স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর প্রতি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রতিক্রিয়া কী রকম ছিল
এ বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববাসী যখন করোনাভাইরাস মহামারীর সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিচ্ছে, তখন হঠাৎ করে একটি চিঠি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে যায় দাবানলের মত। চিঠিটি ১৯১৮ (সে বছরে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী আঘাত হেনেছিল) সালে স্কট ফিটজেরাল্ড তার বন্ধু আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে লিখেছিলেন। অন্তত চিঠিটি পড়লে সেরকমই মনে হয়। তবে আদতে এটি একটি প্যারোডি ছাড়া কিছুই না; তবে সেটা অনুধাবন করার জন্য আপনাকে ফিটজেরাল্ড এর ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ হতে হবে। চিঠিটির ভাষা ছিল এরকমঃ
"ব্যাপারটিকে মর্মান্তিক মনে হলেও এই মুহুর্তে জনসমাগম হয় এরকম সকল জায়গাকে এড়িয়ে চলা উচিত। এমনকি পানশালাও। এ কথাটি আমি হেমিংওয়ে কে বলতে না বলতেই সে খেলাচ্ছলে আমার পেটে ঘুসি মেরে বসলো। এই অতর্কিত হামলা স্বত্ত্বেও অবিচলিত থেকে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তার হস্তযুগল ধোয়া আছে কি না। দেখা গেল সে তার হাতও ধোয়নি। বস্তুত, সে মহামারীর পুরো ব্যাপারটিকেই অস্বীকার করতে চাচ্ছে। তার মতে, এই ভাইরাসটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্যাতিত কিছুই নয়। আমি তার এই অভিমতের পেছনের যুক্তিগুলো জানতে খুবই উৎসাহী!"
চিঠিটির প্রকৃত লেখক নিক ফারিয়েল্লা খুবই মুন্সিয়ানার সাথে ফিটজেরাল্ডের লেখনী ধারার সাথে একুশ শতকের চিন্তাভাবনা মিলিয়েছেন, আর সাথে যোগ করেছেন "হেমিংওয়ে" চরিত্রটির একটি বহুলব্যবহৃত ও মার্কামারা প্রতিরুপ।তাকে আমরা একজন বিরক্তিকর, পৌরুষদীপ্ত, মারদাঙ্গা ও অতিরঞ্জনপ্রিয় মানুষ হিসেবেই জেনে এসেছি, যার একটি সঠিক চিত্রায়ন এ লেখায় ফুটে উঠেছে।
এটি খুবই দুঃখজনক, কিন্তু সত্যের কাছাকাছি একটি চরিত্রায়ন। এ ব্যাপারটির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় হেমিংওয়ের জীবনের প্রায়শয়ই উপেক্ষিত এবং ধোঁয়াশায় ঢাকা একটি অংশ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে; যে সময়টি তিনি মূলত লন্ডন এবং ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় কাটিয়েছেন, এবং এর সময়কালটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত "ডি-ডে" এর আগে ও পরে।
তর্কসাপেক্ষে বলা যায় যে এই সময়টি তার জীবন এবং ক্যারিয়ারের জন্য একটি ক্রান্তিলগ্নের মত ছিল, কেননা সেসময় তিনি ছিলেন জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত লেখকদের একজন, এবং তার নামটি একটি জনপ্রিয় বাণিজ্যিক ব্র্যান্ডের মতই সুপরিচিত ছিল। তবে খ্যাতির তুঙ্গে থেকেও তিনি গুপ্তচর এবং প্রখ্যাত লেখকদের সান্নিধ্যে (যেমন তার বন্ধু রোয়াল্ড ডাল) এলে একেক সময় একেক রকম আচরণ করতেন। কখনো তিনি হতেন সবার ভালবাসার পাত্র, এবং তখন তিনি খুবই চিন্তাশীল, দীপ্যমান ও সাহসী আচরণ করতেন। আবার কখনো কখনো তার আচরণ হত খুবই লজ্জাজনক; সে সময়ে মানুষকে অকারণে তিরষ্কার এবং অপমান করতেও তার বাঁধতো না।
মহামারী নিয়ে লিখিত প্যারোডী পত্রটি অনেকের জন্য ক্ষণিকের বিনোদন জুগিয়েছিল। উডি অ্যালেনের "মিডনাইট ইন প্যারিস" সিনেমায় হেমিংওয়েকে যেভাবে একটি বন্য ও বড় বড় চক্ষুসম্বলিত কার্টুন চরিত্রের মত করে উপস্থাপন করা হয়েছিল, তার সাথে প্যারোডী চিঠির হেমিংওয়ে অনেকটাই মিলে গিয়েছিলেন।
তবে যারা হেমিংওয়ে সম্পর্কে আরেকটু ভাল করে জানেন, তারা সকলেই স্বীকার করবেন যে এই প্যারোডিটি শুধুমাত্র লেখকের দূর্বোধ্য ও জটিল চরিত্রের উপর কালিমা লেপনের "আরও একটি" ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র।
হেমিংওয়ে সম্পর্কে সঠিক তথ্য
প্রকৃতপক্ষে ১৯১৮-১৯ সালের মহামারীর প্রাদুর্ভাবকালে, এবং পরবর্তী সময়ে হেমিংওয়ের প্রতিক্রিয়া এই প্যারোডি চিঠিটির চেয়ে অনেকাংশেই ভিন্ন ছিল। সত্যটি সহজাত ভাবেই বিচিত্র, এবং যেকোন গল্প উপন্যাসের কাহিনীর চেয়েও চমকপ্রদ। অবশ্যই হেমিংওয়ে অতিরঞ্জন করতে পছন্দ করতেন, তিনি চাইতেন বিভিন্ন ঘটনাগুলোকে তার জীবনের মূলমন্ত্রের সাথে মিলাতে—"সত্য প্রায়শ্যই কল্পকাহিনীর চেয়েও বিচিত্র"; কিন্তু তার মানে এই না যে গল্প বলতে গিয়ে তিনি বৈজ্ঞানিক তত্ব এবং প্রকৃতি সম্পর্কে তার শ্রদ্ধাবোধকে বিসর্জন দিতেন।
যে যাই বলুক না কেন, তিনি ছিলেন ওক পার্ক, ইলিনয় থেকে উঠে আসা একজন ডাক্তারের নিষ্ঠাবান সন্তান। তিনি তার পিতার হাতের কাজ স্বচক্ষে অবলোকন করেছিলেন, যে অভিজ্ঞতাকে পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্ন কল্পকাহিনী রচনার সময় ব্যবহার করেছেন। হেমিংওয়ে বোদ্ধা সুসান বিজেল দেখিয়েছেন কিভাবে অসুস্থতা, রোগশোক, আকস্মিক এবং দীর্ঘ রোগভোগের পরে মৃত্যু—এগুলোর কোনটাই লেখকের কাছে নতুন কিছু ছিল না। তিনি মানব এবং পশুপাখীদের ক্ষণস্থায়ী জীবনে সম্পর্কে সম্পূর্ণরুপে ওয়াকিবহাল ছিলেন।
ডাক্তার-পুত্র হেমিংওয়ে পরবর্তীকালে নিজেই ডাক্তারসুলভ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রেড ক্রসের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে। চোখের দৃষ্টিশক্তি দূর্বল হওয়াতে তিনি যুদ্ধে যেতে পারেননি; কিন্তু দমে না গিয়ে সংকল্পবদ্ধ হেমিংওয়ে রেড ক্রসের কাজ নিয়ে ইতালীর ফ্রন্ট লাইনে চলে গিয়েছিলেন।
ইতালীতে পৌঁছুনোর ঘন্টাখানেকের মাঝেই হেমিংওয়ে দায়িত্ব পান কামানের গোলার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মানুষদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিষ্কার করার। তিনি সে ভয়াবহ দৃশ্যগুলোর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন তার বিতর্কিত ছোট গল্প "আ ন্যাচারাল হিস্টোরি অব দ্যা ডেড" এ, যেখানে তিনি এই অভিজ্ঞতাকে একই সাথে চমকপ্রদ এবং ভয়াবহ হিসেবে অভিহিত করেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি নিজেকে যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেন। যখন তাকে জীবন্মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, তখন তার পায়ে ২২৮টি বিস্ফোরিত বোমার খন্ডাংশ বিদ্ধ অবস্থায় ছিল। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক চিকিৎসা-পর্ব।
রেড ক্রসের নার্সদের সাথে কাজ করার পরে হেমিংওয়ে তার জীবনে দেখা সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ মৃত্যুদৃশ্যটি নিয়ে লেখেন। সে মৃত্যু বোমা কিংবা বুলেটের আঘাতে ঘটেনি। তার ভাষায়ঃ "আমার দেখা একমাত্র স্বাভাবিক মৃত্যুটি ছিল স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা ঘটিত মৃত্যু। এ রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ নিজের শ্লেষ্মায় ডুবে যায়, তার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে, এবং আপনি তখনই বুঝবেন যে রোগী মারা গিয়েছে, যখন দেখবেন সে নিজ বিছানায় মলত্যাগ করে দিয়েছে"।
এ ধরণের ভয়াবহ দৃশ্যগুলো অহরহই দেখা যেত সেই বিশ্বব্যাপী মহামারীর সময়ে, যা ১৯১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝে কেড়ে নিয়েছিল প্রায় ৫ কোটি মানুষের জীবন। আমাদের জানা মতে সেসময় কোন সঙ্ঘবদ্ধ জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক গবেষণা হয়নি এ রোগের ব্যাপারে, কোন কার্যকর চিকিৎসাও আবিষ্কৃত হয়নি, এবং কোন টিকাও কেউ বানাতে পারেনি সময় মত। হেমিংওয়ের মত সৈন্য এবং স্বেচ্ছাসেবকেরা ভাইরাসের সাগরে সাঁতার কাটছিলেন রীতিমত।
রোগকে এড়িয়ে যাওয়া
এত কিছুর পরেও হেমিংওয়ে সক্ষম হয়েছিলেন ১৯১৮ ও ১৯১৯ সালে আসা মহামারীর ঢেউগুলোকে এড়িয়ে যেতে; কখনো কয়েক সপ্তাহ, কিংবা কয়েকদিনের ব্যবধানে। তিনি কিছুদিন ইতালীতে চিকিৎসাধীন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়েছিলেন। নিজ দেশে ফিরে তিনি আবিষ্কার করলেন যে আত্মীয় ও বন্ধুদের মাঝে অনেকেই স্প্যানিশ ফ্লুর কাছে প্রাণ দিয়েছেন। বাহ্যিকভাবে তারুণ্যসুলভ উদাসিনতা প্রকাশ করতে থাকলেও ভেতরে ভেতরে এসব নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। বিশেষ করে, ইতালীর মৃত্যুপথযাত্রী সেই সৈনিকের কথা তিনি কখনোই ভুলতে পারতেন না।
তার কৌশলী আত্নজীবনী লেখক মাইকেল রেনল্ডস এর মতে, হেমিংওয়ে মৃত্যু নিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন, এবং "ফ্লু এর সামান্যতম সম্ভাবনা দেখা দিলেই তিনি স্বাস্থ্যকর জায়গায় সরে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতেন। তার মনে নিজের শ্লেষ্মায় ডুবে থাকার ব্যাপারে ভয়াবহ ভীতি কাজ করতো"। একই ধারায়, ১৯২৬ সালে, প্যারিসে থাকাকালীন সময়ে তার পুত্র জ্যাক (ডাকনাম বাম্বি) যখন কঠিন কাশিতে আক্রান্ত হলেন, তখন দ্রুততম সময়ে হেমিংওয়ে তাকে এবং তার স্ত্রী হ্যাডলিকে রিভিয়েরার বিশুদ্ধ বাতাস এবং সূর্যালোকের সান্নিধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেরে ওঠার জন্য, এবং তিনি নিজে একা স্পেনে চলে গিয়েছিলেন কাজ করার উদ্দেশ্যে।
হ্যাডলি এবং বাম্বি হেমিংওয়ে এন্টিবেস এ এসে পৌঁছান ১৯২৬ সালের ২৬শে মে, এবং শিশুটিকে প্রায় সাথে সাথেই ছোঁয়াচে, এবং প্রাণঘাতী হুপিং কাশির রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর আদেশ দেয়া হয়, এবং উনারা জেরাল্ড মার্ফির ১৪ কক্ষ বিশিষ্ট ভিলার পাশে অবস্থিত ছোট একটি বাড়ীতে অবস্থান গ্রহণ করেন।
একদিন পর তাদেরকে হুয়ান লেস পিন্স এ অবস্থিত স্কট এবং জেল্ডা ফিটজেরাল্ডের পুরনো বাসস্থান, ভিলা পাকিতায় স্থানান্তর করা হয়। ফিটজেরাল্ড দম্পতি অন্যত্র গিয়েছিলেন স্বাস্থ্যোদ্ধারের উদ্দেশ্যে।
ব্যাপারটাকে আরও জটিল করার জন্য হেমিংওয়ের উপপত্নী পাওলিন ফেইফার প্যারিস থেকে আগমন করেন। তিনি ছিলেন প্রক্যাত "ভোগ" পত্রিকার প্যারিস-ভিত্তিক সম্পাদক। ৪৮ ঘন্টার মাঝে এই বিচিত্র সমাবেশকে পরিপূর্ণতা দিতে হেমিংওয়ে নিজেই হাজির হন সেখানে।
কিছু সময়ের জন্য, এই কোয়ারেন্টাইনটি সবার জন্যই বেশ আমোদপূর্ণ ছিল। দিনের বেলায় হেমিংওয়ে তার বেস্টসেলার হতে যাওয়া বই "দ্যা সান অলসো রাইসেস" এর সম্পাদনার কাজ করতেন। সন্দ্যেবেলায়, সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ককটেল হাতে নিয়ে বসতেন। মার্ফি এবং ফিটজেরাল্ড দম্পতিরা বাগানের বেড়ার ওপর পাশে বসতেন। মদের খালি বোতলগুলোকে উলটো করে কাটা মুন্ডুর মত বেড়ার উপর বসানো হতো। প্রতিটি উল্টানো বোতল হেমিংওয়ের সন্তানের কোয়ারেন্টাইনে থাকার দিবস গণনা করার কাজে ব্যবহার করা হোত।
কিছুদিন পর্যন্ত এই বন্দোবস্তটি ভালভাবেই আগাচ্ছিল।
হেমিংওয়ের সন্তান সুস্থ হয়ে উঠে এবং তাদের কোয়ারেন্টাইন জীবনের অবসান ঘটে। তবে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে বাম্বি এবং তার দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত মহিলাটিকে সে বাড়ীর কাছেই রাখা হয়, আর হেমিংওয়ে ওঠেন কাছাকাছি একটি সুন্দর হোটেলে—তার দুই নারীকে নিয়ে।
সেই কোয়ারেন্টাইনপূর্ণ গ্রীষ্মের এক বছরের মাঝে হেমিংওয়ে দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায়।
১১ বছর পরে, ১৯৩৭ সালে, আপস্টেট নিউ ইয়র্কের সারানাক লেকে কোয়ারেন্টাইন থাকা স্বত্ত্বেও মার্ফিদের ১৬ বছর বয়সী পুত্র প্যাট্রিক যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
হেমিংওয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো শহরে, ১৯৬১ সালের জুলাই মাসের ২ তারিখ ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে আত্মহত্যা করেন।
১৯২৬ সালে হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হওয়া ছেলেটি, যার নাম ছিল জ্যাক "বাম্বি" হেমিংওয়ে, তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের চেয়ে অধিকতরসুখী একটী জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি বীরের মত লড়েছিলেন; এবং নাজি জার্মানীতে প্যারাসুটের মাধ্যমে অবতরণের পর ধরা পড়েন এবং বন্দী হন। পরবর্তীতে ২০০০ সালে তার শান্তিপূর্ণ মৃত্যু ঘটে।