সায়েন্স ফিকশন: কল্পলোকের গল্প যখন বাস্তব
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম সায়েন্স ফিকশন
এ রকম একটি বিষয় দিয়েই লেখাটি শুরু করতে চাই। সবচেয়ে ছোট বিজ্ঞান কল্পকাহিনী কোনটি?
হাজার পাচেক ভাষা ছেকে এটা বের করা মুশকিল। তবে ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে ছোট সায়েন্স ফিকশনটি হচ্ছে Knock, মানে টোকা।
The Last man on earth sat alone in a room. There was a knock on the door...
পৃথিবীর শেষ মানুষটি একলা একটা কক্ষে বসে আছে। দরজায় টোকা পড়ল... ইংরেজি ষোল শব্দের গল্প এগারো বাংলা শব্দে অনুবাদ করলাম। এখানে গল্প কোথায় আর বিজ্ঞান কোথায়?
বসে থাকা মানুষটিই পৃথিবীর শেষ মানুষ। তাহলে টোকা দিল কে? সব লেখকই শেষ পর্যন্ত তার গল্পটা ঠেলে দেন পাঠকের কল্পলোকে। গল্পটা পাঠক নিজের মতো করে বানিয়ে নেন কিংবা নিজের গল্পের সাথে মিলিয়ে নেন।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছয় শব্দের গল্পটি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গল্প হিসেবে সমাদৃত, সেটি মানুষের জীবনের যাতনার গল্প।
ক্ষুদ্র সায়েন্স ফিকশনটি লিখেছেন ফ্রেডি ব্রাউন। গল্পটি ছাপা হয় ১৯৪৮-এর ডিসেম্বর মাসে। ফ্রেডি ব্রাউন ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭২ সালে মারা যান। তার ছোট গল্প 'অ্যারেনা'র উপর ভিত্তি করে 'স্টার সিরিজের একটি এপিসোড রচিত হয়েছে। তার 'দ্য স্ক্রিমিং মি' ১৯৫৮ সালে হলিউডে সিনেমা হয়েছে।
অ্যান্থনি বার্জেসের কথা বলতে হয়। তার ৭ শব্দের গল্পটি জীবদ্দশায় ছাপাই হয়নি, মানে তিনিই দেননি। শিরোনামহীন গল্পটি হচ্ছে : That morning the sun rose in the west. সেদিন সকালে সূর্য পশ্চিমে উঠেছে। ইংরেজির ৮ এবং বাংলার ৫ শব্দের এই গল্পটি নিয়ে কল্পলোকে অনেক গল্পই সাজানো যায়।
অ্যান্থনি বার্জেসের জন্ম ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ডে, মৃত্যু ২২ নভেম্বর ১৯৯৩; তিনি বড় লেখক, নোবেল পুরস্কারের জন্যও তার নাম এক সময় প্রস্তাবিত হয়েছে।
নাক উঁচু পাঠকের জন্য
কেবল পাঠকের নয়, লেখকের নাকও উঁচু হতে পারে। নাক উঁচু হলে কথিত মূল ধারার বাইরের জন্য যে কোনো ধারার লেখককে ছোট চোখে দেখেন। ২০২০-এ নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত অনেক নামের মধ্যে স্টিফেন কিং-ও ছিলেন। তার উপর যারা বাজি ধরেছেন তারা তার অবস্থান তিরিশের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। যদি লুইস গ্লিকের বদলে স্টিফেন কিং-এর নাম ঘোষিত হতো নোবেল বিজয়ী হিসেবে, সুইডিশ একাডেমির বিরুদ্ধে শেইম শেইম রব উঠত। তবে নোবেল বিজয়ী কথিত মূল ধারায় থেকেই যদি কোনো লেখক দু'একটা সায়েন্স ফিকশন লিখেন তাহলে সম্ভবত সমস্যা নেই। তালিকাটি দেখুন, নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে কারা কারা সায়েন্স ফিকশনও লিখেছেন। রুডিয়ার্ড কিপলিং ১৯০৭, গেরহার্ড হাউপ্টম্যান ১৯০২, আনাতোল ফ্রঁসে ১৯২১, উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ১৯২৩, জর্জ বার্নার্ড শ ১৯২৫, সিঙ্কলেয়ার লিউইস ১৯৩০, লুইজি পিরান্দেল্লো ১৯৩৪, ইউহানেস জেনসেন ১৯৪৪, হারমান হেসে ১৯৪৬, বারট্রান্ড রাসেল ১৯৫০, উইনস্টন চার্চিল ১৯৫৩, হেরি মার্টিনসন ১৯৭৪, সল বেলো ১৯৭৬, চেশোয়াভ মিয়োশ ১৯৮০, নাদিন গর্দিমার ১৯৯১, হোসে সারামাগো ১৯৯৮, গুন্টার গ্রাস ১৯৯৯, জে এম কোয়েতজি ২০০৩, ডোরিস লেসিং ২০০৭, জে এম জি লে ক্লেজিও ২০০৮, কাজুও ইসিগুরো ২০১৭।
সায়েন্স ফিকশনকে খানিকটা হেয় চোখে দেখার কারণটা কি? মার্কাস গেডুল্ড একালের লেখক ও পাঠক। তার বাবা ইংরেজির অধ্যাপক, ছোট বেলাতেই ছেলের হাতে শেক্সপিয়র এবং জোসেফ কনরাড ধরিয়ে দিয়েছিলেন; অবশ্য অধ্যাপক সাহেব এইচ জি ওয়েলস ও সি এস লিউইসের লেখাও পছন্দ করতেন। সায়েন্স ফিকশন শুনলেন একালে অনেকের নাক কুঞ্চিত হয়-- ওহ বুঝেছি রোবট, কিংবা ওহ এলিয়েন নাকি?
মার্কাস বললেন কথিত শুদ্ধ লেখকদের প্রতিযোগিতা তার পছন্দের নয়, সাহিত্যকে নোবেল পেলেন আর কে পেলেন না তাতে তার কিছুই এসে যায় না। সায়েন্স ফিকশন তার প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছে না, এতেও তার মাথা ব্যথা নেই। তিনি কথিত মূল ধারার লেখার চেয়ে সায়েন্স ফিকশন বেশি পছন্দ করেন। কেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকে 'ডাউন প্লে' ধরা হয় তিনি তার কিছু কারণত্ত দেখাচ্ছেন :
গুরূত্ব পাওয়া : স্টিফেন কিং না বলে ফিলিপ রথের নাম বললে বেশি গুরুত্ব পাওয়া যায়--বুদ্ধিজীবী ধরনের লোকের কাছে।
ঐতিহ্যের স্থিতিজড়তা : মানুষ ডিকেন্স জেন অস্টিন ধরনের লেখকের বই পড়ে আসছে, ভিন্ন ধারার বইয়ের লেখকের নাম নেবে না পড়বেও না।
সায়েন্স ফিকশনে প্রবেশাধিকার : স্কুল পাঠ্য ডিকেন্স, অস্টিন, স্টাইনবেক সুতরাং এই বৃত্ত থেকে বেরোবার সুযোগ কম।
ক্রাইম থ্রিলার, রোমাঞ্চ, সায়েন্স ফিকশন : এসব সাধারণ পাঠকের পাঠ্য এসব লাখে লাখে বিক্রয় হয়, ভালো জিনিস তো এতো বিক্রি হবার কথা নয়-- এটা সাধারণ মনস্তত্ত্ব।
সায়েন্স ফিকশনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনক জুলে ভার্ন-এর একটি আক্ষেপ সায়েন্স ফিকশন সম্পর্কে, এবং লেখকদের সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক চরম উপেক্ষাকে তুলে ধরে। মৃত্যুর আগে জুলে ভার্ন বলেছেন এবং লিখেছেন, আমার নাম না থাকাতে ফরাসি সাহিত্যের কিছুই আসে বা যায় না। ফরাসি একাডেমির সদস্যপদ লাভের জন্য তিনি বহুবার আবেদন করেছেন, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন প্রতিবার।
সায়েন্স ফিকশন থেকেই আবিষ্কার
সায়েন্স ফিকশন লেখকের কল্পলোকের ভেতরে ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট নয়; অনেকটাই স্পষ্ট, সে স্পষ্টতা বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে নেই। ডগলাস অ্যাডামস লিখেছেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখকই পারেন আমাদের ভিন্নজগতে পরিবহন করে নিয়ে যেতে, অন্যকারো সে সামর্থ নেই। তার পক্ষেই অচিন্তনীয় বিষয় নিয়ে চিন্তা করা সম্ভব। 'সময়' নিয়ে এতো ভালো করে কেউ খেলতে পারে না, সময়ের আগে চলা সনাতন মানুষের কাজ নয়। আইজাক অ্যাসিমভ বলেছেন সায়েন্স ফিকশন যে দ্রুতিতে জ্ঞান আহরণ করতে পারে সমাজ সেই তালের সাথে তাল মেলাতে পারে না। রে ব্র্যাডবারির কাছে বিজ্ঞান হচ্ছে বিস্ময়কার যা কিছু আছে তার তদন্ত।
আর্থার সি ক্লার্ক আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন মানুষ কতো আহাম্মক যার চার ভাগের তিন ভাগই সমুদ্র তাকে আমরা সাগর না বলে বলি পৃথিবী।
একালের উইলিয়াম গিবসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন : ফিউচার ইজ নট গুগল।
সার্চ ইঞ্জিন গুগল চালিয়ে ভবিষ্যৎ দেখা যায় না--তা দেখেন কেবল কল্পলোকের লেখকরাই। কল্পনা কেমন করে দেখতে দেখতে বাস্তব হয়ে যায়-- আবিষ্কারকের নাম সবাই বলে, স্বপ্নদ্রষ্টার নাম কদাচিৎ উচ্চারিত হয়। সেই স্বপ্নদ্রষ্টাই হচ্ছে সায়েন্স ফিকশন লেখক।
১. মার্ক টোয়াইন (১৮৩৫-১৯১০)
ইলেকট্রিক ফেন্স বা বৈদ্যুতিক বেড়া প্রতিরক্ষার বা মানুষ ও অন্য প্রাণী আটকে রাখার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। মার্ক টোয়াইনের উপন্যাস 'অ্যা কানেক্টিকাট ইয়াঙ্কি ইন দ্য কোর্ট অব কিং আর্থার-এর লেখক একজন আমেরিকান প্রকৌশলীকে সময়ের পেছন দিকে রাজা আর্থারের দরবারে পাঠিয়ে দিলেন্ তার প্রকৌশল ও প্রযুক্তির জ্ঞান তাকে অচিরেই জাদুকরের খ্যাতি এনে দিল। তিনি রাজা আর্থারকে বোঝালেন ধরুন একটি অশ^ারোহী শত্রুবাহিনী আপনাকে আক্রমণ করতে এলো। কিন্তু আপনার কোনো চিন্তা থাকার কথা নয় যদি আপনার প্রাসাদের চারদিকে থাকে বৈদ্যুতিক বেড়া। আপনার কোনো বিনিয়োগ লাগরো, অস্ত্র গোলাবারুদ কিছুই লাগল না, সৈন্য ক্ষয হলো না। বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ তারা সেখানেই মৃত পড়ে গেল। ১৯৩০ এর পর ইলেকট্রিক ফেন্স-এর ব্যবহার বেড়ে যায়। ১৮৮৫ সালে মার্ক টোয়াইন বইটি লিখতে শুরু করেন, মাঝপথে ছেড়ে দেন, আবার ধরেন এবং ১৮৮৯-র বসন্তে লেখাটি শেষ করেন। মার্ক টোয়াইনের অনেক বিষয় উদ্ধৃত হয়; কিন্তু কম আলোচিত একটি বিষয় হচ্ছে ইলেকট্রিক ক্ষেত্রের প্রায়োগিক স্বপ্ন ভ্রষ্টা হচ্ছেন তিনিই।
২. রবার্ট হাইনলিন (১৯০৭-১৯৮৮)
মাইক্রোওয়েভ ওভেন এখন মধ্যবিত্ত সবার ঘরে, নিম্ন মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ও মাইক্রোওয়েভ কিনতে পারছে। ১৯৭৬ সালে আমানা কর্পোরেশন তা প্রথম বাজারে আনে। শার্প-ব্র্যান্ডের কমদামি মাইক্রোওয়েভে সত্তরের দশকে ধনী দেশগুলোর রান্নাঘরের কাজে রীতিমত বিপ্লব ঘটে যায়। এটি এখন রান্নাঘরের অপরিহার্য সামগ্রী।
রবার্ট হিনলিনের সায়েন্স ফিকশন স্পেস ক্যাডেট প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। মহাশূন্য যাত্রীদের জন্য খাবার নেওয়া হচ্ছে। ফিজড খাবার গ্রহণোপযোগী করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। রবার্ট হিনলিন যে খাবার মহাকাশ যাত্রীদের জন্য পাঠাচ্ছেন তাতে লিখা 'হাই-ফ্রিকোয়েন্সি হিটিং রিকোয়ার্ড'। তিনি স্পেস শিপে আয়োজন করেছে, খাবার মেশিনে ঢুকাবার অল্প সময়ের মধ্যে তা গ্রহণের উপযোগী হয়ে উঠছে। এই উপন্যাস প্রকাশের সিকি শতাব্দী পর তার পরিকল্পিত মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
৩. রে ব্র্যাডবারি (১৯২০-২০১২)
'ফারেনহাইট ৪৫১'-রে ব্র্যাউরির জনপ্রিয় উপন্যাস। ভবিষ্যতের এক সমাজে সব ধরনের পাঠ্য কিছু বইপত্র সব নিষিদ্ধ। সেখানকার দমকল বাহিনীর কাজ হচ্ছে ৪৫১ ডিগ্রি ফারেনহাইট আগুন নিরন্তর জানিয়ে রাখাÑ যে উত্তাপে কাগজও ভস্মীভূত হয়ে যায়।
১৯৫০ সালে রে ব্র্যাভরাত্রি বইটি লিখেন। সে সময় হেড ফোনের রিসিভার মাথায় দিয়ে দু'কান ঢেকে রাখত। রে ব্র্যাডবারি তার উপন্যাসে ব্যবহার করলেন কানে ঢুকিয়ে দেওয়া ছোট্ট গুড়ির মতো নরম কুশনে পেচানো একটা কিছু তাতেই হেডফোনের বোঝা ও বহনের সমস্যা। এই ইয়ার ফোন বাজারে নামল আরো তিরিশ বছর র্প ইয়ার ফোন ব্যবহার করেনি এমন শিক্ষিত যুবক পৃথিবীতেই খুজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ইয়ারফোনের এই ব্যবহারটি যে একজন সায়েন্স ফিকশন লেখকই প্রথম দেখিয়েছেন তা অল্প ক'জন মানুষের জানা। এমনকি এখন যার এই বইটি পড়েন তারাও চমকিত হন না, কারণ এটা তাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য। সত্তর বছর আগের পাঠকের জন্য এটা ছিল বিস্ময়।
৪. জুলে ভার্ন (১৮২৮-১৯০৫)
কল্পলোকের অমর কথাশিল্পী ফরাসি জুলে ভার্ন তার ১৮৮৯ সালের বই 'ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯-এ ভিডিওকনফারেন্সিং বর্ণনা করেন। তার সেই যন্ত্রটির নাম 'ফটোটেলিফোট' যন্ত্রের সাথে সংযুক্ত সংবেদনশীল আয়নায় মানুষের ইমেজ আদান প্রদানও হয়ে যাবে। জুলে ভার্নের পরিকল্পিত সেই কণপারেন্সিং সিস্টেম চালু হতে ৯০ বছর লেগে যায়। ১১০ বছর পর উন্নতমানের ভিডিও ফোন ব্যবহৃত হতে শুরু হয়।
জুলে বার্গ প্রায় সকলের শৈশব ও কৈশোরের প্রিয় পাঠ। একালে বিশেষ করে করোনাকাল ভিডিওকনফারেন্সিং এর প্রয়োজনীয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কখনো কি মনে ১২০ বছরেরও আগে জুনে ভার্ন-তার কাহিনীর পাত্রপাত্রীদের দিয়ে এ কাজটা করিয়েছেন।
৫. জন এলফ্রেথ ওয়াটকিনস জুনিয়র (১৮৫২-১৯০৩)
ঠিক ফিকশন নয় 'আগামী শতবর্ষে কি ঘটতে পারে তা নিয়ে ১৯০০ সালে লেডিস হোম জার্নালে জন ওয়ার্টকিনস জুনিয়র একটি মুখপাঠ্য নিবন্ধ রচনা করেছিলেন-- এটি সায়েন্স ফিকশনের চেয়ে কম কিছু নয়। ২০০১ সালের আগেই যা যা ঘটতে যাচ্ছে তার একটি তালিকা এবং কিছু বিবরণী দিয়েছিলেন :
রেডি-কুকড মিল হোম ডেলিভারি : উবার ইটস এর ধারনা তারই। তিনি বলেছেন বেকারির মতো কারখানা বা স্থাপনা থেকে বিপুল পরিমাণ তৈরি খাবার বিক্রি হবে-- নিউমেটিক টিউব কিংবা অটোমোবাইল ওয়াগানে তা বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করা হবে।
লাইভ টিভি নিউজ : মার্কনি কেবল রেডিও বার্তা পাঠাতে শুরু করেছেন, টেলিভিশন প্রযুক্তি আসতে আরো ৩০ বছর। কিন্তু জন ওয়াটকিনস পৃথিবীকে জাগিয়ে দিলেন বৈদ্যুতিক সংযোগ করে সার্কিটের অপর প্রান্তে ইউরোপ বা প্রাচ্যের যে কোন ঘটনার তাৎক্ষণিক হুবহু বিবরণ দেখানো সম্ভব হবে।
ডিজিটাল ফটোগ্রাফি : তার কালে বড় ক্যামেরা আর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফটোগ্রাফির চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। অথচ তিনি লিখলেন যে কোন দূরত্ব থেকে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে ফটো পাঠানো যাবে এবং শতবর্ষের মধ্যে অন্য প্রান্তের সংবাদপত্রে মুদ্রণ করা যাবে।
মোবাইল ফোন : জন ওয়াটকিনস জুনিয়রই প্রথম বললেন টেলিফোনে তারের প্রয়োজন হবে নাÑ কর্ডলেস টেলিফোনের ধারনা এটাই। তারহীন ফোনে শতশত মাইল দূরে কথোপকথন করা যাবে। তারহীন টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের সার্কিট সারা পৃথিবীতে ছেয়ে থাকবে। আটলান্টিক মহাসাগরে জাহাজ থেকে স্বামী শিকাগোর বাড়িতে স্ত্রীর সাথে কথা বলবে; নিউ ইয়র্ক ব্রুকলিনের মধ্যে যেমন টেলিফোন কথোপকথন হয় চীনের সাথেও তাই ঘটবে।
ঘোড়ার চেয়ে সস্তা হবে গাড়ি : ফোর্ডের মোটরগাড়ি ১৯০৮ সালের আগে উৎপাদনে আসেনি। কিন্তু ১৯০০ সালে জন ওয়াটকিনস লিখেছেন : এখন ঘোড়ার যে দাম তার চেয়ে সস্তায় গাড়ি পাওয়া যাবে। কৃষকদের থাকবে অটোমোবাইল ট্রকি ওয়াগন, হে ওয়াগান, লাঙ্গল, মন্থ। সকল ঘোড়াটানা গাড়ির ঘোড়া সরিয়ে অটোমোবাইল সেখানে জায়গা করে নেবে; অটোমোবাইল পুলিশ প্যাট্রোল, অটোমোবাইল অ্যাম্বুলেন্স, অটোমোবাইল স্টিট সুইপার।
আধুনিক চাষাবাদ:
রাস্তায় ষাঁড়ের যেমন দেখা পাওয়া যায় না ঘোড়ার বেলাতেও তাই ঘটবে। তিনি জেনেটিক সংশোধনের কথা বললেন : এমন গাছপালা উৎপন্ন করা হবে তাদের অসুখ হবে না, জবিাণু ক্ষতি করতে পারবে না, যেমন মানুষ গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষম হয়ে উঠছে। তিনি পরিবহনকারী বিশাল ও দ্রুতগামী রেফ্রিজারেটরের কথা বললেন। উগ্রমন্ডল ও দক্ষিণ থেকে সুস্বাদু ফল এই রিফ্রিজারেটরে সমুদ্রপথে কয়েক দিনের মধ্যে এনে হাজির হবে। যে মওসুমে এক অঞ্চলে নির্দিষ্ট কিন্তু উৎপন্ন হয় না, অন্য অঞ্চলে তা হয়ে রেফ্রিজারেটরে এই লেনদেন চলতে থাকবে।
স্যাটালাইট ফটোগ্রাফি : জন ওয়াটকিনস-এর ভবিষ্যৎবাণীর প্রায় ষাট বছর পর সোভিয়েত ভূউপগ্রহ স্পুটনিক ১ মহাকাশে নিক্ষিপ্ত হয়। তিনি লিখেছেন : শতমাইল পর্যন্ত দৃষ্টি সম্পন্ন টেলিস্কোপ নিয়ে বিপুল আকাশে উড়বে এবং যে ছবি ধারণ করবে দেখে মনে হবে রাস্তার ওপার থেকে তোলা হয়েছে।
অবশ্য মহাশূণ্যে মানুষ পরিবহন এবং সেখানে মানুষের পরিভ্রমণ তার হিসেবে ধরা হয়নি।
মেডিক্যাল ইম্যাজিং : জন ওয়াটকিমসের লেখার পাচ বছর আগে কেবল এক্স-রে আবিষ্কার হয়েছে। আর তিনি বললেন চিকিৎসার জন্য জীবিতের শরীরের সকল অংশই চিকিৎসক দেখতে পারেন। কেবল বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডের ধুকপুক শোনা ও দেখা নয়, তিনি ছবিগুলোকে বিবর্ধিত করতে পারবেনÑ অদৃশ্য আলোর সাহায্যে এই কাজগুলো করা হবে। ক্যাট-টেকনোলজির ধারনাও তিনি দিয়েছেন।
মানুষের উচ্চতা বৃদ্ধি : আমেরিকার মানুষের উচ্চতা এক থেকে দুই বেড়ে যাবে আর তা ঘটবে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ওষধ, পয়প্রণালী, খাদ্য ও খেলাধূলাতে বিভিন্ন সংস্কারের কারণে।
নিউক্লিয়ার সাবমেরিন : প্রথম সাবমেরিন সমুদ্রে নামে ১৭৭৬ সালে, কাজেই ১৯০০ সালে এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু জন ওয়াটসমিনের কল্পনা এটাকে এতোটাই শক্তিশালী করল যে সমুদ্রের তলদেশে কদিন কাটিয়ে এই সাবমেরিন শত্রুপক্ষের গোটা নৌবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে।
হাইস্পিড ভ্রমণ : স্বপ্ন তিনিই দেখিয়েছেন তবে বাস্তবতা স্বপ্নকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি দেখেছেন ঘন্টায় দেড়শ মাইল পথ পেরোনো এক্সপ্রেস ট্রেন। আসলে শতাব্দী শেষ হতে না হতে তা এর দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। তিনি মিগারের মতো এমন ইলেক্ট্রিক লোকোমোটিভ কল্পনা করেছেন। বাড়িঘরের মতো পুরো বাড়িই শীতল করার বন্দোবস্তু থাকবে। রেলপথে কোনো ধোয়া বা আগুণের ফুলকি থাকবে না, কারণ এই ট্রেন কয়লা বহনও করবে না, ব্যবহারও করবে না। তার কল্পিত শহর শব্দদুষণমুক্ত তা এখনো হয়ে উঠেনি।
৬. জেইন ওয়েব লুডন (১৮০৭ - ১৮৫৮)
সায়েন্স ফিকশন কথাটি তখনও চালু হয়নি। ১৮২১ সালে বার্মিংহামে জন্ম নেয়া ১৪ বছরের তরুণী জেইন ওয়েব লন্ডনে এসে মিশর থেকে আনা মমি দেখলেন। গল্পটা হয়ত তখনই ধারণ করে নিয়েছেন। ১৮২৮ সালে প্রকাশিত হলো 'দ্য মামি : এ টেইল অব টুয়িন্টি সেকেন্ড সেঞ্চুরি' - তিনি প্রায় পৌনে দু'শ বছরের পরের কাহিনী লিখছেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞানের পাঠ না থাকলেও তিনি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবীর বাইরের কক্ষপথে থাকতে হলেও কিছু বাতাস সাথে রাখতে হবে। 'আমরা যখন পৃথিবীর বায়ুস্তর ভেদ করে চলে যাব আমাদের নাক ও কানের জন্য প্লাগ, টিউব এবং হ্যাম্পার ভর্তি বাতাসের প্রয়োজন হবে। মোদ্দা কথা উপরে উঠলে অক্সিজেন লাগবেই এটারই প্রবক্তা ছিলেন এই কল্পলোকের কাহিনীকার।
৭. এইচ জি ওয়েলস (১৮৮৬ - ১৯৪৬)
আধুনিক সায়েন্স ফিকশনের প্রধান পুরোধাদের একজন হার্বার্ট জর্জ ওয়েলশ। সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত পাঠক কিন্তু 'টাইম মেশিন' পড়েননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। তার কল্পলোক বিজ্ঞান কাহিনী দ্য ওয়ার অব দ্য লর্ডস ২৮৯৮, দ্য টাইম মেশিন ১৮৯৫, দ্য ইনভিজিবল ম্যান ১৮৯৭, দ্য আইল্যান্ড অব ডক্টর মোরিও ১৮৯৬, দ্য ফাস্ট ম্যান অন দ্য মুন ১৯০১, আসলে একালের সায়েন্স ফিকশনের আকর গ্রন্থ। কিন্তু তার যে বইটি পৃথিবীর দুর্ভাগ্যের ভবিষ্যৎ বাণী দিয়ে গেছে তার নাম দ্য ওয়ার্ল্ড সেট ফ্রি, ১৯১৪ সালে প্রকাশিত। পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি একটি বোমার বিবরণ এই কাহিনীতে যা ১৯৫৬ সালে বিস্ফোরিত হবার কথা এবং বোমার পারমাণবিক বিকিরণে ভয়াবহ রেডিও-অ্যাক্টিভ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটার কথা। কিন্তু তার দূরদৃষ্টিতে আসা বোমাই ১১ বছর আগে বিস্ফোরিত হয়েছে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে তা শতাব্দীর ভয়াবহতম ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে। এই বইয়ের পাঠক লিও জিলার্ড সরাসরি পারমাণবিক বোমা প্রকল্প মালহাটার প্রজেক্টে জড়িত ছিলেন।
৮. সিরানো দ্য বার্যারাক (১৬১৯ - ১৬৫৫)
ফরাসি লেখক অবাধ্য, মদ্যপ ও সমকামী সিরানো দ্য বার্যারাককে আর্থার মি ক্লার্ক বললেন প্রথম রকেট বিজ্ঞানী। তার বিজ্ঞান কল্পকথা 'দ্য আদার ওয়ার্ল্ড : কমিকাল হিস্ট্রি অব দ্য স্টেটস অ্যান্ড এম্পায়ার অব দ্য জুন' লেখকের মৃত্যুর পর ১৬৫৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। আগুন দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যে মহাশূণ্যে রকেট পাঠানো যায় এই ধারণাটি মিরানোর। তার বর্ণনার ান্তত তিনশত বছর পর রকেটে চড়ে মানুষ পৃথিবীর কক্ষপথ অতিক্রম করে পৃথিবী থেকে ভূ-উপগ্রহ নিক্ষিপ্ত হয়।
তিনি যে চাঁদের কল্পনা করেছেন তা একটি প্রাণবন্ত সভ্যতাও সাম্রাজ্য, সেখান থেকে চাদের প্রাণী পৃথিবীর দিকে তাকায় এবং পৃথিবীকে মনে মনে করে তাদের একটি উপগ্রহ। চাঁদ আর পৃথিবী এমন নয় যে একটা সরাসরি উপরে অন্যটা সরাসরি নিচে - কাজেই কোনো এক বিন্দু থেকে সোজা উপরে উঠলেও পৃথিবী ঘুনায়মান থাকার কারণে ঠিক সেই জায়গায় নামার সম্ভাবনা কম্ মহাকাশ অভিযান নভোচারী ও বিজ্ঞানীদের কাজ হলেও লেখক মিরানো তাদের কাজ অনেকটা এগিয়ে দিয়েছেন।
৯. মার্গারেট ক্যাভেন্ডিশ (১৬২৩- ১৬৭৩)
ল্যাডি মার্গারেট লুকাস ক্যাভেন্ডিশ ডাচেস অব নিউ ক্যাসল আপঅন টাইম-ই প্রথম সাবমেরিনের কথা ভেবেছেন। এমনিতে সাধারণ ধারনা জুলে ভার্ন-এর 'টুয়েন্টি থাউজেন্ডস লিগ আন্ডার দ্য সিতেই ১৮৭০ সালে সাবমেরিনের প্রথম অভ্যুদয়। তারও ১০৪ বছর আগে ১৬৬৬ সালে প্রকাশিত মার্গারেট ক্যাভেন্ডিশের 'দ্য ডেমক্রিপশন অব নিউ ওয়ার্ল্ড কল্ড দ্য ব্লেজির ওয়ার্ল্ড' এ একটি বিদ্রুপাত্মক কল্পজগতের চিত্র আনা হয়েছে। সম্ভবত কোনো ইউরোপিয় নারীর রচনা প্রথম সায়েন্স ফিকশন। তার এই উপন্যাসটিতে সাবমেরিন গুরুত্ব পেয়েছে। তার আগে ১৫৯৬ সালে জন নেপিয়ার সিক্রেট ইনভেনশন 'গ্রন্থে একটি ডুবন্ত জলতরীর কথা বলেছেন যা ডুবে থেকেই শত্রুপক্ষের জাহাজের অনেক ক্ষতিসাধন করতে পারে।
গল্পটা কল্পলোকেরই। কিন্তু মর্ত্যরে বিজ্ঞানী এটাকে সত্যি বানিয়ে দেন, কল্পলোক সময়ের ব্যবধানে বস্তুলোকে পরিণত হয়।
জুলে ভার্ন-এর ক্লিপার অব দ্য ক্লাউডস'এ হেলিকপ্টারের মতো একটি বাহন ছিল। ইগর ইভানোভিচ সিকোরস্কি ছিলেন জুলে ভার্ন-এর পাঠক। তিনি সত্যিই হেলিকপ্টার বানালেন। এই হেলিকপ্টার আর উড়োজাহাজে ফিক্সড উইংস দুটোই তার অবদান। বানার কথা ইগরের ছেলে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন : একজন মানুষ যা কল্পনা করে অন্য একজন মানুষ তা বাস্তবায়ন করে।