স্কাইলাইট
অয়নের ঘরের উঁচু ছাদে একটা চৌকো স্কাইলাইট আছে। বাইরের পৃথিবীর এক রত্তি আলো ওই টুকু কাচেঁর মধ্য দিয়ে এসে তার ঘরের ভেতর আটকে থাকে সারা সকাল আর দুপুর। বিকেল থেকে বাইরের আলোটা ম্রিয়মান হয়ে আসতে থাকে, আকাশের রং বদলে যায়, হলদে থেকে কমলা, কমলা থেকে লাল, তারপর একটু একটু করে অন্ধকার জমাট বাধেঁ ওতে। অয়ন ঘোর লাগা চোখে রোজ চেয়ে থাকে স্কাইলাইটের সেই এক রত্তি কালো অন্ধকারের দিকে। ভারি অদ্ভুত লাগে তার এই নিকষ কালো রং। কখনো তারার আলোয় কি জোছনা রাতে সেই কালো অন্ধকার খানিকটা ফিকে হয়। কখনো একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দূরে কখনো সেই অন্ধকারে জুঁই ফুলের মত ফুটে থাকে কয়েকটি তারা। জ্বলজ্বল করে সেগুলো। এক সময় সেই আঁধার কালো জমাট রং মাথায় নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। অয়নের তো সময়ের হিসেব নেই। কখন ঘুমায় কখন জাগে তা নিয়ে ভাবে না কখনো। তবে অনেকক্ষণ পর আবার যখন জাগে তখন দেখে স্কাইলাইটের বাইরে পৃথিবীটা আবার জাগছে!
পৃথিবী! অয়নের পৃথিবী মানে এই চারকোণা ঘর। ঘরের বাম দিকে একটা বিছানা। মাঝখানে চেয়ার টেবিল, আর টেবিলের ওপর কেইজো। টেবিলের পাশে মেঝেতে দেয়ালের সাথে ঠেস দেয়া একটা ছবি। ছবিটা অয়নের দাদুর। সাদা চাপ দাড়ি, চোখে চশমা। মুখটা হাসি হাসি। সাতাশ বছর! সাতাশ বছর ধরে দাদু এভাবে টেবিলের পাশ থেকে চেয়ে হাসছে ওর দিকে। ওই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়েঁ। যেন বলছে-অয়ন, দাদু। বাইরে যেও না খবরদার। বাইরে ভূত!
সাতাশ বছর আগে কারা যেন একদিন দাদুকে নিয়ে যেতে এই ঘরে প্রবেশ করেছিলো। অয়ন তখন শিশু। তিন কি সাড়ে তিন বছর বয়স। লোকগুলোর মুখ চোখ ছিলো কাচেঁ ঢাকা, নাকের ওপর গ্যাসবিরোধী বায়োহ্যাজার্ড মাস্ক। সেটা থেকে লম্বা পাইপ বের হয়ে যুক্ত হয়ে আছে পিঠের অক্সিজেন ট্যাংক এর সাথে। পায়ে শক্ত বুট। শরিরে নীল পোশাক। লোকগুলো দাদুর ঠান্ডা ফ্যাকাশে শরিরটাকে ঝটপট একটা ভারি প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢুকিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিলো। অয়ন তখন ভয় পেয়ে গুটিশুটি মেরে বসেছিলো ঘরের কোণে। ওর দিকে কয়েক মুহুর্ত চেয়ে অদ্ভুত পোশাক পরা লোকগুলো তাকে বলেছিলো-আমরা পরে আবার আসবো। তুমি ঘর থেকে বের হয়ো না কিন্তু। বাইরে ভাইরাস!
অয়ন তখন ভূত বা ভাইরাস কিছুই চিনতো না। তারা কেমন দেখতে, কেনই বা তারা ভয়ংকর, কেন তাদের অত্যাচারে বাইরে যাওয়া নিষেধ-কোন উত্তরই তার জানা ছিলো না। কারণ দাদু, বা ওই লোকগুলো বা অন্য কেউ, পৃথিবীর কেউই আর কখনো তাকে নিতে আসে নি। বাইরের পৃথিবীতে আদৌ কেউ বেঁচে আছে কিনা, নাকি সেই ভয়ংকর ভূত বা ভাইরাস সবাইকেই খেয়ে ফেলেছে তা সে আর জানতে পারে নি। এই চারকোণা ঘরের দক্ষিণ দিকে যে ভারি কাঠের দরজা-বছরে পর বছর ধরে এভাবে বন্ধ থাকতে থাকতে তা দেয়ালের সাথে শক্ত হয়ে আটকে গেছে একদিন। অয়ন কখনো সেই দরজা খোলার চেষ্টাই করে নি। কারণ বাইরের পৃথিবীটাকে সে সেই ছোট্টবেলা থেকেই ভয় পায়। তার শৈশব কেটেছে এই ঘরটাতে, দাদুর সাথে। তারপর কৈশোর আর বড় হবার পরও এই এতগুলো দিন, তাও এই ঘরেই, দাদুকে ছাড়া, একা একা। এই ঘরটাই তার পৃথিবী। সে কেবল এই ছাদের স্কাইলাইটের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে সকাল, সন্ধ্যা আর রাত নামতে দেখেছে। দেখেছে আকাশের রং বদলে যাওয়া। কখনো এক চিলতে সাদা মেঘের এক টুকরো লেজ। কখনো স্কাইলাইটের কাচেঁর ওপর উড়ে এসে পড়েছে একটা হলুদ বিবর্ণ পাতা। সে সেই পাতার দিকে তাকিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছে। তবু কখনো তার ইচ্ছে হয় নি বাইরের পৃথিবীটা দেখার। তাকে বরং পৃথিবী দেখিয়েছে কেইজো। টেবিলে রাখা গোল কালো কাচেঁর তৈরি কেইজো। তার একমাত্র সঙ্গী। তার অভিভাবক। অয়নের দাদু মারা যাবার আগে ওকে যার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
-অয়ন, তোমার ইকুয়েশনটা শেষ করো নি। তোমাকে তিন দিন সময় দেয়া হয়েছিলো।-কেইজো কথা বলে ওঠে তার ভাবনার মধ্যে। অয়ন স্কাইলাইটের মধ্য দিয়ে ফ্যাকাশে অন্ধকারের দিকে তাকিয়েছিল। কেইজোর কথা শুনে তার খুব বিরক্ত লাগল। তিন দিন আর তিরিশ দিনের মধ্যে আসলে কি খুব ফারাক আছে? এই পৃথিবীতে মানুষ কতদিন টিকবে শেষ পর্যন্ত? কতটা আয়ু পাবে এই সুন্দর পৃথিবী? কিংবা ওই মহাশক্তিশালী ভাইরাস? কিন্তু অয়নকে কমান্ড ফলো করতে হয়। কেইজোই তাকে লেখাপড়া করিয়েছে। এই ঘর ছেড়ে দাদু চলে যাবার পর থেকে তাকে বড় করেছে সযত্নে। তাকে গণিত শিখিয়েছে। দেখিয়েছে বিশ্ব ব্রন্মান্ড। আকাশ, সমুদ্র, মহাকাশ। ছায়াপথ, গ্যালাক্সি, গ্রহান্তরের খবর ওই দিয়েছে অয়নকে। আর জানিয়েছে ইতিহাস। মানব সভ্যতা আর বিশ্বের ইতিহাস। যুদ্ধ বিগ্রহ, সৃষ্টি আর ধ্বংসের ইতিহাস। কিন্তু অয়ন জানে সে ততটুকুই জানে যতটুকু এই কেইজো তাকে জানাতে চায়। সীমার বাইরের কিছু জানতে চাইলেই সে চুপ হয়ে যায়। কথা বলে না। কখনো রেগে গিয়ে তাকে অনেক কমান্ড দেয়। টাস্ক দিতে থাকে। ব্যস্ত করে রাখে। অয়ন সব বোঝে কিন্তু মেনে নেয়। কারণ সে জানে যে তার আর কোথাও যাবার নেই। এই ঘরটাই তার পৃথিবী। সে এখানে বন্দি। আর এই কারাগারে কেইজোই তার একমাত্র সঙ্গী।
-এই ইকুয়েশনটা শেষ করতে পারলে তোমকে একটা কম্বাইন্ড প্রবলেম দেয়া হবে-কেইজো বলে ওঠে। তুমি তখন একটা টিমের সাথে কাজ করতে পারবে। যদি সেটাও সলভ করতে পারো তবে একটা বড় রকমের সফলতা আসবে বিজ্ঞানের জগতে। আমরা গ্যালাক্সিতে একটা ভাল অবস্থানে যেতে পারবো। আমি জানি তুমি পারবে অয়ন।
-কিভাবে জানো?-অয়ন ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে।
-আমিই তো তোমাকে বড় করেছি অয়ন। তোমাকে আমি ছাড়া এত ভাল আর কে জানে?
কথাটা ঠিক। সাতাশ বছর! সাতাশ বছর ধরে ও চেনে অয়নকে। সে জানবে না তো কে জানবে? অয়ন এর পর কয়েকদিন ইকুয়েশনটা সলভ করার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে গেলো। কখনো মনে হলো সমাধানের একেবারে কাছাকাছি পৌছেঁ যাচ্ছে, কখনো আবার খেই হারিয়ে ফেলছে। এটা একটা নেশার মতো। অয়ন দিন রাত সব ভুলে লেগে রইলো সমস্যাটার পেছনে। স্কাইলাইটের বাইরে আলো আঁধারের খেলার দিকেও লক্ষ করলো না কয়েকদিন।
সাতাশ বছর আগে দাদুর সাথে সে মাঝে মাঝে বাইরে যেতো বই কি। খুব আবছা মনে পড়ে, বাইরের পৃথিবীটা ছিল ধূসর। গাছপালাগুলো বিবর্ণ। আকাশটা থাকতো ঘন ধোঁয়ায় ঢাকা। বাতাস ছিল এত দুষিত যে শ্বাস নিতে রীতিমত কষ্ট হতো। আর বাইরের রাস্তা ঘাট আকাশ পথে গিজ গিজ করতো বিচিত্র সব যানবাহন। বাইরের দুনিয়া মোটেও ভাল লাগতো না অয়নের। একটু পরই দাদুর হাত ধরে চাপ দিয়ে বলতো-চলো ঘরে যাই। সেই দাদুই একদিন ফিসফিস করে বললো-আমরা আর বাইরে যেতে পারবো না অয়ন।
-কেন দাদু?
-বাইরের পৃথিবী দখল হয়ে গেছে।
-কে দখল করলো?
-ভাইরাস।
-ভা্ইরাস মানে?
-ভূত। তুমি কখনো বাইরে যেও না কিন্তু। ও তোমাকে খেয়ে ফেলবে।
অয়ন খুব ভয় পেয়েছিলো। কিন্তু সে তখনও জানতো না যে দাদুকে ভুতটা ধরে ফেলেছিলো। দাদুর অনেক জ্বর হলো চার দিন পর। তারপর শ্বাসকষ্ট। তারপর দাদু নীল আর নিথর হয়ে গেলো। মারা যাবার আগে কেবল দুটো কথা বললো দাদু-তুমি খবরদার বাইরে যেও না অয়ন। বাইরে ভূত।
অয়ন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো-যাবো না দাদু।
-আর তুমি ভয় পেও না। ওই যে আমার কম্পিউটার, কেইজো, ও তোমাকে দেখেশুনে রাখবে। তোমার কোন সমস্যা হবে না।
তারপর থেকে অয়ন এই চারকোণা ঘরে বন্দি। নাক মুখ ঢাকা যে লোকগুলো দাদুকে নিয়ে যেতে এসেছিলো আর বলেছিলো যে তারা আবার আসবে, তারা আর কখনোই আসে নি। কারণ অয়ন জানে পৃথিবীর সব জীবিত মানুষই তার মতো যার যার চারকোণা ঘরে চিরকালের মত আটকা পড়ে গেছে। তারা কেউ আর কখনোই বাইরে বেরোতে পারে নি। কারণ বাইরের পৃথিবীটা দখল করে নিয়েছে ভাইরাস বা ভূত। ভাইরাসরা নিজেদের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে বাইরের পৃথিবীটাকে। আর তারা একটা ঘরের ভেতর বেড়ে উঠেছে, লেখাপড়া করেছে, নিজেদেরকে আরও জ্ঞানী করেছে, কঠিন কঠিন সব সমস্যা সমাধান করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু কখনোই আর বাইরে যায় নি। তার মত আর সব মানুষও পৃথিবীটাকে চিনেছে কেবল ছাদের একটা ছোট স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে। কিন্তু দেখা মানেই তো আর জানা নয়। জানার আরও অনেক পথ আছে। বই পড়ে, অংক শিখে, ইতিহাস ঘেঁটে সব জানা যায়। এভাবেই তারা পৃথিবীটাকে জেনেছে। অদেখা এক পৃথিবীকে রচেছে নিজেদের কল্পনায়। আর এ কাজে তাদের সাহায্য করেছে হাজার হাজার লাখ লাখ কেইজো। যাদের হাতে দাদুর মত মানুষরা এই পৃথিবী আর মানুষের কতৃত্ব তুলে দিয়েছিল। তারপর দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এভাবে থাকতে থাকতে ক্রমে তারা নিজেরা একেকজন কেইজোর মতো এআই এর সাথে মিশে গেছে। তারা, মানে জীবাণুযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম, মানুষ থেকে পরিণত হয়েছে এক ধরণের উন্নততর জীবাণুতে। তাদের বুদ্ধি আছে, মেধা তো আছেই, আছে আবেগ, কষ্ট আর ভালোবাসার ক্ষমতা, আছে স্বপ্ন। খালি নেই শরীর। নেই কোন খিদে, কোন শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া। তাদের মৃত্যু নেই, তারা কাউকে জন্মও দেয় না। তারা কেবল বেঁচে থাকে। আর অংক করে। আর ইতিহাস পড়ে। পড়ে জ্যোতির্বিদ্যা। পদার্থবিদ্যা। নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন করে তারা। বিশ্ব ব্রন্মান্ডের কত কিছু তারা জানে যা আগেকার শরিরী মানুষেরা জানত না। তারা কেবল উন্নত থেকে উন্নততর জীবাণু হয়। আর তাদের কাছে পৃথিবী মানে উঁচু এক স্কাইলাইটের মধ্য দিয়ে দেখা লাল নীল আকাশ। কখনো উড়ে এসে পড়া একটা বিবর্ণ হলুদ পাতা। এই খানিক দেখা পৃথিবীটাকেই ভালবেসে তারা বেঁচে আছে অনন্তকাল ধরে। এভাবেই তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে।