সাক্ষাৎকার: আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ ইনারিতুর সঙ্গে আলাপ
আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ ইনারিতু মোহিকো'র আধুনিক যুগের একজন নন্দিত চলচ্চিত্রকার, যিনি অসামান্য কিছু ছবি'র জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তিনি রেডিও এবং টিভিতে হোস্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেন। বেশকিছু ছবিতেও সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করেন। তার জীবনে সঙ্গীতের ভূমিকা অনেকখানি। প্রথম ছবি 'আমেরোস পেরোস' করার আগে বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণ করেন। পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয় মোহিকো'র প্রখ্যাত লেখক, চিত্রনাট্যকার, নির্মাতা গিলেরমো আরিয়াগা'র সঙ্গে। ইনারিতু'র প্রথম ছবি 'আমেরোস পেরোস' মুক্তি পায় ২০০০ সালে, কিন্তু পুরো ৩টি বছর লেগে যায় ছবি'র কাজ শেষ হতে। জটিল বহুস্তরিক গল্প আর চরিত্রকে এক সুতোয় গেঁথে দিতে পারেন তিনি, আর এ আশ্চর্য গুণের জন্য তার প্রতিটি ছবি নন্দিত হয়ে ওঠে। ছবির শুরুতে গল্পটিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেন, ধীরে ধীরে সে টুকরোগুলি ঘনিষ্ট হতে থাকে, এক সময় দর্শকদের বিস্মিত করে দিয়ে একাকার হয়ে যায়। আমেরোস পেরোস ছবি'র জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'ক্রিটিকস্ উইক গ্রান্ড প্রাইজ' ও 'ইয়ং ক্রিটিকস্ অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফিচার' জয় করেন।
ইনারিতুকে বলা হয় চলচ্চিত্রে মোহিকো'র বিস্ময়। ইনারিতুই মোহিকো'র প্রথম নির্মাতা যিনি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা পরিচালকের শাখায় মনোয়ন লাভ করেন, এবং এ পর্যন্ত মোট ৪৫টি পুরস্কার এবং ২৯টি মনোনয়ন লাভ করেছেন। ২০১৭ সালে কান উৎসবে তিনি কনসেপচুয়াল ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ইনস্টলেশন- মাংস এবং বালি (কার্নে ইয়ের্রেনা) প্রদর্শন করেন, যার বিষয় ছিল- শরাণার্থী ও অভিবাসন সংকট। উন্নত জীবনের আশায় সোরিয়ান মরুভূমি পাড়ি দিয়ে শরণার্থীদের আমেরিকা যাওয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতাকে ফুটিয়ে তুলেন তিনি। মরুভূমির ওপর দিয়ে খালি পায়ে মাইলের পর মাইল সীমান্ত ধরে হেঁটে যাওয়া আর তাদের দিকে সীমান্তরক্ষীদের তাক করে রাখা রাইফেল, উপস্থিত দর্শকদের জ্যান্তব বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। 'মাংস ও বালি'র জন্য বিশেষ অস্কারে সম্মানিত করা হয় তাকে।
আলেহান্দ্রো গনহালেস ইনারিতুর জন্ম ১৯৬৩ সালের ১৫ আগস্ট, মোহিকো'য়। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং গল্পকার। বর্তমান পৃথিবীতে নন্দিত ও প্রশংসিত সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অন্যতম, যিনি পরপর দু'বার সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান 'বার্ডম্যান' এবং 'দ্য রেভেন্যান্ট' ছবির জন্য। কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'স্যুমে দ্যু লা ক্রিতিক'-এ স্থান পায় তার প্রথম 'আমোরেস পেরোস'; পরে এই ছবিটি 'বেস্ট ফরেন ল্যাংগুয়েজ ফিল্ম' অস্কার লাভ করে। এ ছবিটির মূল থিম- মৃত্যু। পরে, মৃত্যু নিয়ে তিনি আরও দু'টি ছবি বানাবেন '২১ গ্রামস' এবং 'বাবেল' নামে, যা পরিচিতি পাবে ইনারিতু'র 'ডেথ ট্রিলজি' হিসেবে। মৃত্যুকে তিনি জীবনের শেষ হিসেবে দেখেননি, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, আরও স্পষ্ট করে বললে মৃত্যুর পরিণতি কত যে ট্রাজেডির জন্ম দেয়, 'ডেথ-ট্রিলজি'-তে তাই যেন ধরতে চাইলেন ইনারিতু। ২০১৫ সালে নির্মিত তার ছবি 'দ্য রেভেন্যান্ট' ছিল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে। এই ছবিটিও অস্কারের ৮৮তম আসরে সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতাসহ সর্বোচ্চ ১২টি বিভাগে পুরস্কার পেয়ে যায়।
২০০৬-এ নির্মিত 'বাবেল' ছবি'র জন্য ২০০৭ সালে মোহিকো'র প্রথম পরিচালক হিসেবে অস্কার লাভ করেন। তার ছবির গল্প আমাদেরকে প্রথমে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, তারপর ধীরে ধীরে রহস্যের জট খুলে যেতে থাকে, এ প্রসঙ্গে ইনারিতু বলেন- আর্নেস্তো সাবাতো, হোর্হে লুই বোর্হেস এবং হুলিও কোর্তাসার যেভাবে ন্যারেটিভের কাঠামো নিয়ে খেলেন, সেসব থেকেও আমি শিখেছি। কোনও শিল্পকর্মই অন্য একটি শিল্পকর্মকে পরাজিত করে না। হয়তো সময় বিচার করে কোন শিল্পটি শ্রেষ্ঠ। সত্যিকারের শিল্পে তুলনা চলে না।
অনূদিত সাক্ষাৎকারটি 'ডাইরেক্টরস গিল্ড অফ অ্যামেরিকা' (ডিজিএ)' কোয়ার্টারলি'তে প্রকাশিত হয় গতবছর শীত সংখ্যায়, সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন আন্তর্জাতিক বিনোদন বিষয়ক লেখক এবং 'ডাইরেক্টরস গিল্ড অফ অ্যামেরিকা' (ডিজিএ)' কোয়ার্টারলি'র প্রধান সম্পাদক স্টিভ চ্যাগোলান। সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশের অনুবাদ করেছেন এমদাদ রহমান।
প্রশ্ন: এখন কী করছেন?
আলেহান্দ্রো গনহালেস ইনারিতু: এখন কাজ করছি এমন একটি আইডিয়া নিয়ে যার সঙ্গে লেগে আছি প্রায় দু'বছর ধরে- মানুষের স্টুপিডিটি। কাজের অনুপ্রেরণা হিসাবে এমন বিষয় সত্যিই বিশাল কিছু।
প্রশ্ন: 'স্টুপিডিটি'কে সামগ্রিক সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখতে চাচ্ছেন?
ইনারিতু: হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই, এবং বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষীও; বিষয়টিকে নিয়ে সেরকম দেখার আর কোনও রাস্তাও নেই, একমাত্র কমেডী ছাড়া। কৌতুকপূর্ণ চোখে না তাকিয়ে হয়তো আমরা ব্যাপারটিকে অনুভূতিতে সেরকম নাড়া দিতে পারব না। ফলে আমাকে আমাদের সীমিত বুদ্ধিবৃত্তির বেদনাদায়ক সীমাবদ্ধতার ওপর নির্ভর করেই আমাকে একটি কৌতুককর শিল্প নির্মিতির পথে এগোতে হচ্ছে।
প্রশ্ন: তাহলে নিশ্চয় ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়েও আপনাকে চিন্তা করতে হচ্ছে?
ইনারিতু: ক্ষমতা যাদের হাতে রয়েছে, সেসব মানুষই সমস্যা। ক্ষমতাকেন্দ্রিক এইসব ব্যাপারকে এখন কিছুটা কৌতুকভরেই দেখতে হবে, আমার উদ্দেশ্যও তাই। এভাবে দেখতে পারলে আমরা কিন্তু যথেচ্ছাচারের কিছুটা গভীরে আলো ফেলতে সক্ষম হবো। সেজন্য আমরা অবশ্য কিছু কিছু বিষয়কে নির্দিষ্ট কিছু শব্দে সজ্ঞায়িত করেছি, আমরা মূলে যাওয়ার চেষ্টা করছি যাতে সমস্যার চারপাশে আলো ফেলা যায়। কিন্তু যদি সব কিছুকেই আইডিওলজি, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস- এসব মাপকাঠিতে পরিমাপ করতে শুরু করি, তাহলে হয়তো কোথাও না কোথাও সব কিছু স্থির হয়ে যাবে, সেই আবিষ্কারটা আর হয়ে উঠবে না, 'বাস্তব'কে বুঝতে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হবো। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় এখানে আসলে কী ঘটছে, তা যদি পৃথিবীর বাইরে থেকে দেখি, তাহলে দেখব কী অদ্ভুত সব সার্কাস চলছে! আর হয়তো দেখব আশ্চর্য সব কৌতুক দেখে গ্রহনক্ষত্রও হাসছে।
প্রশ্ন: 'দ্য রেভেন্যান্ট'-এ এমন একটি দৃশ্য রয়েছে, লিওনার্দো ডি'ক্যাপ্রিও যে চরিত্রটি রূপায়ন করেছেন - হাগ গ্লাস, তিনি তার ছেলেকে বলছেন - তারা তোমার গলার আওয়াজ শুনবে না, তারা কেবল তোমার অভিব্যক্তির রঙটা দেখবে। কথাটা খুব ভাবায়। চিন্তিত করে। এ তো সত্যিই উদ্বেগজনক যে এখনও আমরা পৃথিবীতে আত্মস্বার্থ আর বর্ণবাদী মন নিয়ে বেঁচে আছি!
ইনারিতু: আসলেই তাই; এখনও, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একটুও বদলায়নি। এ কথাটিই আমি বলতে চেয়েছি। আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে শুরু করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যেসব ধারণা ও বিশ্বাস নিয়ে পৃথিবী এগিয়ে চলছিল, আজকের দিনে আমরা যেন সেসব ধারণা ও বিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হতে পারছি না, তাঁদের সেসব চিন্তাকে এগিয়ে নিতে কিংবা নতুন ভঙ্গিতে দেখতে ব্যর্থ হচ্ছি। এমন কি, এই ডিজিটাল যুগ এবং তার নতুন নতুন সব প্রযুক্তি সঙ্গে নিয়েই, আমরা (আমাদের) শারীরিক সক্ষমতাকে, শারীরিক গঠনকে প্রাধান্য দিচ্ছি; মানুষের শারীরিক গড়নের ভিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি, পার্থক্য তৈরি করে দিচ্ছি; বিভেদ তৈরি করছি। বুঝতেই পারছি না যে শারীরিক গড়নের ভিন্নতা হচ্ছে সেই বৈচিত্র্য যা আমাদেরকে দেখিয়ে দেয়- 'আমরা' আসলে কে। যখন কোপার্নিকাস বললেন যে আমরা মহাবিশ্বের কেন্দ্র নই, ঠিক তখনই তাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আজ আমরা প্রমাণ করে ফেলেছি কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা।
তবে আমাদের এতদিনের বিশ্বাসে, ধারনায় ভুল আছে, সত্যও আছে আবার কিছু কিছু ধারণা ঠিক সত্যও নয়, এবং এখনও খুঁড়তে খুঁড়তে এমন কতকিছু বেরিয়ে আসছে...যে গল্পটি একদিন (আমাদের) স্মৃতিকোষে পৌঁছেছে সেটাই (আমাদের) ডিএনএ-তে থেকে গেছে। আমার নিজস্ব একটি থিওরি আছে- এই ইউনিভার্স পরমাণু দিয়ে তৈরি নয়, গল্প দিয়ে তৈরি। কোনও একদিন যে-গল্পটি আপনার হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়েছিল, তারপর হাড় থেকে পুরো শরীরে, গল্পটি তারপর সেখানেই থেকে গেছে। আমি বলব যে গল্পগুলো নিরপেক্ষ নয়, তারও পক্ষপাত আছে- সে গল্প আশাবাদী, সুন্দর, প্রেরণামূলক, শক্তিশালী, রোমান্টিক হতে পারে, আবার বৈনাশিক, নির্জনবাদী, নাস্তিবাদী, অহংপূর্ণ, আত্মকেন্দ্রি হতে পারে; পৃথিবীতে জান্তব বাস্তবতা বিরাজ করছে, চোখ খুললেই এখন সব দেখা যাচ্ছে কিন্তু অনেকে তা দেখছে না, না দেখার ভান করছে। বহুকিছুই লোকে এড়িয়ে যায়, ভীতি এবং হাসিঠাট্টায় বেঁচে থাকে।
প্রশ্ন: আমরা জানি যে ছবির কাজ করতে গিয়ে আপনাদের তিনজনের একটি বন্ধুবলয় গড়ে উঠেছে, যেখানে আপনার সঙ্গে গভীর বন্ধত্ব তৈরি হয়েছে গিয়ের্মো দেল তরো ও আলফোনসো কুয়ারোনের সঙ্গে। আপনি কি তাদেরকে আপনার কাজের বিভিন্ন খসড়া দেখিয়ে থাকেন?
ইনারিতু: হ্যাঁ, তা তো দেখাইই। এভাবেই আমাদের কাজ এগিয়ে চলে।
প্রশ্ন: কাজ নিয়ে, কাজের খসড়া নিয়ে তাঁদের পরামর্শ শোনেন?
ইনারিতু: যদিও আমরা কাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলি, তবু আমি বলবো ব্যাপারটা ভীষণ যন্ত্রণার। আমি নিজেকে এমন এক নির্মাতা মনে করি যার সঙ্গে অনেকের যোগাযোগ রয়েছে, যাদেরকে আমি ঠিক খায়, ঘুমায়, মরে যায় এমন সাধারণ মানুষ মনে করি না, মনে করি তারা শিল্পী। শিল্পী হিসেবেই তাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি। তাঁদের শিল্পিত স্বভাবটাই আমাকে নানা দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেয়। এই শিল্পীদের পরামর্শ, উপদেশ সবসময়ই তাঁদের শরীরের ডান পাশ থেকে আসে, যেখানে মানুষের হৃদয় থাকে। আর তারা যা কিছু বলেন, তা ভুলও হতে পারে আবার ঠিকও হতে পারে। তখন আমরা সবকিছু নিয়ে তুমুল তর্কে মেতে উঠি। ভেঙেচুরে দেখি। তর্কের এই ব্যাপারটা এমন হয় যে আমরা গাছটিকে ধরে এমনভাবে নাড়াতে শুরু করলাম যতক্ষণ না সবগুলো পাতায় সে নড়ন পৌঁছে যায়। কিন্তু জানেন, এই ব্যাপারটিকে আমার ঠিক পছন্দ হয় না। মনে হয়, ভুল করে ফেলছি। নিজের কাজ নিয়ে এতটা খোলামেলা হওয়া উচিৎ নয়। বন্ধুরা আমাকে আরও বেশি করে ভাবতে বলে; বিভিন্ন দৃশ্য, ছবির গল্পসহ অলক্ষ্য বহু কিছুর ওপর বিশেষ নজর দিতে বলে। আর সেটা অবিরাম চলতে থাকে এডিটিং রুম পর্যন্ত। বুঝুন!
প্রশ্ন: তো, নির্মাণের মূল কাজটি শেষ পর্যন্ত এভাবেই, এগিয়ে চলে?
ইনারিতু: হ্যাঁ, এভাবেই আমাদের কাজের ধাপগুলি পার হতে হয়, এমনকি একটি ছবির ধারণা মনে আসার পর থেকেই সবকিছু শুরু হয়। এভাবে প্রথমে গল্পের পাণ্ডুলিপি নিয়ে তর্ক শুরু হয়, কাটাছেঁড়া করি, এভাবে চূড়ান্ত সম্পাদনা পর্যন্ত আমরা সবসময়ই তর্কে মেতে থাকি। একে অপরকে কথা বলবার সুযোগ দিই। তর্কের সময় কিন্তু আমরা আর বন্ধু থাকি না, তখন কিন্তু আমরা কঠোর সমালোচক! ঠিক তখন আমরা আর বন্ধু নই, নিষ্ঠুর এবং অভদ্র, অসভ্য।
আমি বিশেষ করে আলফোনসো'র কথা বলব। আলফোনসো তীক্ষ্ণ, ধারাল ছুরির মতো তার জিহ্বা। সে কোনও কিছুই ভেতরে গোপন রাখবে না। নির্মিয়মান শিল্পটি যেন শেষ বিচারেও খাঁটি শিল্প হয়েই থাকে সে জন্য সে খুঁটিনাটি সবকিছুই বলবে। দেখুন, কথাগুলি আমি কিন্তু ব্যক্তি আলফোনসো কিংবা গিয়ের্মো দেল তরো সম্পর্কে বলছি না, এমনকি আমার নিজের সম্পর্কেও না। আমরা বলছি একটি ছবির জন্য যা কিছু বলতে হয়, করতে হয়- সে সম্পর্কে। নিজেদের সম্পর্কে নয়। আমাদের তর্ক থেকে হয়তো এমন কিছু সংবেদনশীল, রোমান্টিক কিংবা ঐতিহাসিক বিষয় বেরিয়ে আসে যা হয়তো যে কোনও ছবিকেই অতুলনীয় করে ফেলতে পারে কিন্তু তা হয়তো আমার ছবিটিকে কিছুই দিচ্ছে না, কোনও কাজেই আসছে না। সুতরাং, আমরা গভীর ধ্যানে পাণ্ডুলিপির কথা ভাবি, এবং এমন সব কথা বলি যার সঙ্গে আবেগ থাকে না, নিষ্ঠুরতা থাকে। তখন আমরা পরস্পরকে বলি, 'সব কথাই ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের ছবিটিকে এসব কোনও সাহায্যই করছে না।' এসব ব্যাপার সত্যিই বেদনাদায়ক; এ জন্যই হয়তো ফকনার বলেছিলেন- তোমাকে হয়তো তোমার প্রিয়তমাদের খুন করে ফেলতে হবে।
প্রশ্ন: নির্মাণের ক্ষেত্রে ঠিক কীভাবে আপনি আপনার বন্ধুদের সৃষ্টিশীল চিন্তা থেকে নিজের কল্পনাশক্তিকে গুরুত্ববহ করে তোলেন?
ইনারিতু: নিজের সৃষ্টিশীল কাজের পদ্ধতিটি অন্যদের ভেতর থেকে তার শ্রেষ্ঠ কাজটিকে বের করে নিয়ে আসার মধ্যেই লুকোনো থাকে। তার কারণ, একমাত্র আপনিই পুরো ক্যানভাসটিকে জানেন, আর কেউ না; ঠিক এখানেই নির্মাতা হিসেবে আপনি একা এবং নিঃসঙ্গ, আর এই নিঃসঙ্গতাই আপনার কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একজন নির্মাতা হিসেবে আপনার কাজটি অত্যন্ত কঠিন, কারণ আপনার কাজই হচ্ছে পরিপ্রেক্ষিত (পার্সপেক্টিভ) এবং সমগ্রতা (হোলনেস)-কে মাথায় নিয়ে চলা। কিন্তু আমি সব সময়ই বন্ধুদের থেকে নতুন আইডিয়া পেতে চাই, এক্ষেত্রে আমি মুক্তমনা কিন্তু তাই বলে যে সমস্ত কিছুই আমাকে গ্রহণ করতে হবে সেরকম তো কোনও কথা নেই। যদি সবকিছুই তাঁদের থেকে নিতে হয়, তার মানে হচ্ছে আমি নতুন কিছুই করছি না। তাহলে কী দাঁড়াল? এসব ক্ষেত্রে আমি নিজেকে প্রাধান্য দিতে পছন্দ করি।
তবে, কয়েকজন মিলে কাজ করার ভালো দিকও আছে, দেখা যাবে সমস্ত আলাপের শেষে যেখানে থেমেছি, সেখানে সম্পুর্ণ নতুন কিছু বের হয়ে এসেছে। আমার মনে হয় দু'জন একসঙ্গে কাজ করার মানে আসলে তিনজন কাজ করছি। যখনই আপনি শিল্পের একজন সারথি পেয়ে যান, ধরে নেবেন আসলে আপনারা তিনজন। সংখ্যাটা আসলেই তখন বেড়ে যায়।
একবার আপনি যখন শৈলী (ক্র্যাফট) নিয়ে কাজ শুরু করে দিবেন, বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ শুরু করবেন, যখন কাজ শুরু করবেন আগে থেকে ভেবে রাখা বিষয় নিয়ে, তখন হঠাৎ আপনি এমন এক বাস্তবতার সন্ধান পাবেন, যা হয়তো আগে যেভাবে ভাবছিলেন তার সঙ্গে কিছুতেই মিলবে না। আপনি বিস্মিত হবেন। তখনই আপনাকে সেই বিস্ময়, সে রহস্যকে, সেই সব দুর্বোধ্য বিষয়কে বিমূর্ত থেকে মূর্ত করবার এমন এক উপায় খুঁজে বের করতে হবে যেখানে সাধারণ লোকের অভিজ্ঞতা আর আপনার অভিজ্ঞতা মিলবে না; আপনি নতুন এক পথের দিকে এগিয়ে যাবেন। শিল্প সৃষ্টির সমস্ত রসায়ন ঠিক এখানেই লুকোনো। জাগতিকতাকে (ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড) আপনি অন্য একটি জগতে প্রবেশ করাবেন, যে জগত হয়তো বস্তুর নয়, হয়তো সে ভাবের, সে আপনার কল্পনার; হয়তো সে জগত বিস্ময়কর, হয়তো মানুষের স্পর্শাতীত, দুরধিগম্য কোনও এক জগত। আর এখান থেকেই একজন সিনেমা নির্মাতা কিংবা একজন মহৎ লেখকের কল্পনার শুরু। আপনি, আমি হয়তো শুরুর দিকটি ভাবতে পেরেছিলাম, আর এগোতে পারিনি কিন্তু কল্পনার কারিগররা বহুদূর দেখে ফেলেন।
প্রশ্ন: ইনামুয়েল লুবেস্কির সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে একজন পরিচালকের জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান ঠিক কতটুকু দরকার বলে আপনার মনে হয়েছিল?
ইনারিতু: তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে ছবির 'আলো' সম্পর্কে আমার ন্যুনতম ধারণা আছে। ছবিতে 'আলো' কীভাবে কাজ করে, আলো'র আচরণ কেমন হয়, আর যে নাটকীয়তা আপনি তৈরি করতে চেয়েছিলেন তার জন্য কীভাবে আপনি আলোর ব্যবহার করবেন, এসব... যদি আপনি আলো'র নিয়ম না জানেন, কীভাবে আলোকে ব্যবহার করতে হয়- না জানেন; কতটা আলো লাগবে, আপনার আবেগের যথাযথ প্রকাশে আলো'র রঙ কীভাবে আপনাকে স্পর্শ করছে, আপনার বিমূর্ত কল্পনা ও উপলব্ধিকে ছুঁতে চাইছে, আলো কীভাবে প্রতিটি দৃশ্যকে আকার দিচ্ছে, এসব যদি না জানেন তাহলে আপনি কখনওই একজন পরিচালক নন। ছবি তৈরির প্রযুক্তিগত দিকগুলো নিয়ে আমরা একদমই কথা বলিনি, কারণ তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে এ ব্যাপারে আমার কিছু না কিছু ধারণা আছেই। কিন্তু আলো-কে বুঝবার সেই সংবেদনশীলতা আমার আছে কি না- সেটাই ছিল মূল বিষয়। এর কারণ হিসেবে তিনি বলতেন- ছবির যেকোনও একটি দৃশ্যের ৯০ শতাংশই হচ্ছে আলো। দৃশ্যে চরিত্রের চেয়ে আলো-কেই বেশি কথা বলতে হবে।
রদ্রিগো এবং লুবেস্কি এমনই দক্ষ চিত্রগ্রাহক যে আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় আলো-কে তাঁদের মতো করে আর কেউ এতো চেনে না। ছবির তাত্ত্বিক দিক নিয়ে আপনি যদি লুবেস্কির সঙ্গে ঘণ্টাখানিক কথা বলেন, দেখবেন যে আপনি কিছুই বুঝতে পারেন নি, আপনাকে তখন এমন কিছু বিষয়ে জেনে নিতে হবে, যা আপনার জন্য জরুরি। সেক্ষেত্রে আপনার জানা থাকতে হবে, আপনি আসলে কী জানতে চান। আমি জেনে গিয়েছিলাম যে এরা এমনই দু'জন কারিগর, আলো নিয়ে দুনিয়ায় কাজ করতে জানেন, তেমন অল্প কিছু মানুষের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠতম।
প্রশ্ন: আপনার জীবনের কোন পর্বে ছবির প্রতি মুগ্ধতার জন্ম হয়েছিল? কোনও একটি ছবি দেখে ভেবেছিলেন- 'বাহ, এমন একটা কাজ তো আমিও করতে পারি'।
ইনারিতু: হ্যাঁ, এরকম কয়েকটি ছবি দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই ছিল যে ছবিগুলি আমাকে দারুণ রকম নাড়িয়ে দিয়েছিল। একটি ছিল '৬৯-এ নির্মিত জন শ্লেসিঞ্জারের 'মিডনাইট কাউবয়'; ছবিটি দেখাতে বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ ছবি দেখার অভিজ্ঞতা আমার জন্য ভয়ানক ছিল, কারণ তখন আমি বয়সে খুবই ছোট ছিলাম; ছবিতে ডাস্টিন হফম্যান এবং জন ভয়েট-কে ঘামতে দেখছিলাম। অভিনয়, ক্যামেরার কাজ- সবকিছুকে স্রেফ বাস্তব মনে হচ্ছিল। ছবির সেই গানটিকে বাবা এত পছন্দ করে ফেলেছিলেন যে প্রায়ই গেয়ে উঠতেন।
প্রশ্ন: হ্যারি নেলসনের গাওয়া, 'এভরিবডি ওয়াজ টকিং অ্যাট মি, সো আই কুড নট হিয়ার দি ইকোস অব মাই মাইন্ড।'
ইনারিতু: এ তো সত্যিই এক অসামান্য সৃষ্টি। যতবারই ছবিতে গানটা শুনেছি, তখনই স্মৃতি ও বেদনায় তাড়িত হয়েছি। ছবির চরিত্রদের সঙ্গে গভীর নৈকট্য অনুভব করেছি, যেন তারা আমার বন্ধু। তখনও বুঝতে পারিনি এই একটি ছবি আমার ভেতরে এতোটা পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
আরও যেসব ছবিকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, সেগুলি হচ্ছে তুরস্কের পরিচালক সেরিফ গোরেনের ছবি ইওল (পথ, নির্মাণকাল ১৯৮২); সেরিফ ছিলেন প্রখ্যাত নির্মাতা ইলমাজ গুণে'র সহকারী, ছবির প্রডাকশনের সময় তিনি জেলবন্দি ছিলেন। ছবির গল্পটি সেইসব লোকদের নিয়ে যারা সে সময় তুরস্কের বিভিন্ন জেলে বন্দি ছিল। আমার মতে 'ইওল' একটি অসামান্য চলচ্চিত্র, যা আপনাকে সত্যিকার অর্থে তাড়িত করবে। কান উৎসবে ছবিটি স্বর্ণপাম জিতে নেয়। তুরস্কে ছবিটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, সরকারের সমালোচনা করার কারণে।
এমন আরেকটি দুর্দান্ত ছবি সার্জিও লিওনির 'ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আমেরিকা'। এ ছবিটি আমাকে নাড়িয়ে দেয়। ছবিটি আমি টানা ১৭বার দেখি, ফলে প্রতিটি দৃশ্য আমার মুখস্ত হয়ে যায়। ছবিতে ইতালিও কম্পোজার এনিও মোরিকনের সঙ্গীত ছিল আচ্ছন্ন করে দেওয়ার মতো। ছবিটি এক কথায় ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিট দৈর্ঘ্যের মহাকাব্য। ইসরাইলি পরিচালক আর্নন মিলশন, একদম তরুণ বয়সে যিনি 'দ্য রেভানেন্ট' বানিয়েছেন, তিনি বলেন- সার্জিও লিওনির ছবির টুকরো টুকরো গল্পগুলি আমাদের জীবনে কীভাবে বিপর্যয় নেমে আসে, তারই বর্ণনা। '৮২-তে নির্মিত আরেকটি ছবির কথা বলি, রিডলি স্কটের ব্লেড রানার, যা আমাকে তীব্র ঝাঁকুনি দেয়। তবে, সব ছাপিয়ে যে-ছবির কথা আমার সবচে বেশি মনে পড়ে সেটা ছিল খুব, খুবই শক্তিশালী- ফেদেরিকো ফেলিনির 'সাড়ে আট' (নির্মাণকাল- ১৯৬৩)। এই ছবি দেখানোর জন্য বাবা আমাকে হলে নিয়ে গিয়েছিলেন যা দেখে মনে হয়েছিল পৃথিবীর বাইরে কোথাও শাদা-কালোয় ছবিটি তৈরি হয়েছে; এবং, এ পর্যন্ত আমি যা কিছু দেখেছি তার থেকে একদম, একেবারে ভিন্ন এ ছবি; যদিও আমি ছবির অনেক কিছুই বুঝতে পারিনি, কিন্তু ফেলিনি তার ছবির ভেতর যে-জগতটি তৈরি করে দিয়েছিলেন, সে জগতে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: এভাবে কাজ চলতে চলতে একদিন আপনার 'আমোরেস পেরোস' ছবিটি বানানো হয়ে যায়!
ইনারিতু: '৯৫-এ আমি যখন টিভি সিরিজ 'দ্য পাইলট'-এর স্ক্রিপ্ট লিখছিলাম, তখন জীবনে প্রথমবারের মতো কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিও পরিচালনা করছিলাম। ঠিক তখন থেকে নিজের প্রতি কঠোর হতে শুরু করলাম। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম- ছবি বানাব। তখনই গিলারমো অ্যারিয়াগার সঙ্গে চেনাজানা হলো। দু-জনে মিলে প্রথম ছবির চিত্রনাট্যের কাজ শুরু করলাম, তখন আমার বয়স ৩৬ বছর, মোহিকোয় থাকি। চলচিত্রের কোনও উৎসবে যাওয়ার সুযোগ তেমন একটা হয়নি। তবে, আমি ভাগ্যবান যে এমন কিছু বন্ধু পেয়েছিলাম যারা সত্যিকার অর্থেই সৃষ্টিশীল মানুষ। কিন্তু আমার সময়ে এমন অনেক ছবি নির্মাতা ছিলেন তারা রাজনীতি ও ক্ষমতার কারণে তাঁদের কাজটি ঠিকঠাক করতে পারেননি, ক্ষমতার স্টুপিডিটির কারণে নিগৃহীত হয়েছেন, গুলেরমো দেল তরো'র মতো মানুষরা যার শিকার। এক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবান যে ছবির কাজ করতে গিয়ে এমন সব মানুষকে কাছে পেয়ে গেলাম যারা সত্যিকার অর্থেই আমাকে বুঝতে পেরেছিলেন, আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে ধরতে পেরেছিলেন। তারা কখনই আমাকে কিছু করতে চাপ দিতেন না যা আমি পছন্দ করতাম না। আর, যদি ছবিটি ব্যর্থ হতো তো সমস্ত দায় আমি নিজের কাঁধে নিতাম, মনে করতাম- আমারই ভুলে ছবিটি ব্যর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন: তারপর '২১ গ্রামস' করলেন, তো, এমন কোনও নির্মাতা কি আছেন যার কাছে ছবির ব্যাপারে পরামর্শ চান?
ইনারিতু: এমন কারও কথা বলতে হলে আমি মাইকেল ম্যানের কথাই বলব। সত্যি বলতে কী, তিনি এমন এক পরিচালক একমাত্র যার সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছি।
প্রশ্ন: আপনি এমন সব লোকদের নিয়ে কাজ করেন, যারা অভিনয় জগতের বাইরের লোক, দ্য রেভ্যানেন্ট-এ যেমন দেখেছি?
ইনারিতু: হ্যাঁ, এ ছবির অনেকেই পেশাদার শিল্পী ছিলেন না। কারণ, দৃশ্য নেওয়ার জন্য যে যেখানে আমাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সেখানে ছিল আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসতি- শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসায় পূর্ণ কানাডার আদিবাসী সম্প্রদায়। আমরা ছবি করতে এসেছি জেনে খুশি হলেন তারা। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তারা আমাদের গ্রহণ করলেন। সেখানকার ল্যান্ডস্ক্যাপ দেখে তো আমি অস্থির হয়ে ভাবছিলাম- দুনিয়ায় এখনও এমন জায়গাও আছে যাকে শিল্পায়নের আওতায় আনা হয়নি, যে-জায়গাকে এখনও অবিকল রেখে দেওয়া হয়েছে! মানুষ যাকে নষ্ট করতে পারেনি! মানুষের হাতে নষ্ট হয়নি এমন জায়গা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া সত্যিই কত কঠিন! কানাডার আদিবাসী অঞ্চলটিতে এমন আশ্চর্য এক সূর্যকে পেয়েছিলাম আমার ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে যা অনেকটাই মিলে গিয়েছিল।
প্রশ্ন: দৃশ্যধারণের জন্য দিনের শুরু নাকি অপরাহ্ণের পড়ন্তবেলাকে বেছে নিয়েছিলেন?
ইনারিতু: না না, বেশ বেলা করে, সূর্যাস্তের পূর্ববর্তী শেষ সময়টায় আমরা কাজ করতাম; ছবির প্রতিটি একক দৃশ্য একেবারে পূর্বনির্ধারিত ছিল, বহুবার রিহার্সেলও করেছিলাম আমরা। এমনকি চরিত্রদের চলাফেরা, অভিব্যক্তি আর ক্যামেরার অবস্থান সবই পূর্বনির্ধারিত ছিল। একদম মাপা। হিসেব করা। তারপর, একসময়, যেমনটি প্রত্যাশা করছিলাম, এক সময় সূর্য এমন এক অবস্থানে চলে এল...ভাগ্য ভাল হলে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যধারণের জন্য প্রতিদিন আমরা এক থেকে দেড়ঘণ্টা, বেশি হলে দু'ঘণ্টা সময় পেতাম। দিনের পর দিন আমরা এই সময়ের মধ্যেই কাজ করতে পেরেছি। দৃশ্যের জন্য এমন একটি দিনও আমরা পাইনি যেখানে সকালের দিকে কাজ শুরু করা যায়। প্রতিটি দিনই ছিল একটি ঘড়ির মতো 'টিক টিক টিক' প্রচণ্ড উত্তাপে যা বিস্ফোরিত হতে চলেছিল!
প্রশ্ন: আপনার ছবিগুলোয়, সঙ্গীত এমন এক অনন্যতা তৈরি করে, আবার কী এক দোলাচল, বিশেষ করে বাবেল-এ, যেখানে দর্শক সংশয়ে পড়ে যাচ্ছে, কাহিনির মাত্রায় কেমন এক গোলকধাঁধা... যেখানে আপনার অন্তর্জগৎ...
ইনারিতু: বাবেল... আপনি তখনই কিছু করতে পারবেন যখন দেখবেন নিজের ভেতরে কোনও কিছু করার ইচ্ছের জন্ম হয়েছে। নির্মাতা হিসেবে আপনি দেখবেন, অভিনয় শিল্পীরা পরিচালকের কাছ থেকে কিছু একটা চাইছে, এই চাওয়াকে আপনার বুঝতে হবে। জুডি ওয়াটসনের কাছে আমি এই ব্যাপারে শিখেছিলাম। ফলে, শিল্পীদের কাছ থেকে তাদের সেরাটা আমি পাচ্ছিলাম। অভিনেতার ভেতর থেকে সেরা কাজটা বের করতে পারছিলাম। আবার, দেখুন, আমি কিন্তু রিহার্সেলে বিশ্বাসী। চূড়ান্ত দৃশ্য ধারণের আগে আমরা বার বার দৃশ্যগুলি নিয়ে কাজ করতাম। এ নিয়ে বিতর্ক আছে বিস্তর; আমি মনে করি, চূড়ান্ত দৃশ্যের ধারণে প্রস্তুতিটা খুব সাহায্য করে, অভিব্যক্তি প্রকাশের সঙ্গে চরিত্ররা তাদের সংলাপগুলি মনে করতে পারে, ভুলে যায় না, প্রতিটি শব্দ তার মনে থাকে; ক্যামেরার সামনে তখন একটি অসামান্য জগৎ তৈরি হয়। এভাবে আমি জেনেছিলাম কীভাবে এক একটি দৃশ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায়; আর এসব অভিজ্ঞতাকে পরের ছবি- বার্ডম্যান এবং দ্য রেভেন্যান্ট-এ কাজে লাগাচ্ছিলাম। শিল্পীদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলাম আরও গভীরভাবে। অভিনেতা যেন দৃশ্যের শিকারে পরিণত না হয়, সে যেন একাকার থাকে, ডুবে যায়, যেন তারা কাদামাটি ছানছে, যেন মাটি থেকে জন্ম হচ্ছে- এমনই আত্মমগ্ন যেন তারা পূর্ব থেকেই কোনও একটি স্থানে বিরাজ করছিল।
চোখ বন্ধ করে আমি একটি স্থানকে কল্পনা করি, আলোর কথা ভাবি, ভাবতে থাকি অভিনেতা যে-শব্দগুলি উচ্চারণ করবে তার কথা, আর একজন থেকে আরেকজনের অবস্থাগত দূরত্ব। তারপর ভাবতে থাকি দৃশ্যে চরিত্রটি কি বসে বসে কথা বলবে? না কি, দৃশ্যধারণকালে তারা দাঁড়িয়ে কথা বলবে? অভিনেতার অবস্থানগত দূরত্ব কিন্তু বিশাল ব্যাপার, যার সঙ্গে তাঁদের পরস্পরের সম্পর্ক এবং পুরো দৃশ্যের শক্তি নির্ভর করে। এজন্য, পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হয় যাতে এইসমস্ত প্রশ্নের উত্তর ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। তখন ক্যামেরাও আর ভুল পথে এগোয় না, ছবির প্রয়োজনীয় আলোও যথার্থ মাত্রায় ফুটে ওঠে। বার্ডম্যানের দৃশ্যধারণের সময় যখন দরকার হলো লং টেক, তার আগেই আমাদেরকে ভালো করে রিহার্সেল করতে হয়েছিল যাতে অভিনেতার মনে হয় আমরা চূড়ান্ত দৃশ্যের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু দ্য রেভেন্যান্ট-এ লং টেকের সুযোগ ছিল না, এক একটি দৃশ্যের জন্য কয়েক মিনিট করে বরাদ্দ ছিল, আবার ছিল মনোলগ। এক একটি চরিত্র তাদের মনের কথাগুলি মিনিটের পর মিনিট ধরে বলে চলেছে, আবার সে নড়াচড়াও করছে। তখন অভিনেতাদের বার বার মনে হচ্ছে যে কোনও ভুলের কারণে দৃশ্যগুলো মরে যেতে পারে। দৃশ্য ধারণের এই সব সৌন্দর্যের জন্য হঠাৎ আমার মাথায় এক আইডিয়া এল। আমি একসঙ্গে দুটো ব্যাপার করতে শুরু করলাম- থিয়েটার এবং চলচ্চিত্রকে এক সঙ্গে অর্থাৎ একাকার করে কাজ শুরু করলাম। মঞ্চে নাটকের প্রস্তুতিকালে এমনভাবে সব কিছু চলে, নির্দেশকের এমন নিয়ন্ত্রণ থাকে যে কোথাও কোনও ছন্দপতন হওয়ার সুযোগ থাকে না, যেন একটি ঘড়ি। ফলে, আপনার চরিত্ররা ঠিক যেন দর্শকের সামনে মঞ্চে অভিনয় করছে, শুধু তাঁদেরকে ধারণ করতে এদিক সেদিক চালু রয়েছে কয়েকটি ক্যামেরা। পুরো ব্যাপারটিকে মনে হবে টান টান একটি রশির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। সব সময় ভেতরে একটা ভয় কাজ করবে। ভেতরে ভয় না নিয়ে কাজ করলে সে কাজটি হয়ে যাবে গতানুগতিক। চলচ্চিত্র প্রেমের মতো। আর প্রেম ভেতরে সারাক্ষণ ভয় জাগিয়ে রাখে, কারণ আপনাকে ডুবতে হবে, পতনও হবে, আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন; নিজেকে সমর্পনও করতে হবে, একই সঙ্গে আপনাকে ভীত এবং সাহসী হতে হবে। এভাবে আমাদের এক একটি ছবির দৃশ্যধারণ শেষ হয়, আর আমার কেবল স্মৃতিগুলি মনে পড়তে থাকে। যে আনন্দ, যে উত্তেজনার ভেতর দিয়ে আমরা এগিয়ে গেছি, সব কিছু মনে পড়তে থাকে। এভাবেই আমি খুঁজে পেয়েছি ছবি বানানোর সবচেয়ে আনন্দময় পদ্ধতিটি, যা নরকের মতো ভয়ংকর হলেও কাজ করবার জন্য সহজ।
প্রশ্ন: আপনি ডিস্ক জকি হিসেবে রেডিওয় কাজ করেছেন; গান নিয়েই মেতে থাকতেন, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও বহুদিন কাজ করেছেন। সঙ্গীত আপনার মধ্যে চলচ্চিত্রের চেয়েও বেশি আধ্যাত্মবোধের জন্ম দেয়- আপনাকে এ কথা বহুবার বলতে শুনেছি!
ইনারিতু: হ্যাঁ, আমি ডিজে, হোস্ট এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে পাঁচ বছর কাটিয়েছি- বিশ্বের বৃহত্তম শহরের সবচে বড় রেডিও স্টেশনে; সত্যিই জমকালো ছিল ব্যাপারটা, যেখানে গল্পকথা, সুর এবং তাল দিয়ে শ্রোতাদেরকে দিনে কমপক্ষে তিনঘণ্টা ধরে রাখতে হতো। আমাকে শিখে নিতে হয়েছিল মানুষকে ধরে রাখার কৌশল। সেজন্য আমাকে গল্প বানাতে হয়েছে, কৌতুককর চরিত্র সৃষ্টি করতে হয়েছে, রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে হাস্যরস ও উত্তেজনা তৈরি করতে হয়েছে, তাতে বিদ্রুপও ছিল, ফলে সরকার আমাদের সম্প্রচার বাতিল করেছে বেশ কয়েকবার। এভাবে দিনে দিনে আমি রপ্ত করে ফেলি কেবল সৃজনকল্পনা ব্যবহার করে কীভাবে মানুষের আগ্রহ ধরে রাখা যায়, কল্পনার যেখানে কোনও সীমা পরিসীমা নেই। কল্পনা যতদূর যায়, ঠিক ততোটাই গল্প তৈরি হয়, ততোই মানুষ আরও অপেক্ষা করে, আরও গভীর জীবন রহস্যের মুখোমুখি হতে চায়। কিছু বলবার এ এক দারুণ কৌশল।
আর সঙ্গীত, হ্যাঁ, সঙ্গীত এমন এক ব্যাপার যা সরাসরি পৌঁছে যেতে পারে, কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয় না। ভাষা নেই, শব্দ নেই, ইন্টেলেকচুয়ালিটি নেই, ভাবুন, কী অদ্ভুত উপায়ে, সঙ্গীত সরাসরি আপনার কাছে যেতে পারে; শব্দের মাধ্যমে নয়, খেলার মাধ্যমে নয়, আপনি কতটা স্মার্ট- তার মাধ্যমে নয়, এমনকি ভাষার মাধ্যমেও নয়। যদি চলচ্চিত্র এবং শিল্পের কোনও সীমানা না থাকে, তবে আমি মনে করব যে একমাত্র সঙ্গীতই আধ্যাত্মিক; সঙ্গীতকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। এ এমন এক ব্যাপার, এমন একটা কিছু যাকে আপনি শুধু আত্মায় অনুভব করছেন।
যখন বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চেয়েছি, বা গল্পকার, তাৎপর্যপূর্ণ সে-মুহুর্তটিতে আমি প্রথমবার শুনে ফেলি পিঙ্ক ফ্লয়েডের 'দ্য ডার্ক সাইড অফ দ্য মুন'; তারপর যখন জেনেসিসের 'দ্য ল্যাম্ব লাইস ডাউন ব্রডওয়ে' শুনলাম, যখন আমি ইয়েসোংস-এর অদ্ভুত কম্পজিশনগুলি শুনলাম, শুনলাম প্যাট মেটেনির কম্পোজিশন 'অ্যাজ ফলস উইচিটা, ফলস উইচিটা ফলস' কিংবা মোটাউন দলের অনন্য সুরের রেকর্ডগুলো, আমার তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে মুহুর্মুহু যেন সঙ্গীত বিপুল প্রবাহে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। মনে হলো, আমাকে ছবি বানাতে হবে।
অক্ষর, শব্দ, কিংবা কোনও একটি গল্প নয়, যা আমাকে প্রথমে প্রভাবিত করেছিল, তা হলো সঙ্গীতের আবেগ। আমি উপলব্ধি করলাম আমার সমস্ত আবেগ, সমস্ত অনুভূতি এবং প্রবণতাকে সঙ্গীত যেন কিছু একটা করতে উস্কে দিচ্ছে, সঙ্গীতের ভেতর দিয়ে প্রকাশ হতে চাইছে। পৃথিবীকে আমি বুঝতে পারলাম সুর, লয়, তাল এবং ছন্দের মাধ্যমে। আসল কথাটি হলো- সঙ্গীতই আমাকে ছবির জগতে টেনে এনেছে!