স্বৈরিণী নারী খেতে দিয়েছে পদ্মপাতায়, এমনকি নুনের পাত্রটুকু অব্দি পদ্মপাতা ছোট্ট গোল করে কেটে আয়োজন করে দেয়া!
মেনুর রকমফের করতে আম্মাকে দেখেছি, একেবারে সাদামাটা ভাত দিতে মনে আপত্তি থাকলে সেই গরম ভাতেই কুচো পেঁয়াজ বেরেস্তা বা আলুর বেরেস্তা দিয়ে দিত আম্মা। একই বেলার রান্নায় একাধিক মাংসের পদ পরিবেশন করতে মা ভালবাসতো না, মাছ একাধিক পদের হলে একটা হতো ভাজা আরেকটা ঝোল বা কোপ্তা, সময়ে কুলালে মাছের ভর্তাও চলতে পারতো, আর ডালের বদলে মুড়িঘন্ট বা সবজি দিয়ে শুকনো করে রাঁধা ডালের চচ্চড়ি। আমি যখন একটু আধটু রাঁধতে শিখেছি, আমি মায়ের মেনুতে কখনো জুড়ে দিতাম দু'একখানা শৌখিন রান্নার পদ, দেহাতি যুবতীর সরল গায়ে যাত্রাভিনেত্রীর বডিসের মতন বাহুল্য হতো দেখতে।
মেনুতে সংরক্ষিত খাদ্যের একটি পদ থাকলে বেশ ভাল হয়, তাহলে একটি পদ অন্ততঃ রাঁধবার ঝক্কি থেকে মুক্তি মেলে। এককালে প্রভিন্স হিসেবে বেঙ্গল বা বাংলা ছিল বৃটিশরাজের চাকুরেদের জন্যে বিভীষিকা, মাঠকে মাঠ ধানক্ষেত, বিশালকায় নদী আর জলাভূমি, সারাবছরের আর্দ্রতায় বইয়ের পাতা অব্দি পচে ওঠে। সে আবহাওয়ায় খাদ্য সংরক্ষণ ছিল ঝামেলার বিষয়। বছরকার আদরের আম তাই সংরক্ষিত হতো থালার কানা ভরা আমসত্তে, আমতা- আমতেল- আমকাসুন্দি- আমের থেঁতো- আমের বারমশলার আচার- গুড়ুম্বা কত কী পদ্ধতিতে বাঙালি আদরের আমকে বছরভরে খেয়েছে। মাছ-মাংস রোদে শুকিয়ে শুঁটকি হতো, নোনা ইলিশ আর পর্তুগীজ বাকালাও বা সল্টেড কড পরস্পর সম্পর্কিত কি না জানি না। ভুঁড়ি ফেলা পুঁটির স্তর মাছের তেলে মেখে বায়ূরোধী করে মাটির মটকায় পুরে কাঠের খড়ম পরা পায়ে পিষে উঠানের মাটিতে পুঁতে হতো হিদল শুঁটকি, লবণের আস্তর দিয়ে মাটির পাত্রে করা হতো নোনা ইলিশ। চাকা মাংস চর্বিতে ডুবিয়ে রান্না করে মাসের পর মাস জ্বাল দিয়ে ঝুরি করে খাওয়া হতো সে আগেই লিখেছি। সিমবিচি- কাঁঠালবিচি- কুমড়োবড়ি এবং কলাইবড়ি ইত্যাদি রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হতো। চিনির রসে জ্বাল দিয়ে শুধু আমের মোরব্বা নয়, তৈরি হতো পেঁপে-চালকুমড়া-পটল-শতমূলীর মোরব্বা। জেলি তৈরির পন্থা প্রচলিত হবার পর ফল সংরক্ষণে এলো আরেক মাত্রা, পেয়ারা- গাজর- টোমাটো- মেষ্টা ইত্যাদি অনেক ফলেরই জেলি তৈরি করে রাখা গেল। এখন সংরক্ষণ ঝামেলার নয়, ফ্রিজ আছে। এখন বরং পচন দেখে বোঝা যায় খাদ্যের গুণগত মান অক্ষুন্ন ছিল- ফর্মালিন ছিল না। লেবুর জারক আর দেখি না। দেখি না বাড়িতে বানানো আমসত্তও। সিদ্দীকা কবিরের বইয়ে আছে শীতকালীন সবজি শুকিয়ে সংরক্ষণ করার কথা, পরে পানিতে ভিজিয়ে সেটা পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব, সেটাও এখন আর কেউ করে বলে জানি না। সংরক্ষণ, পিকল বা চাটনি বা আচার তৈরি (সেটা সবজিরও হতে পারে, মূলার আচার, কপি-শালগম-গাজরের আচার) আমাদের মরসুমের ফলে ওঠা সবজির অপচয়রোধ করতে পারে।
দৈনিক মেনুতে আমি বাসী হয়ে যাওয়া খাবারের সদগতি করবার পক্ষপাতী। বাসী পাউরুটি দিয়ে যেমন বিলেতে ক্রুটন হয়, বাসী হাতরুটি ছিঁড়ে দিয়ে লেভান্টের রুটির স্যালাড 'ফাতুশ' বানায় আরবীয়রা।রুটি কড়কড়ে করে তেলে ভেজে ফেলেও খাওয়া চলে। অপূর্বদা (চক্রবর্তী) আমাদের বলেছিল তার মা গন্ধ হতে থাকা বাসী ভাত গরম জলে ধুয়ে খেতে দিত।আমাদের বাড়িতে একটু গন্ধ লাগা মাছে লেবুপাতা দিয়ে চচ্চড়ি করা হতো কিংবা বেশ করে তেলে ভেজে ঝুরিভাজা। ডালে গন্ধ হয়ে উঠতে থাকলে ডালের পানিটা উনুনের তাপে টানিয়ে নিয়ে পরে সর্ষের তেল- পেঁয়াজ- কাঁচামরিচ ডলে ডালভর্তা করা হতো। মুরগী ঝোলে ডুবে থাকতে থাকতে বাসী হয়ে উঠলে সেটা ঝোল থেকে সযত্নে তুলে তেলে মচমচে করে ভেজে আবার কেবল পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ আর আস্তজিরা দিয়ে রেঁধে নিতে দেখেছি কোনো কোনো বাড়িতে।
মধ্যবিত্তের কল্যাণী রান্নাঘরে এমন কতরকম ভোজবাজি চলতো, কত তুকতাক জানতো লোকে খাদ্যের ভেজাল চিনবার, খাবার সংরক্ষণের জন্য কতই মাথা ঘামাতো। উনিশ শতকীয় মিসেস বীটনের বইয়ের কথা বারবারই আসছে এ লেখায়, উলের কাঁটা দুধে চুবিয়ে দেখতে হবে দুধের ফোঁটা ধীরলয়ে পড়ছে না দ্রুত, ধীরে পড়লে সেই দুধ টাটকা। এ'বেলার স্যুপ ওবেলার জন্য রাখবার আগে মেটে হাঁড়িতে একবার জ্বালিয়ে ঠান্ডা করে নেয়া চাই... ভাল জলপাই তেলের রঙ হবে হালকা সবুজ রশ্মির মতো, মাখন-চাপা দেবার জন্যে চাই মসলিন, মাছ তেমন টাটকা না হলে ভিনেগারে ধুয়ে নেয়া চাই বা পারম্যাঙ্গানেট অভ পটাশে, আপেল বাগান থেকে তুলে এনে খড়ের ওপর রাখা চাই এমন করে যেন একটি আরেকটিকে ছুঁয়ে না থাকে।
মিসেস বীটনের বইয়ে একখানা আস্ত অধ্যায়ই আছে, তার নাম 'দ্য আর্ট অভ ইউজিং আপ', কি করে বেচে যাওয়া মাছমাংস থেকে 'ডেইন্টি ডিশ' তৈরি করা যায়; রবিবারের রোস্ট থেকে বীফ-কেক বা ভিল প্যাটি, সেদ্ধ চিকেন থেকে কাটলেট, বেচে যাওয়া মাছ থেকে ক্রোকেট আর ফিশপাই, বনমুরগীর বা রাজহাঁসের হ্যাশ, ভিনেগারে গোলমরিচ-কাবাবচিনি-তেজপাতা দিয়ে সেদ্ধ স্যামন মাছের পিকল।
আহা, সেকালে গরম ইস্ত্রি চেপে চেপে কার্পেটের মথ মারা হতো, চুনায় ডিমের শাদা মিশিয়ে গরম করে নিয়ে তাই দিয়ে ফাটা বাসন জুড়ে দেয়া হতো... আমরা সেইসব দিন হারিয়ে ফেলেছি, আমাদের কাছে যে কোনো ভাঙা জিনিস, বাসী জিনিস পরিত্যাজ্য, মা-পৃথিবী তাই ঢেকে যাচ্ছে আমাদের বর্জ্যে।