সেলাই: গার্হস্থ্য শ্রমে অবরুদ্ধ নারীর সৃজনশীলতার আকুতি
বিশ্বখ্যাত রূপকথা 'স্নো হোয়াইট' বা 'তুষারশুভ্রা'-র গল্পটিতে এক শীতের বিকেলে এক সন্তানসম্ভবা রাণী যখন তার প্রাসাদ কক্ষের আবলুস কাঠের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সুই-সূতোর কাজ করছিলেন, তখন সহসা একটি পাখি জানালার সামনে দিয়ে উড়ে গেলে রাণীর আঙুল মনের ভুলে সুইয়ে বিদ্ধ হয় এবং তাঁর আঙুল থেকে এক ফোঁটা রক্ত জানালা বেয়ে নিচে জমাট তুষারস্তুপে পতিত হয়। রাণী তখন প্রার্থনা করেন, 'ওহ্, আমার যদি এমন একটি মেয়ে হতো যার ত্বক হবে তুষারের মত শুভ্র, ওষ্ঠ রক্তিম আর চুল আবলুসের মত কালো, তবে কত ভালই না হত!'
গল্পের পরের অংশটুকু আমরা সবাই জানি। দয়ালু ও ভাল স্বভাবের রানী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেন আর বিমাতার ঘরে স্নো হোয়াইটের কষ্টের শেষ রইলো না। এই রূপকথা থেকে এটাও জানা যাচ্ছে যে ভিখিরিনী বা রাজরানী যেই হোক, সন্তান সম্ভবা নারীর প্রসবের আগের দীর্ঘ সময়টি কত কষ্ট, একঘেঁয়েমি ও অবসাদের ভেতর কাটে! আর সেই অবসাদ কাটাতে প্রাচীন যুগে মেয়েদের হাতে উঠত সুই আর সুতো।
আবার গ্রিক পুরাণে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মহাবীর ওদিসিয়ুস দীর্ঘ সময় গ্রিক-ট্রয় যুদ্ধ এবং যুদ্ধ শেষ হবার পরও সমুদ্রপথে নানা দূর্যোগ-দূর্বিপাক পার করে দেশে আসতে আসতে কুড়ি বছর কেটে যায়। ইতোমধ্যে ওদিসিয়ুস ও তাঁর স্ত্রী পেনেলোপের ছেলে কুড়ি বছর বয়সী হয়ে গেলেও পেনেলোপে এখনো সুন্দরী এবং তার পাণিপ্রার্থনার জন্য পাগল হয়ে গেছে অসংখ্য পুরুষ। এই পাণিপ্রার্থীদের ঠেকিয়ে রাখতে পেনেলোপে তাদের বলতেন যে হাতের একটি শাল বোনার কাজ শেষ হলেই তিনি তাদের (পাণিপ্রার্থীদের) ভেতর থেকে একজন কাউকে নিশ্চিত বিয়ে করবেন। কিন্ত প্রতি রাতেই পেনেলোপে সারা দিনে যতটুকু শাল বুনতেন ততটুকুই আবার খুলে ফেলতেন। রাজবাড়ির বারো জন গৃহপরিচারিকা একপর্যায়ের রাণীর এই 'গোপন কান্ড' জানিয়ে দেয় ওদিসিয়ুসের প্রাসাদের সামনে জড়ো হওয়া পাণিপ্রার্থীদের। পরিচারিকারা ভেবেছিল রাজা বোধ করি আর কোনদিন ফিরবে না। বরং রানীকে এই পাণিপ্রার্থীদের ভেতর নতুন কেউ যদি বিয়ে করার সুযোগ পায়, তবে 'নতুন রাজা' নিশ্চিত 'কান কথা লাগানো'র পুরষ্কার হিসেবে তাদের ভালই বখশিস দেবে এবার, ত' পাণিপ্রার্থীরা মহা ক্ষিপ্ত। পারলে তারা পেনেলোপেকে তুলেই নিয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে এর ভেতর ছদ্মবেশী ওদিসিয়ুস স্বদেশে পৌঁছে যান এবং একটি কুঁড়ে ঘরে পুত্র টেলেমেকাসের সাথে তার পরিচয় হয়। পিতা-পুত্রের মিলনের পর উদ্দীপিত ওদিসিয়ুস প্রাসাদে এসে ছদ্মবেশেই স্ত্রীর সাথে কথা বলে বুঝতে পারেন যে পেনেলোপে আজো তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। পরে ত' বীর ওদিসিয়ুস স্ত্রীর অন্য পাণিপ্রার্থীদের সবাইকে হত্যা করেন এবং এমনকি যে বারো জন গৃহপরিচারিকা পেনেলোপের প্রতি রাতে বোনা শাল খুলে ফেলার কথা পাণিপ্রার্থীদের বলেছিল, তাদেরও হত্যা করেন। এই কাহিনীতে আবার দেখা যাচ্ছে সেই প্রাচীন যুগেও নারী যদি রানীও হতেন, তবু যুবক পুত্র পাশে থাকলেও মধ্যবয়সী, সুন্দরী রানী নিরাপদ নন।
পাণিপ্রার্থীদের হাত থেকে বাঁচতে সেলাই এখানে হয়ে উঠছে তাঁর 'লৌহবর্ম' বা আত্মরক্ষার অস্ত্র। নিজের হাতে বোনা শালই রোজ খুলে ফেলছেন- আনড্যুয়িং দ্য ড্যুয়িং। অনেকটা সিসিফাসের গড়িয়ে পড়া পাথর রোজ ঠেলে দেবার মতই। যেন বা ভারতীয় 'নিষ্কাম কর্ম' করার দর্শণের মত এবং সেই একই সুর আমরা ধ্বনিত হতে দেখি পারস্যের কবি জালালুদ্দীন রুমির কণ্ঠেও যেখানে তিনি বলছেন কোন ফলের আশা না করে সুঅভ্যাসগুলো অনুশীলন করে যেতে। পেনেলোপের হতাশা ও অনিশ্চয়তা এক কথায় পরিমাপ করা কঠিন। তবু তার ভেতরেই তিনি রোজ দিনে যতটুকু শাল বুনতেন, রাতে সেটা খুলে ফেলতেন। আর এভাবেই পতিব্রতা স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। পশ্চিমে তাই আজো বাধ্য নারীর নাম হিসেবে 'পেনেলোপে' নামটি জনপ্রিয়।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঠিক কবে থেকে সুই আর সূতোর প্রচলন হলো? কবে থেকেই বা সেলাই মেয়েদের হাতে উঠেছিল অবসর কাটাবার সঙ্গী হিসেবে? নিয়ান্ডার্থাল যুগ থেকেই পুরুষকে যখন প্রকৃতির অজস্র বিরূপতার ভেতর অতিকায় নানা প্রাণির সাথে পাথরের ভোঁতা হাতিয়ার হাতে শিকার ও আত্মরক্ষায় লড়াই করতে হয়েছে, নারী তার প্রসবকালীন বা রজ:স্বলা সময় সহ শারীরিক নানা কারণেই ঘরেই সময় দিয়েছে বেশি। তার হাত থেকেই তাই অরণ্যের ফলের বীজ মৃত্তিকায় রোপিত হয়েছে আর নতুন তৃণাঙ্কুর মেলেছে কিশলয়। জন্ম নিয়েছে কৃষি। অনেকটাই দৈহিক বা পেশীশক্তির কারণেই নর-নারীর আদি শ্রম বিভাজনের সময় থেকেই পুরুষের হাতে তাই যখন অর্থনৈতিক শক্তি এবং সেই সাথে তার হাতে পুঞ্জিভূত হচ্ছে সামাজিক ও ধর্মীয় নানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষমতাও, নারী তার নিরালা কোণে জ্বালিয়েছে সাঁঝবাতি, আল্পনা দিয়েছে আফ্রিকা থেকে ভারতের গ্রাম অবধি বিচিত্র নানা নক্সায় আর মনের ক্ষুধা ও অবসাদ কাটাতে তার হাতে উঠেছে সুই-সূতো। তবু মানব সভ্যতার প্রথম সূঁইয়ের হদিস ঠিক কোথায় মিলেছে? দক্ষিণ আমেরিকার শিবুদু গুহায় ৬১,০০০ বছর আগে নির্মিত প্রথম একটি হাড়ের সুই পাওয়া গেছে। পাখির হাড়ে নির্মিত আর একটি ৫০,০০০ বছরের পুরণো সুই পাওয়া গেছে দেনিসোভা গুহায়। প্রায় ৪১,০০০ বছরের পুরণো আর একটি হাড়ের সুই পাওয়া গেছে স্লোভেনিয়ার পটোক গুহায়।
চীনের লিওয়াওনিং প্রদেশের শিয়াগুশান প্রাগৈতিহাসিক এলাকায় হাড় ও হাতির দাঁতের তৈরি সুই পাওয়া গেছে। আনুমানিক ৩০,০০০ হাজার বছরের পুরণো হাতির দাঁতের সুই আরো পাওয়া গেছে রাশিয়ার কোস্তেনকি এলাকায়। কিন্ত কবে থেকে এই সুইয়ের সরু ছিদ্রে সূতো পরানোর কাজ শুরু হলো? মেয়েরা শুরু করলো সুইয়ে সূতো ভরে শিল্প তৈরির কাজ। চৈনিক সিনেমা 'পাম ফ্লাওয়ার এম্ব্রয়ডারি'-তে চৈনিক বিপ্লবের আগে শৈশবেই হারিয়ে যাওয়া দুই যমজ বোনের ভেতর শান্ত স্বভাবের বোনটির হাতের অনবদ্য সূচী কর্ম মালিকের মেয়ে নিজের বলে ভোজসভায় চালিয়ে নেয়। অনেক ক্ষত-দাহ পেরিয়ে দুই বোন ও তাদের হারানো বাবার মিলন হয়। বিদ্রোহী বোনটি (যে সবসময় লাল পোশাকে) শান্ত বোনটির (যাকে সব সময় নীল পোশাকে দেখা যায়) হাতের অনবদ্য সূচী কর্মের স্বীকৃতি আদায় করে ছাড়ে। বহু আগে বিটিভিতে দেখা এই ছবি আমার স্কুলজীবনের সেই বয়সে না দেখা চীনকে নিয়ে হৃদ-মাঝারে অনেক কল্পনার সঞ্চার করেছিল।
'মহাভারত'-এ দ্রুপদনন্দিনী ও পাঞ্চাল রাজকন্যা দ্রৌপদী স্বাধীনচেতা নারী হলেও রন্ধন ও সেলাইশিল্পেও পারঙ্গম। কুরুপক্ষের ষড়যন্ত্রে যখন বারো বছর বনবাসের পর আরো এক বছর অজ্ঞাতবাসের দূরূহ সময় কাটাতে হয়, দ্রৌপদী তখন বিরাট রাজের রাজ অন্ত:পুরে শুধু রান্না নয়, রাজকন্যাদের সেলাই শিক্ষাও দিয়েছেন। প্রাচীন ভারতের 'কামশাস্ত্রে' নারীকে নৃত্য-গীত-কবিতা লেখা থেকে শুরু করে যে ৬৪ কলায় পারদর্শিনী হতে হতো, তার ভেতর সেলাইও রয়েছে। বাংলার নারী তার মসলিন বয়নের জন্য বিশ্ববিশ্রুত। আমাদের মসলিন একসময় মিশরেও গিয়েছে। বাংলার অসংখ্য নদ-নদী ঘেরা আর্দ্র জলবায়ু এবং এখানকার মেয়েদের কোমল আঙুল মসলিন শিল্পের জন্য খুব উপযোগী ছিল বলে জানিয়েছেন পরবর্তী সময়ে দেশী-বিদেশী বস্ত্র বিশেষজ্ঞরা। বৃটিশের হাতে ঢাকার মসলিন শিল্প ধ্বংস হবার বহু বছর পরে আশ্চর্যজনক ভাবে আজকের বাংলাদেশের পোশাক শিল্প রপ্তানীখাতও সুলভ নারীশ্রম নির্ভর।
'ঠাকুর মা'র ঝুলি'র প্রথম আখ্যানেই আমরা জানতে পারছি যে বুদ্ধু আর ভুতুম সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ময়ূরপঙ্খী রাজকন্যার পাতালপুরীতে যেই না প্রবেশ করে, অমনি সেই পাতালপুরীর উঠোনে তিন জন একশো বছরের বুড়ি যারা একশো বছর ধরে একটি ছোট কাঁথা বুনছিল, তারা সেই কাঁথা বুদ্ধুর দিকে ছুঁড়ে মারে। এই তিন বুড়ির গল্প খুবই রহস্যময়। এই তিন বুড়ি কি কোন অজড়তা বা অনড়তার প্রতীক? পাতালপুরীর রহস্যঘেরা ভুবনের কোন সাঙ্কেতিক চিহ্ন? রূপকথাটি অবশ্য শেষপর্যন্ত ভালয় ভালয় শেষ হয়। সে যুগে ভাগ্যিস মানুষ মুখের কথার দাম দিত। তাই ময়ূরপঙ্খী নাওয়ে বসা কলাবতী রাজকন্যা যে কিনা খুব স্বাধীনচেতা বলেই তখনো অবিবাহিতা এবং উল্টো তার মাঝি-মাল্লা সমুদ্রঝড়ে হতশ্বাস নানা দেশের রাজপুত্রকে বন্দি করে ফ্যালে, সে ঠিকই পাতালপুরীর সুড়ঙ্গপথে তার খোঁপার মোতির ফুলে হাত দিতে পারার সক্ষমতা অর্জনের জন্য 'বাঁদর স্বামী' বুদ্ধুকেও মেনে নেয় এবং তার গলায় মালা দেয়। তবে শেষপর্যন্ত জানা যায় বুদ্ধু বা ভুতুম আসলে আদৌ বানর আর পেঁচা নয়। ওরা দেবপুত্র রূপকুমার ও বুধকুমার। কলাবতী রাজকন্যা ও তার বোন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে একরাতে ঘুম ভেঙ্গে পালঙ্কে বানর ও পেঁচার ছদ্মবেশধারী দুই বরকে না পেয়ে এবং পরে তাদের গায়ের ছাল দু'টো প্রদীপের আগুনে পুড়িয়ে ফেললে কুরূপের ছদ্মবেশধারী দুই সুদর্শন রাজপুত্র দৌড়ে আসে। তারা ছদ্মবেশে রাজ্যের অনেক কল্যাণকাজ করতো। সেটা ত' আর সম্ভব হবে না। তা' না হোক। দুই রাজকন্যা শেষমেশ রূপবান, মানুষ বর পাওয়ায় আমরা ত' স্বস্তি পাই। ওহ্- তিন বুড়ির কাঁথা সেলাইয়ের গল্প বলতে গিয়ে কত দূর চলে এসেছি?
মূল প্রসঙ্গে আসি আবার। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও মেয়েরা সেলাইয়ে যতটা ব্যপৃত থাকত, এখন ততটা থাকে না। আমার মা'র হাতেই সেলাই করা অপরূপ সুন্দর হরিণ এবং আরো নানা এম্ব্রয়ডারির কাজ ছিল। তবে অধিকাংশই বিয়ের আগে করা বা বিয়ের পরেও প্রথম কয়েক বছর। তারপর অনেক সন্তানের মা হয়ে এবং ঘর-সংসারের অসংখ্য কাজ সামলে সূচী শিল্পের জন্য দরকারী অবসরটুকুও হয়তো ছিল না। অথবা আমাদের সবচেয়ে বড় বোনই ছোট বেলায় ঝটপট ছোট দুই বোনকে নানা পার্বনে-আয়োজনে জামা বানিয়ে দিচ্ছে, ঘরে ঘরে মাতৃস্থানীয়া নারীরা শীতের দিনে উল বুনছেন...এগুলো কি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে? হ্যাঁ, এর কিছু কারণ আছে অবশ্য। একে ত' মেয়েরাও এখন উচ্চশিক্ষা শেষে বিপুল হারে কর্মক্ষেত্রে ঢুকছে, আট ঘন্টা অফিস সেরে সংসারে ন্যূণতম সময় দিতেই যেখানে যুদ্ধ করতে হয়, সেখানে আর সেলাই করবে কিকরে? এছাড়া আগে অনেক ভাই-বোনের ঘরে বাড়ির বড় মেয়েটিই হয়তো ছোট বোনদের জামা-কাপড় বানিয়ে দেবার সাশ্রয়টুকুও করে দিত। এখন ঘরে ঘরে একটি কি দু'টো মোটে সন্তান। আমরা যারা মধ্যবয়সে তারাও কম-বেশি নানা অর্থকরী কাজে ব্যপৃত থাকায় এবং পোশাক শিল্প বা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বিপুল প্রসারের কারণে আগের মত সেলাই আর অত ঘরে ঘরে করাও হয় না।
রবীন্দ্রনাথের 'চারুলতা'-য় চারুলতা অমলকে বাড়ির বাগানে বিকেলের জলখাবারের যে নিমন্ত্রণ জানায়, সেখানে নিজের হাতে বোনা আসন থাকে। 'চারুলতা' চলচ্চিত্রের প্রথম দিকের ভিত্তি দৃশাবলীতেই দেখা যায় চারু রূপী অভিনেত্রী মাধবী কখনো এম্ব্রয়ডারির কাজে ব্যস্ত, কখনো বঙ্কিম পড়ছে আবার কখনো ব্যস্ত সম্পাদক বর ভূপতিকে দূর থেকে দূরবীণ দিয়ে দেখছে। খুব অবাক হয়ে সেদিন একটি ফেসবুক পোস্ট থেকেই দেখলাম কাদম্বরী দেবীর নিজ হাতে বোনা অসম্ভব সুন্দর একটি লেসের আসন। 'চারুলতা'র চারু যে আসলে কাদম্বরী দেবীই, সেটা নিয়ে আর কোন সন্দেহ রইলো না। নি:সন্তান কাদম্বরী যাঁর বাবা ছিলেন ঠাকুর বাড়ির বাজার সরকার আর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্র নাথ এক থিয়েটার অভিনেত্রীতে আসক্ত, তাঁকে সময় কাটাতে হয়েছে সূচী শিল্প, বঙ্কিমের উপন্যাস পড়ে এবং পাশাপাশি বয়সের দেবর বা বন্ধুর প্রতি নিষ্কাম বন্ধুত্বই সহসা অন্য অনুরাগে বেঁকে বা বদলে গিয়ে।
ইরাণের বিখ্যাত সিনেমা 'গাব্বেহ' কিন্তÍ ইরানের গ্রামীণ নারীর শ্রম শোষণ ও শৈল্পিক অনুভূতি নিংড়ে গড়ে ওঠা 'কার্পেট' শিল্পের ওপর বানানো এক ছবি। ১৯৯৬ সালে মহসীন মখমলবাফের নির্মিত এই ছবিতে দেখা যায় এক বয়সী দম্পতি তাদের একটি পুরণো কার্পেট নদীতে নিয়ে যাচ্ছেন ধুতে। কার্পেটটি যখন মাটির উপর বিছানো হলো, তখন সেখান থেকে যেন সহসা এক যাদু মন্ত্রে একটি বালিকা বের হলো। সে বলে তার জীবন ও পরিবারের গল্প। তার কাকার একটি পাত্রী খোঁজা বা মেয়েটির নিজেরও কোন তরুণ বরকে বিয়ে করার আকাঙ্খা। ছবিটি অবশ্য ইরান সরকার বন্ধ করে দেয়। পারস্যের গালিচা তবু বিশ্ববিশ্রুত আর বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও এই গালিচার উল্লেখ রয়েছে '... ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোনা এক নগরী ছিল একদিন,
কোন এক প্রাসাদ ছিল;
মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ;
পারস্য গালিচা, কাশ্মিরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,
আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্খা,
আর তুমি নারী-
এই সব ছিল সেই জগতে একদিন।'
এভাবেই নারী যেন যুগে যুগে কালে কালে কখনো ঢাকার মসলিনে আবার কখনো পারস্যের গালিচায় নিজের অবদমিত সৃজন আকাঙ্খাকে প্রকাশ করতে চেয়েছে। প্রকাশ করতে চেয়েছে তার সম্পর্কের যত আনখশির বঞ্চণা, ক্ষোভ, প্রেম, অবদমন, শোষণ। পশ্চিমের নারীবাদীরা আজ বলেন যে এই সভ্যতা পুরুষতান্ত্রিক বলেই এখানে পুরুষ মানুষ তিমি শিকারে গেলে সেটা নিয়ে মহাকাব্য বা উপন্যাস রচিত হয়, দিনের পর দিন সুইয়ে সুতো ভরে একটি অপূর্ব সৃজনীকর্ম নিয়ে ক'টা লেখা রচিত হয়? বাংলার কবি জসীম উদ্দিন অবশ্য লিখেছেন। তাঁর 'নক্সীকাঁথার মাঠ' জমি নিয়ে গ্রামীণ দাঙ্গা-হাঙ্গামায় হাজতি হয়ে যাওয়া যুবক রূপাইয়ের মুক্তির আশায় প্রতীক্ষারত স্ত্রী সাজুর নিরলস কাঁথা বুনে যাওয়ার এক অনন্য কাহিনী:
কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,---
মহা-শূণ্যেতে উড়িয়াছে কেবা নক্সী-কাথাটি ধরে ;
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশীটি বাজায় করুণ সুরে,
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে ।
সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী-কাঁথার মাঠ,
ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ ।