লুৎফুন্নিসা বেগম
একজন নারীর সারাজীবনের আত্মত্যাগ যদি একজন ধূর্ত পুরুষের কৃতকর্মকে ঢেকে দেয়, তবে সেই ভাগ্য নিয়েই এসেছিলেন বাংলার নবাব, সিরাজ-উদ-দৌলা। রক্ত আর কান্নায় ডোবা বিয়োগান্ত জীবন - তার এবং তার শিকারদেরও - সমস্ত কিছুই তার স্ত্রীর সর্বাধিক নির্ভরযোগ্যতার কাছে হার মেনেছে, যে স্ত্রীর কাহিনির কথা বলতে গেলে কবির ভাষায় বলতে হয়, 'সৌন্দর্য আর দুর্ভাগ্য যেন হাত ধরাধরি করে চলেছে।'
লুৎফুন্নিসা সিরাজ-উদ-দৌলার মায়ের বাড়িতে একজন ক্রীতদাসী হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন হিন্দু, তার নাম রাজ কুনওয়ার থেকে সেরকমটাই মনে হয়। তরুণীর রূপ আর গুণ সিরাজের হৃদয় জয় করেছিল। সিরাজের মা তাই লুৎফুন্নিসাকে সঁপে দেন তার হাতে। সিরাজ তাকে লুৎফুন্নিসা নামটিতে মহিমান্বিত করেন। তার গর্ভে সিরাজের এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সিরাজের প্রতি লুৎফুন্নিসা ছিলেন আজীবন বিশ্বস্ত। তিনি তার স্বামীর সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন। জীবনভর সিরাজের উপরে তিনি এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে তার আইনসিদ্ধ পত্নী মুহাম্মাদ ইরিজ খানের কন্যা, উমদাত-উন-নিসা-কেও (বউ বেগম) ভুলিয়ে ছেড়েছিলেন।
১৭৪৮ সালের শুরুর দিকে বিহারের গভর্নর, জাইন-উদ-দীন আহমদ (হাইবাত জং) আফগানদের হাতে নিহত হন। সিরাজের দাদা নওয়াব আলীবর্দী তরুণ সিরাজকে তার স্থানে অভিষিক্ত করেন কিন্তু সত্যিকারের দায়িত্ব অর্পণ করেন তার ডেপুটি, রাজা জনাকিরামের উপরে। সিরাজ আসন গ্রহণ করতেই পাটনা স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। দিনে ষাট থেকে সত্তর মাইল চলতে পারে এরকম দুটো ষাঁড়ে টানা, চারদিকে আচ্ছাদিত গাড়িতে চড়ে সিরাজ তার মা ও লুৎফুন্নিসাকে নিয়ে পাটনার উদ্দেশে রওনা দিলেন।
১৭৫০ সালের জুনে পাটনায় পৌঁছলে সিরাজ রাজাকে শহরের ক্ষমতা তার হস্তগত করতে আহ্বান জানান। কিন্তু নওয়াব আলীবর্দী খানের অনুপস্থিতিতে জনাকিরাম তা করতে রাজি হন না। সিরাজ তখন শহরটিতে আক্রমণ করেন কিন্তু পরাজিত হয়ে শহরতলীতে আশ্রয় নেন। নওয়াব আলীবর্দী খান তখন মারাঠাদের সঙ্গে ব্যস্ত ছিলেন। তার কাছে সংবাদ পৌঁছলে তিনি দ্রুত পাটনায় আসেন। তিনি তার নাতিকে তিরস্কার করার পরিবর্তে বুকে টেনে নেন এবং তাকে উদ্ধার করে নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
পলাশীর যুদ্ধে (২৩ জুন ১৭৫৭) সিরাজ-উদ-দৌলা তার সেনাপ্রধান, মীর জাফরের শঠতার কারণে পরাজিত হন। দুর্ভাগ্য তখন তাকে এমনই তাড়া করে যে স্বয়ং শ্বশুড়, ইরিজ খানও তাকে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। সিরাজ তাই এককী পলায়নে বাধ্য হন। লুৎফুন্নিসা তখন সিরাজের পায়ে পড়ে তাকে পলায়নের সঙ্গী করার জন্য মিনতি করেন। কিন্তু সিরাজ তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে এই লড়াই সাময়িক আর তিনি দক্ষ একটা সেনাবাহিনিসহ খুব তাড়াতাড়ি রাজত্ব উদ্ধারের জন্য ফিরে আসবেন। কিন্তু লুৎফুন্নিসা গোঁ ধরে থাকেন।
২৫ জুনের রাতে সিরাজ তার ধনরত্ন আর বিপুল অর্থ কয়েকটা হাতির পিঠে বেঁধে নিয়ে, চারদিকে মোড়ানো হাতির চৌকিতে লুৎফুন্নিসা আর কনিষ্ঠ কন্যাকে বসিয়ে নিঃশব্দে ভগবানগোলার দিকে যাত্রা করেন। তিনি এক উদ্ভ্রান্ত উদ্বাস্তুর মতো ছদ্মবেশে রওনা হয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল পাটনার দিকে যাওয়া যেখানে গিয়ে হয়ত একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনি গঠনের চেষ্টা করতে পারবেন। দিনের উত্তাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছিল। লুৎফুন্নিসা তার স্বামীর দুশ্চিন্তা আর অবসাদ কমানোর জন্য সবরকমের চেষ্টা করছিলেন। রুমাল দিয়ে তাকে বাতাস করছিলেন তিনি। গবানগোলায় পৌঁছে সিরাজের পরিবার নৌকায় চড়ে বসে। কিন্তু তাদেরকে বাহরাল নামের এক গ্রামের তীরে গিয়ে নোঙর করতে হয়। গঙ্গার উলটোদিকে রাজমহল থেকে চার মাইল দূরে ছিল গ্রামটা। মাঝনদীতে দিক হারিয়ে নাজিপুরের মুখটা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েই নৌকাকে তীরে ভিড়তে হয়েছিল।
তার আগে ইতোমধ্যে সিরাজ আর তার পরিবার তিন দিন তিন রাত খাদ্যবিহীন কাটিয়েছেন। শেষে বাহরালে নৌকা থেকে নেমে দানা শাহ নামের এক পীর-ফকিরের আখড়ায় খাদ্যের খোঁজে ঢুকে পড়েন। মাজারে উপস্থিত লোকেরা খাদ্য ভিক্ষা করা মানুষটির জুতোর দিকে তাকিয়ে তার আভিজাত্য টের পেয়ে যায়। নৌকার আরোহীদের মধ্যে অভিজাত লোকটি যে কে তা বুঝতে তাদের সময় লাগে না। বড়ো পুরস্কারের আশায় উপস্থিত কেউ খবরটি নিয়ে মীর কাশিমের কাছে রওনা দেয়। মীর কাশিম হলেন মীর জাফরের মেয়ের স্বামী যিনি তখন আশেপাশের এলাকায় পালিয়ে বেড়ানো উদ্বাস্ত নবাবের খোঁজে সেনাবাহিনিসমেত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সিরাজ অতি দ্রুত পরিবার ও ধনরত্নসহ ধরা পড়েন। ধরা পড়া নওয়াব দুবৃত্তদের কাছে প্রানভিক্ষা চাইলেন কিন্তু সে আবেদন মাঠে মারা গেল। কয়েকদিন আগে অব্দি যারা তার সঙ্গে চোখ তুলে কথা পর্যন্ত বলতে সাহস পেত না তারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার ফন্দি আঁটল। 'মীর কাশিম খান তার ক্ষমতায় এবং হুমকিতে লুৎফুন্নিসাকে আয়ত্বে নিয়ে নিলেন। লুৎফুন্নিসার রত্ন ভাণ্ডারের খোঁজ পেতে তার বেশি সময় লাগল না। যে গয়না আর রত্নের মূল্য তখন লাখেও গোনা যেত না তা সহজেই মীর কাশিমের হাতে চলে এল।' (মুতাখেরিন, রর, ২৪০)
সিরাজ-উদ-দৌলা ধরা পড়ার খবর যখন মীর জাফরের কানে পৌঁছল তিনি লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে এক জরুরি মিটিঙে বসলেন। নিজের স্বস্তি প্রকাশ করে তিনি পুত্র, মিরনকে পাঠালেন আসামীকে উদ্ধার করে শহরে ফিরিয়ে আনতে। এর আট দিন পরে একদিন মধ্যরাতে সিরাজকে ফিরিয়ে মুর্শিদাবাদে আসামীরূপে নিয়ে আসা হলো। যে প্রাসাদে দাঁড়িয়ে একদিন তিনি লাখো মানুষকে শাসন করেছেন, সেই একই প্রাসাদে কুটিল মীর জাফরের সঙ্গে একসঙ্গে উপস্থিত হলেন।
ঘৃণা এবং প্রতারণার শিকার সিরাজ-উদ-দৌলার একজনই বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন, তিনি লুৎফুন্নিসা। তাকে এবং তার চার বছরের শিশু কন্যাকে মৃত নওয়াবের অনুচরদের সঙ্গে ১৭৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক সময়ে মীর জাফর জোরপূর্বক ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে তারা প্রায় সাত বছরের জন্য অন্তরীণ থাকেন। তাদের জন্য যে ভাতা প্রদান করার কথা ছিল তাও নিয়মিত সরবরাহ করা হয়নি। খাবার এবং অন্যান্য জিনিসের অভাবে ঢাকায় তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। কেবলমাত্র মুঈন-উদ-দৈালা মুজাফ্ফার জং (মুহাম্মদ রিয়াজ খান) যখন ঢাকার গভর্নর হয়ে এসেছিলেন তার পর থেকে তারা ঠিকমতো ভাতা পেতে আরম্ভ করেছেন। বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভের বদান্যতা ও দয়ায় তারা পরে বন্দি দশা থেকে মুক্ত হয়ে মুর্শিদাবাদে ফেরত যেতে পারেন।
১৭৬৫ সালে মুর্শিদাবাদে পৌঁছলে লুৎফন্নিসা তাদের বাকি জীবনের জন্য ইংরেজ সরকারের কাছে ভাতার জন্য আবেদন করেন। আরজিটিতে নওয়াব আলীবর্দী খানের স্ত্রী সারফুন্নিসা, লুৎফুন্নিসা ও তার কন্যার সাক্ষরসহ সিল দেখতে পাওয়া যায়।
পরে জানা যায় যে কোম্পানি লুৎফুন্নিসা এবং তার কন্যাকে মাসে ৬০০ রুপি হারে ভাতা প্রদানে রাজি হয়। লুৎফুন্নিসা বেগম পরে বড়ো আঘাত পান তার কন্যার স্বামী, মীর আসাদ আলী খানের মৃত্যুতে। কিন্তু তার পরে তার জন্য ততোধিক ভয়াবহ দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছিল। ১৭৭৪ সালে চার কন্যা সন্তান রেখে লুৎফুন্নিসার কন্যাও মৃত্যুবরণ করেন। কোম্পানি লুৎফুন্নিসার নামে ১০০ রুপি আর তার নাতনিদের জন্য ৫০০ রুপি ভাতা দিয়ে যেতে থাকে। অনাথ চার নাতনি যখন বিয়ের উপযুক্ত বয়সে পৌঁছায় লুৎফুন্নিসা ১৭৮৭ সালে গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিশের কাছে আরো বেশি ভাতার জন্য আবেদন করেন যেন নাতনিদের পাত্রস্থ করে বাকি জীবন মোটামুটি সম্মানের সঙ্গে কাটাতে পারেন।
কিন্তু সেই আবেদন গ্রাহ্য করা হয় না। একসময়ের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নওয়াবের সহধর্মিনী হওয়া সত্ত্বেও তার বাকি জীবন মাসে ১০০ রুপি ভাতা গ্রহণের মাধ্যমেই অতিবাহিত হতে থাকে।
একজন গুণী, প্রতিভাময়ী ও আবেগী নারী, লুৎফুন্নিসা চিরকাল সিরাজের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকেন। সিরাজের মৃত্যুর পরে একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব তিনি নাকচ করে দেন। একবার একজন বিয়ের প্রস্তাব আনলে তিনি জানান, যে মানুষ হাতিতে চড়তে অভ্যস্ত সে কখনো সুযোগ পেলেও গাধার পিঠে ভ্রমণ করে না (মুজাফ্ফর-নামা, পৃষ্ঠা ১০৬)। মুর্শিদাবাদের মতি ঝিলের উলটো দিকে ভাগীরথীর ডান দিকের তীরে খুশ বাগ করবস্থানের নজরদারীর কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন।
নওয়াব আলীবর্দী আর তার নাতি সিরাজ-উদ-দৌলা যে কবরস্থানে পাশাপাশি শুয়ে। সেখানে কোরান তেলাওয়াৎক্বারীদের ভাতা আর কবরস্থানের লঙ্গরখানা পরিচালনার জন্য লুৎফুন্নিসা মাসে ৩০৫ রুপি পেতেন। তিনি দিনরাত স্বামীর কবরের চারপাশে পায়চারি করতেন। নিয়মিত দোয়া-দরুদ পড়ার জন্য তিনি সেখানে কয়েকজন মোল্লাকে নিয়োজিত করেছিলেন। কবরের গায়ে মাঝে মধ্যে নিজহাতে ফুলে ফুলে ঢেকে দিতেন। শোনা যায়, ১৭৯০ সালের নভেম্বরের কোনো এক সময়ে তিনি কবরের পরিচর্যার কাজ করতে করতে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। ৩৪ বছর লুৎফুন্নিসা স্বামীর কবর পাহারা দিয়েছিলেন আর তারপর সেখানেই স্বামীর পাশে তার মৃতদেহের ঠাঁই হয়েছে। খুশ বাগ (আনন্দের বাগান) এখনো লুৎফুন্নিসার আত্মত্যাগ আর উৎসর্গের প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সূত্র: বেগমস অফ বেঙ্গল