সায়েন্স ফিকশন
Science Fiction—বাংলায় 'কল্পবিজ্ঞান' বা 'বিজ্ঞান কল্পকাহিনি'। ইংরেজি শব্দযুগলটির জন্ম ১৮৫১ সালে, উইলিয়াম উইলসনের কলম থেকে। তবে শব্দ দুটো জনপ্রিয় করে তোলেন হুগো গার্নজব্যাক। প্রথম আমেরিকান সায়েন্স-ফিকশন ম্যাগাজিন 'অ্যামেজিং স্টোরিজ'-এর প্রথম সংখ্যায় তিনি প্রথম 'সায়েন্টিফিকশন' শব্দটি ব্যবহার করেন। সেই থেকে কালের বিবর্তনে শব্দটি হয়ে উঠেছে 'সায়েন্স ফিকশন'।
সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান বলতে মূলত সেসব কাহিনিকে বোঝায়, যেগুলোতে বিজ্ঞানের সাথে কোনো কাল্পনিক গল্পকে মিশিয়ে উপস্থাপন করা হবে। অর্থাৎ, বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়ে যে সাহিত্য রচনা করা হয়, তা-ই কল্পবিজ্ঞান। অতএব, সায়েন্স ফিকশনে বিজ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে। সায়েন্স ফিকশনের গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে স্বীকৃত আইজ্যাক আজিমভের মতে, যুক্তি দিয়ে বিজ্ঞানকে গল্প লেখার কাজে ব্যবহার না করলে সত্যিকারের কল্পবিজ্ঞান সৃষ্টি সম্ভব নয়।
কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান কিছু উপাদান হচ্ছে উন্নততর প্রযুক্তির, ভবিষ্যতের পৃথিবীর সম্ভাব্য রূপ, সময় ভ্রমণ, বহির্জাগতিক প্রাণ প্রভৃতি। সাহিত্যের এই শাখাটিকে বলা হয় 'লিটারেচার অফ আইডিয়াস'।
বিশ্বসাহিত্যে প্রথম সায়েন্স ফিকশন গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত মেরি শেলি-র 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন'। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালে। এরপর জুলে ভার্ন এ ধারার লেখালেখিকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যান। তবে বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্যকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে প্রথম সায়েন্স ফিকশন লেখার কৃতিত্বটি 'টাইম মেশিন'-খ্যাত এইচ. জি. ওয়েলসের। তার পর এ সাহিত্যের শাখাকে সমৃদ্ধ করেন আইজ্যাক আজিমভ, রবার্ট এ. হাইনলাইন, ফিলিপ কে. ডিক, আর্থার সি. ক্লার্ক, রে ব্র্যাডবেরি, ফ্রাঙ্ক হারবার্ট, উইলিয়াম গিবসন, ডগলাস অ্যাডামস প্রমুখের মতো জাঁদরেল লেখকরা।
বাংলা সাহিত্যে সায়েন্স ফিকশন
বাংলা ভাষায় সাহিত্যের এ শাখাটি ক্ষীণস্বাস্থ্য হলেও, পৃথিবীর এ অংশে সায়েন্স ফিকশন লেখা হয়েছিল কিন্তু বেশ আগেই। অবিভক্ত বাংলায় প্রথম উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক জগদানন্দ রায় (১৮৬৯-১৯৩১)। তার লেখা 'শুক্র ভ্রমণ' বইটির কাহিনি ছিল পৃথিবীর বাইরের এক গ্রহে যাত্রার আখ্যান। তার এ বইটি প্রকাশ হয় এইচ. ওয়েলসের 'ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস' প্রকাশেরও প্রায় ১০ বছর আগে, ১৮৭৯ সালে। গল্পটা অবশ্য লেখা হয়েছিল তারও ১১ বছর আগে, ১৮৫৭ সালে।
তবে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জনক বলে ধরে নেয়া হয় প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে। ১৮৯৬ প্রকাশ হয় তার লেখা গল্প 'পলাতক তুফান'। আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রণের এই কাহিনি বাংলা ভাষায় রচিত বিজ্ঞান কথাসাহিত্যের মধ্যে অন্যতম। ছোট্ট এক বোতল চুলের তেল ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড় থেকে মুক্ত হওয়া ছিল এ গল্পের বিষয়বস্তু।
সত্যজিৎ রায় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রটি নিয়ে তিনি অনেকগুলো বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখেছেন। 'আং' উপজাতিকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন 'দ্য এলিয়েন' নামের একটি কাহিনি। এছাড়াও কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে অবদান রেখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, লীলা মজুমদার, অদ্রীশ বর্ধন, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ। বাংলা ভাষায় প্রথম কল্পবিজ্ঞান ম্যাগাজিন 'আশ্চর্য', প্রথম প্রকাশ ১৯৬৩। ম্যাগাজিনটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সত্যজিৎ রায়, প্রধান উপদেষ্টা প্রেমেন্দ্র মিত্র, এবং সম্পাদক অদ্রীশ বর্ধন (আকাশ সেন ছদ্মনামে)।
বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের ইতিহাসে জায়াগা করে নিয়েছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনও। কাহিনিটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় মাদ্রাজের 'দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন'-এ, ১৯০৫ সালে। এ বইয়ে রোকেয়া একটি নারীবাদী স্বপ্নরাজ্য নারীস্থানের বর্ণনা দিয়েছেন। সে রাজ্যে নারী ও পুরুষের প্রচলিত ভূমিকা উল্টে গেছে। এ সমাজে নারীরা সমাজের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান চালিকাশক্তি আর পুরুষেরা প্রায় গৃহবন্দি। এই সমাজে কোনো অপরাধ নেই, এখানে প্রচলিত ধর্ম 'ভালোবাসা ও সত্যের'। 'সুলতানার স্বপ্ন ' বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে ধ্রুপদী নারীবাদী কল্পকাহিনির প্রাচীনতম উদাহরণ। রোকেয়ার এ লেখাটিকে তুলনা করা যায় আরেক বিখ্যাত নারীবাদী সায়েন্স ফিকশন লেখিকা উরসুলা কে. লে গুইনের লেখাগুলোর সঙ্গে।
বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশন
পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় প্রথম সায়েন্স ফিকশন লেখেন কাজী আবদুল হালিম। বইটির নাম ছিল 'মহাকাশের কান্না'।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সায়েন্স ফিকশন লেখার সম্মানটি ঝুলিতে ভরেছেন হুমায়ুন আহমেদ। তার লেখা, ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত 'তোমাদের জন্য ভালোবাসা' বইটির মাধ্যমেই বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে সর্বপ্রথম সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানকে খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর তিনি লিখে ফেলেন 'ইরিনা', 'তারা তিনজন', 'অনন্ত নক্ষত্র বীথি', 'কুহক', 'ওমেগা পয়েন্ট', 'ফিহা সমীকরন', 'নি', 'শূন্য'-সহ বেশ কিছু সায়েন্স ফিকশন। প্রায় সবকটি বই-ই পাঠক সমাদৃত হয়।
হুমায়ুন আহমেদেরই প্রায় সমসাময়িককালে সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা'য় প্রকাশিত হয় 'কপোট্রনিক ভালবাসা' নামে একটি সায়েন্স ফিকশন গল্প। গল্পটি প্রকাশ হবার পর কেউ কেউ অভিযোগ তোলেন এটি বিদেশি গল্প থেকে টুকে দেওয়া। লেখক তখন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ। ভাবলেন এর প্রতিবাদে একটা লেখা লিখবেন। শেষ পর্যন্ত তা আর করলেন না। তবে বিদেশি গল্পের অনুকরণ না করেই যে বাংলায় সায়েন্স ফিকশন লেখা সম্ভব তা প্রমাণ করার জন্য 'কপোট্রনিক' নামে সিরিজ আকারে পরপর আরও বেশ কিছু গল্প লিখে ফেললেন। অভাবনীয় জনপ্রিয়তা কুড়ায় লেখাগুলো। তরুণ সেই লেখকটির নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। 'বিচিত্রা'য় প্রকাশিত গল্পগুলো পরবর্তীতে মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে 'কপোট্রনিক সুখ দুঃখ' নামে প্রকাশ পায়। সেই থেকে শুরু মুহম্মদ জাফর ইকবালের জয়রথ।
কল্পনানির্ভরতা কাটিয়ে বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর কল্পবিজ্ঞানের প্রচলনের অগ্রপথিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এ ছাড়াও পৃথিবী নামক গ্রহের অধিবাসী মানুষের মধ্যে যন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মানবতা নামক গাঢ় উপলব্ধির নির্যাসটুকু এত মানবিক বোধ দিয়ে উজ্জ্বল করে তোলা কল্পবিজ্ঞান লেখায় আর কেউ বোধহয় তার ধারেকাছেও নেই। বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশন জগতের সবচেয়ে বড় জায়গাটি দখল করে রেখেছেন তিনি। প্রায় একা হাতে বাংলা সাহিত্যের এ ক্ষীণ ধারাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল উপহার দিয়েছেন 'বিজ্ঞানী সফদর আলির মহা মহা আবিষ্কার', 'ওমিক্রনিক রূপান্তর', 'ক্রুগো', 'ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম', 'ক্রোমিয়াম অরণ্য', 'ত্রিনিত্রি রাশিমালা', 'নয় নয় শূন্য তিন', 'বেজি', 'ইকারাস', 'কেপলার টুটুবি' 'ফোবিয়ানের যাত্রী'-র মতো পাঠকপ্রিয় সব সায়েন্স ফিকশন।
বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিনের নাম 'মৌলিক'। আহসান হাবীব ও হাসান খুরশীদ রুমী ১৯৯৯ সালে এটি প্রকাশ করেন। ম্যাগজিনটি অবশ্য তিন বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশন জগতে পাকা আসন করে নিতে পারতেন আরেকজন লেখক—তার নাম স্বপন কুমার গায়েন। তার লেখা 'স্বাতীর কীর্তি', 'বার্ণাডের তারা' বইগুলো বেশ পাঠকপ্রিয় হয়েছিল।
বর্তমান সময়ে সায়েন্স ফিকশন লিখে বেশ পাঠকপ্রিয় হয়েছেন দীপেন ভট্টাচার্য। জ্যোতির্বিদ, অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্যের লেখায় পাওয়া যায় বিজ্ঞানের আধিক্য। তার লেখাগুলো টেকনিক্যাল দিক থেকে বেশি সমৃদ্ধ, এবং ফ্যান্টাসি থেকে একদমই মুক্ত। তার লেখা 'দিতার ঘড়ি', 'নক্ষত্রের ঝড়', 'অভিজিৎ নক্ষত্রের আলোয়' বইগুলো পাঠক-সমালোচক দুই মহলেই দারুণ সমাদৃত হয়েছে। বলা চলে বাংলা সায়েন্স ফিকশনের হার্ড সায়েন্স ফিকশন শাখার ঝাণ্ডা এখন দীপেন ভট্টাচার্যের হাতে।
বলা হয়, আজকের কল্পবিজ্ঞান আগামীকালের বিজ্ঞান। বাংলা সাহিত্যের সায়েন্স ফিকশন শাখায় এই সেদিনও দাপটের সাথে রাজত্ব করছিল ফ্যান্টাসি বা ফিকশন, সায়েন্সের ভূমিকা দুর্বলই ছিল। বিজ্ঞানবর্জিত কল্পবিজ্ঞানের সেই ধারা এখন পাল্টাচ্ছে। আধুনিক কল্পবিজ্ঞান লেখকরা ফ্যান্টাসি ছেড়ে বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকছেন বেশি করে, সেইসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সায়েন্স ফিকশনের পাঠক।