স্যাটায়ার
পীর সাহেব হাত কচলাইয়া বলিলেন। হুযুর আমি কবে শরিয়ত অবহেলা করিলাম?
উত্তর হইল: অবহেলা কর নাই, কিন্তু পালনও কর নাই। আমি শরিয়তে চার বিবাহ হালাল করিয়াছি। কিন্তু তোমার মাত্র তিন বিবি। যারা সাধারণ দুনিয়ার মানুষ তাহাদের এক বিবি হইলেও চলিতে পারে। কিন্তু যাহারা রুহানী ফয়েজ হাসেল করিতে চায় তাহাদের চার বিবি ছাড়া উপায় নাই। আমি চার বিবির ব্যবস্থা কেন করিয়াছি তোমরা কিছু বুঝিয়াছ? চার দিয়াই এ দুনিয়া, চার দিয়াই এ আখেরাত। চারদিকে যা দেখ সবই খোদাতা'লা চার চিজ দিয়া পয়দা করিয়াছেন। চার চিজ দিয়া খোদাতালা আদম সৃষ্টি করিয়া তার হেদায়াতের জন্য চার কিতাব পাঠিয়েছেন। তাই হেদায়েত পাইতে হইলে মানুষকে চার ইমামের চার মজহাব অনুসারে চার তরিকা মানিয়া চলিতে হয়... এই চারের পরদা ঠেলিয়া আলমে-আমার নূরে ইযদাচিতে ফানা হইতে হইবে, দুনিয়াতে চার বিবির ভজনা করিতে হইবে।'
উপায় নেই মুরিদগণের অনিষ্ট ঠেকাতে পীর সাহেবকে মুরীদের ছোট ছেলের তরুণী স্ত্রীকেই বিয়ে করতে হবে। এই হচ্ছে এখন থেকে অন্ততঃ আশি বছর আগে এই বাংলাদেশের সুফলা মাটির স্যাটায়ার। কাজটি করেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ তার 'হুজুর কেবলা'তে। সে আসলে একজন বাস্তবের শেরে বাংলা তো ছিলেনই কিন্তু স্যাটায়ারিষ্ট আবুল মনসুর আহমদ আরো যোগান দিলেন: যাদের কেউ চুঁয়ারে বাংলা, কেউ শেয়ালে বাংলা, ইন্দুরে বাংলা, মহিষে বাংলা এমনকি কেউ একজন কুত্তায়ে বাংলা। 'ফুড কনফারেন্স' এই গল্পটির নাম।
পঞ্চাশ বছর আগেই হুজুর কেবলা ও ফুড কনফারেন্স মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের টেক্সট বইতে ছিল।
কোনটা স্যাটায়ার - তখন যে টেক্সট বইতে ছিল সেটা না এখন যে নেই সেটা?
আমি বললাম, এ দুটো গল্পই এ দেশিয় স্যাটায়ার। পাঠক বললেন, বই পড়লাম তো কিন্তু হাসি তো তেমন আসেনি। হাসি তো না না আসারই কথা -- স্যাটায়ার তো শ্রেফ রম্য রচনা নয়, তার চেয়ে বেশি।
১৭২৬ সালের ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত হলে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি 'ফালতু বই'-- গালিভার্স ট্র্যাভেলস। জোনাখান সুইফট-এর লেখক। যখন বইটি হাতে হাতে ঘুরছে বুদ্ধিজীবী কিসিমের কিছু লেখক বললেন, ফালতু বই।
জোনাখান সুইফটও হাসলেন, ফালতুই তো।
যখন লিলিপুট সাম্রাজ্যের রাজপ্রাসাদে আগুন ধরে যায়, সাম্রাজ্ঞী ও রাজকন্যা এবং হেরেম শরিফের সুন্দরীদের কান্না ও উদ্বেগ সম্রাটকে বিচলিত করে। তিনি কাতর হয়ে গালিভারকে বললেন, একটা কিছু কর, একটা কিছু কর।
কী আর করবেন! কোথায় ফায়ার ব্রিগেড, সমুদ্র থেকে পানি এনে ঢালতে ঢালতে সবই তো ভষ্মীভূত হয়ে যাবে। এই মানুষগুলোকে তো রক্ষা করতে হবে। গালিভার বোতাম খুলতে শুরু করলেন, ডানেবায়ে তাকিয়ে ব্যক্তিগত হোস পাইপটি বের করে প্রাসাদের উপর ছড়িয়ে দিলেন জলধারা। আগুন নিভে গেল। তার আগে এমন হোস পাইপ দেখে লিলিপুটের নারীকূল থ পুরুষকূলও।
এই অসাধারণ স্যাটায়ার নিয়ে একজন ধর্মযাজক তার মন্তব্য জানিয়ে দিলেন : আমি এই বইয়ের এক বর্ণও বিশ্বাস করি না।
স্যাটায়ার হচ্ছে রাষ্ট্রের এবং জনগণের স্বাধীনতা মাপার একটি ইনডেক্স বা সূচক। এই সূচক ধরে মাপা যায় কোন দেশ কোন সমাজ কোন সম্প্রদায় কতোটা সভ্য।স্যাটায়ার সভ্যতার মাপদন্ড।
এক ব্রিটিশ বালক পাগলা ঘন্টি সম্পর্কে জানে। পাগলা গারদ থেকে পাগল পালিয়ে গেলে অবিরাম ঘন্টা বাজিয়ে সংবাদটি জানিয়ে দেওয়া হয়। বালক তার মাবাবার সাথে টেমস নদীর তীরে ওয়েস্টমিনস্টারে পার্লামেন্ট হাউসে গেল। সেশন শুরু হবার আগে অবিরাম ঘন্টা বাজানো হয়, আমাদের অসামান্য স্থাপত্যের সংসদ ভবনেও তাই, ঘন্টা বাজে। ছেলেটির বাবা এমন ঘন্টাবাজার শব্দে শুনে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হচ্ছে।
উত্তর ছেলেটিই ছিল : বাবা ওদের কেউ পালিয়েছে।
ছেলেটির পুরো সংসদীয় প্রক্রিয়া বোঝার কথা নয় কিন্তু তার অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু বলেছে এটাই স্যাটায়ার।
স্যাটায়ার হজম করতে রসবোধ লাগে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি লাগে। দুর্ভাগ্যবশতঃ অনেকদেশে দুটোর ঘাটতি, লিখতে চেয়েও পাকা হাতের স্যাটায়ারিষ্ট নিজের কাজটি না করে বিরহের উপন্যাস লিখেন। এটিও স্যাটায়ার।
বিশ্বসাহিত্যের শুরুটা স্যাটায়ারিস্টদের হাতে! ঈশপ তো খ্রিষ্টজন্মের ৬২০ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছেন, ডায়োজোনস, এরিস্টো ফ্যানস, লুসিলাস, হোরাস, ওভিদ, সেনেকা, পার্সেউস পেট্রোলিয়া, জুভেনাল, এপুলিয়াস-- তাদের সবাই খ্রিষ্টজন্মের আগেকার লেখক। স্যাটায়ারের ভিত্তিটা খুব সবল। তাদেরই একজন বলেছেন আসলে ঈশ্বর যে সবচেয়ে বড় স্যাটায়ারিষ্ট তার প্রমাণ মানুষের মতো এমন উদ্ভট প্রাণীর সৃষ্টি। রসবোধ না থাকলে এমন জিনিস পয়দা করা সম্ভব নয়। এমনকি কুকুরও নাকি যথেষ্ট বসবোধের অধিকারী। পা তুলে হিসু করার জায়গা হিসেবে বেছে নেয় রাজপ্রাসাদে দেয়াল।
বাংলা সাহিত্য নিয়ে যত গর্বই করি না কেনো আর উর্দু-ফার্সি এসব নিয়ে যত খুঁতে খুতেই হই না কেনো, বাস্তবে বাংলা এদের হাঁটুর বয়সী। বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি যারা নির্মাণ করেছেন বিশ্বসাহিত্য স্রষ্টাদের মতো তারাও স্যাটায়ার সৃষ্টি করেছেন, আবার সিরিয়াস কাহিনীও লিখেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবীনচন্দ্র সেন, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, ত্রৈলোক্যানাথ মুখোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় এবং খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-- চাবকানো ঠাট্টা করতে ছাড়েন তাদের কেউ। রবীন্দ্রনাথের পর আরও অন্তত পঞ্চাশজন লেখক কবির নাম বলা যাবে যাদের অন্যতম উপজীবব্য স্যাটায়ার।
খুশবন্ত সিংহের লেখায় পাবেন : বাসে এক বিহারি নিজেদের আহাম্মকি নিয়ে গল্প করছিল। অমনি এক সর্দারজি তাকে ঘুষি মেরে বসল এবং বলল, সর্দার কি দুনিয়া থেকে শেষ হয়ে গেছে নাকি না বিহারিদের আহাম্মক হতে হবে।
স্যাটায়ার গ্রন্থ কী কাজে লাগে?
স্যাটায়ারিস্ট বললেন, আমার নাতি বইগুলোর উপর পা দিয়ে কমোডে বসে। কমোড একটু উঁচু কি না!
এই সংক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ রচনাটিতে কিছু, স্যাটায়ার ধর্মী কবিতার উদাহরণ টানা হবে:
তুমি মা কল্পতরু, আমরা সব পোষা গরু।
সত্যিকার অর্থে বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বাধীন স্রষ্টা হচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তিনি সমাজপতিদের তোয়াক্কা করেননি, কোম্পানির সাহেব সুবা-দারোগা কাউকে আমলে নেননি, এমনকি ভারতবর্ষের মা-জননী মহারানি ভিক্টোরিয়াকে ছাড় দেননি এবং এমনকি ভগবানকেও বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে চেষ্টা করেছেন। যারা দল, সরকার, ভজনালয় ও ভোজনালয়ের দাসত্ব করে তারা কখনো স্বাধীন নয়। স্বাধীন না হলে স্যাটায়ার বা রঙ্গরস করা যায় না। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল স্যাটায়ারিষ্ট। মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রশংসা করতে বলে ফেলবেন:
বাঙ্গালী তোমার কেনা এ কথা জানে কে না?
হয়েছি চিরকেলে দাস
করি শুভ অভিলাষ
তুমি মা কল্পতরু আমরা সব পোষা গরু
শিখিনি শিং বাঁকানো
কেবল খাবো খোল বিচালি ঘাস।
নীল কুঠির সাহেব আর ব্রিটিশ শাসনের বাপপ্রাপান্ড করে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহারানিকে উদ্দেশ্য করে বিণীত স্বরে বলেন :
রাজবিদ্রোহিতা কারে বলে স্বপ্নে জানি না
কেবল ঈশ্বরের নিকটে করি
তোমার জয়ের বাসনা।
মনোমোহন বসু, (১৮৩১-১১-১২) লিখলেন, এ দেশীয় হরিলুট বন্ধ হয়ে গেছে তাতে কী এসে যায় 'বিলিতি লুট চলছে এখন'--দেশির বদলে ইংলিশ ক্যানে --দেশি দালাল পেয়ে যাচ্ছেন রিওয়ার্ড আর প্রমোশন।
হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) একহাত নিলেন খবরের কাগজের বিশিষ্ট সম্পাদকদের। তারা কি নিজেদের বৌবাচ্চার খোঁজ খবর রাখেন? দুনিয়ার খবর তাদের কাছে।
কাগজের এডিটারি করে মরে যারা
তাহাদের কামিনীরা কেঁদে কেঁদে সারা
রাত্রি দিন এত খাটে হায় লো স্যাঙ্গাৎ
হপ্তায় মিনিট পাঁচ হয় না সাক্ষাৎ
এত লেখে এত পড়ে এত ছাপা ছাপে
তবু পদ নাহি পায় অভাগীর পাপে।
হারানচন্দ্র রাহা (জন্ম ও মৃত্যুবছর অজ্ঞাত্) বিলেত ফেরত বাঙ্গালি যুবকের স্ত্রীর কথা লিখেছেন। বাবু চায় তার স্ত্রী বিবি সাজুক। কিন্তু ঘোমটা খুলে লাজলজ্জা ভুলে স্বামীর খায়েশ মেটানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই স্ত্রীর মুখ ফোটে :
আমি ত হব না বিবি থাকিতে এ প্রাণ
কেমনে হোটেলে যাব,
কেমনে টেবিলে খাব?
কেমনে সহিব বল পিয়াজের ঘ্রাণ!
হায়, বাবু তুমি বড় কঠিন পরাণ।
গোবিন্দ চন্দ্র দাস (১৮৫৫-১৯১৮) স্বদেশীদের বললেন, স্বদেশ স্বদেশ করিস নারে এ দেশ তোদের নয়। 'কুকুর মেকর ছাগল কবে দেশের মালিক হয়?'
বঙ্গ সন্তান বিলেতিদের নিয়ে চরম বঙ্গ করলেন তিনি :
যে সব বাবু বিলাত গিয়ে 'বাবুনি'দের সঙ্গে নিয়ে
প্রসবিয়ে আনছে তাদের সাবক সমুদয়
ব্রিটিশ বরণ (born) বলে দাবী কর্লে নাকি বিলাত পাবি ?
লজ্জাহীনের গোষ্ঠি তোরা নাইরে লজ্জা ভয়!
এ্ই যদি রে ব্রিটিশ বরণ মরণ কারে কয়।
গোবিন্দ্রচন্দ্র দাস বাংলাদেশের ভাওয়ালের কবি। তার স্যাটায়ার কুসংস্কার, কুপ্রথা ও মেকী স্বদেশভক্তির বিরুদ্ধে। ব্যক্তি জীবনে প্রভারিত এই মানুষটির কাব্যগ্রন্থ 'মগের মুল্লুক' (১৮৯২)- নামই বলে দেয় কী আছে এর ভেতর। নন্দলাল!
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩)। তিনি লিখলেন:
পড়ে আছি চরণতলায়।
নাকটি গুঁজে অনেক কাল
সৈবে সবই নইত মানুষ
আমরা সবাই ভেড়ার পাল;
যে যা করিস দেখিস চাচা,
মোদের পৈত্রিক প্রাণটা বাঁচা
শাঁসটা খেয়ে আঁশটা ফেলে
দিস রে দুটো দুবেলায়!
নন্দলাল। তার সঙ্গে আমাদের আশৈশব পরিচয়। এই নন্দলালও বলেছে দেশের জন্য তার জীবনটা না হয় দিলই --কিন্তু তাতে অভাগা দেশের কি হবে? তার চেয়ে নন্দের বেঁচে থাকাটা জরুরি।
বিক্রমপুর ও বরিশালের মুকুন্দ দাস (১৮৭৮-১৯৩৪)- উদ্ধৃত না করলে ব্যঙ্গ সাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে :
খেতে ভাত সোনা থালে
নাউ সেটিসফাইড ষ্টীলের থালে
তোমার মতো মূর্খ কি আর দ্বিতীয়টি মেলে
পমেটম লাইক করিলি দেশী আতর ফেলে,
সাধে কি দেয় রে গালি 'ব্রুট ননসেন্স ফুলিশ' বলে।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), বাংলার এই ছান্দসিক কবি তার 'বাঙ্গালী চরিত' কবিতাটি বাঙ্গালি চরিত্রকে হালকা চালে ভীষণ চাপকে দিয়েছেন-- 'বিপদের নামে থাকি গো অটল/কাছে এলে আঁখি করে টলটল/ আর স্কন্ধে চাপিলে তুলি গো পটল ভয়েতে হইয়া মাটি।' খেলো চরিত্রের বাঙ্গালিকে বলেছেন, 'মোরা জীবনতরণী সেই দিকে বাহি/যখন দেখি ভাটি।'
কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) হাতে লিখিত বাংলা সাহিত্যের কিছু অন্যতম স্যাটায়ার কর্মী কবিতা-ভূত বাগানের গান, সুপার জেলে বন্দনা, ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস, তৌবা প্যারটু, শ্রীচরণ ভরসা, দে গরুর গা ধুইয়ে। 'বাঙ্গালী বাবু' থেকে খানিকটা উদ্ধৃত হচ্ছে :
নখ-দন্ত বিহীন চাকুরী অধীন আমরা বাঙ্গালী বাবু
পায়ে গোদ গায়ে ম্যালেরিয়া
(বুকে) কাশি লয়ে সদা কাবু
ঢিলেঢালা কাছা কোঁচা সামলায়ে
ভুঁড়ি বয়ে ছুটি নিটপিটে পায়ে
আপিসে আসিয়া কলম পিশিয়া
ঘরে এসে খাই সাবু।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গবীরদের খুব ভালো করে চিনতেন বলে আস্ফালন সর্বস্ব বীরদের নিয়ে কাব্যচর্চা করেছেন, দেশের উন্নতির জন্য দেওয়ানা হয়ে উঠা মানুষও বাদ পড়েননি :
পরের দোষে নাসিকা গুঁজে
গল্প খুঁজে গুজব খুঁজে
আরামে আঁখি আসিবে বুজে
মলিন পশু প্রায়
মাদুর পেতে ঘরের ছাতে
ডাবা দুকোটি ধরিয়া হাতে
করিব আমি সবার সাথে
দেশের উপকার!
স্যাটায়ারের একটি জনপ্রিয় ধরণ হচ্ছে প্যারোডি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বাংলার অনেক কবির রচনা সজনীকান্ত দাসের হাতে পড়ে ক্ষুরধার প্যারোডি হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের 'উর্বশী' হলো:
নহ পিতা, নহ পুত্র, নহভ্রাতা, নহ জ্যান্তপ্রাণী
মসীজীবী বঙ্গের কেরানী।
বনফুল নামের বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় উর্বশীর জায়গায় শালাকে বসালেন/আর শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় বানালেন অনন্তযৌবনা শালী।
নজরুলের 'কান্ডারী হুশিয়ার কবিতা' বিস্বাদ হয়ে উঠল সজনীকান্তের কল্যাণে:
চোর ও ছ্যাঁচোড়, ছিঁচকে সিধেলে দুনিয়া চমৎকার
তলপি-তলপা তহবিল নিয়ে ভান্ডারী হুশিয়ার।
বাজার করিয়া চাকর বাবাজি ভারী করে ফেরে ট্যাক
ঘি-তেল চুরিতে বামুন ভায়ার হয়েছে বিষম ন্যাক।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা'র কী ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটালেন সতীশচন্দ্র ঘটক:
এমন আপিম কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল বুদ্ধি হানি করা আমার কর্মভূমি
এতো রুক্ষ সাহেব কাহার কোথায় এমন ভৎর্সনা হায়
কোথায় এমন লোহিত নেত্র কটমটিয়ে থাকে?
কানের উপর হাত খেলে যায় মৃদু মধুর পাকে।
কেরাণীদের শীর্ণ দেহ, কোথায় এমন পাবে কেহ?
চাকরি মা, তোর চরণ দুটি নিত্য পুঁজা করি
আমার এই আপিসের কর্ম যেন, বজায় রেখে মরি।
ওদিকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো মৃদুস্বরের ছন্দ জাদুকর রবীন্দ্রনাথের উর্বশীকে ছেড়ে দিলেন না, তাকে বানালেন সুমাংসী সর্বশী :
নহ ধেনু নহ উষ্ট্রী, নহ ভেড়ী, নহ গো মহিষী
হে দামুন্যা-চারিনী সর্বশী।
দাদা ঠাকুর হিসেবে পরিচিত শরৎচন্দ্র পন্ডিত (১৮৮১-১৯৬৮) লিখলেন 'আমার মাথা থেতো কর দাও হে তোমার/রিফর্ম্ম-শিলের তলে।' আর সতীশচন্দ্র ঘটক বাংলার ঢেঁকি, কুলো, হাঁড়ি, চুলো, টিকি, কোঁচা, কচু, মোচা যা কিছু আছে প্রার্থনা করেছেন 'পুজ্য হোক হে ভগবান'।
অমিয়কুমার মুখোপাধ্যায় কালীপ্রসন্ন ঘোষের 'পারিব না এ কথাটি বলিও না আর'- কে করে ফেললেন-
'করিব না চুরি' কভু বলিও না আর।
কেন করিবে না চুরি ভাবো একবার?
উন্নতি চাহে যারা
আগে চুরি করে তারা
চুরি করে হতে হয় নেতা জনতার
একবার নহে, চুরি কর শতবার।
পিনাকীশঙ্কর রায় চৌধুরীও রবীন্দ্রনাথে ভর দিয়ে রাষ্ট্রের নেতাদের ধুয়ে দিলেন:
হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ ভোটদান
জিতিলে যে নাহি রবে তোমাদের সমান
এমনলএ এমপি করে
তোমরা পাঠালে যারে
অ্যাসেমব্লিতে পার্লামেন্টে ভাগ্য গুণে পেয়ে গেল স্থান
জিতে গেলে থাকে না সে তোমাদের সমান।
কিন্তু জনগণকে তো তারা খালি হাতে ফেরাবেন না। কিন্তু দেবেন কি?
উত্তর জেনে নিন: কাঁচকলা আর অশ্বডিম্বের আধখান।