২০২০ সাল: খারাপ, নাকি নিকৃষ্ট?

ব্রেক্সিট থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার ৪৬ মিলিয়ন একর অঞ্চল অগ্নিদগ্ধ হওয়া, হাজার হাজার মানুষের ঘর ও প্রাণীপ্রজাতির আগুনে পুড়ে যাওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ সংক্রান্ত অস্থিরতা, প্রচণ্ড শক্তিশালী হারিকেনের আঘাত এবং সর্বশেষে বছরজুড়ে চলা মহামারী কোভিড-১৯এ লাখো মানুষের মৃত্যু ও ভয়- সব মিলিয়ে ২০২০ সালের চাইতে খারাপ বছর যেন হতেই পারে না! কিন্তু আসলেই কি তাই? অতীতে এর চাইতেও খারাপ বছর কি দেখেছে কখনো মানুষ?
২০২০ সবচাইতে নিকৃষ্ট বছর কিনা তার বিচারটা তোলা থাকলো পাঠকের জন্য। তবে তার আগে চলুন, এই বাজে সালটাকেও খারাপ ঘটনার দৌড়ে শক্ত একটা প্রতিযোগিতার মুখোমুখি করতে পারে এমন কিছু অতীত বছরের কথা জেনে নেওয়া যাক!
৫৩৬
২০২০-এ পুরো পৃথিবীতে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে বটে, তবে ৫৩৬ সালে ব্যাপারটা ছিলো আরো একটু বেশিই ভয়াবহ! সেবার আইসল্যান্ডে বিশাল এক অগ্ন্যুৎপাত হয়। আর এর ফলে যে বিশাল পরিমাণ ছাই উৎপন্ন হয় সেটি পুরো পৃথিবীকে মুড়ে দেয়। সূর্যও আড়াল হয়ে যায় অনেকটা কুয়াশার ওপারে! আর সেটাও এক বা দুই মাসের জন্য নয়, এই অবস্থা চলে টানা ১৮ মাস!

ব্যাপারটাকে এখনো অতটা খারাপ মনে হচ্ছে না? ঠিক এজন্যই সেবার অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তাপমাত্রা অসম্ভব শীতল হয়ে যায়। ফসল উৎপন্ন হয় কম এবং পৃথিবীজুড়ে দূর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সাথে মনে রাখার মতো প্লেগ মহামারী তো ছিলোই!
প্লেগ রোগে সেবার সাধারণ জনগণ তো বটেই, শুধু রোমান সাম্রাজ্যেরই ২৫-৩০ শতাংশ মানুষ মারা যায়। তাহলে কী ভাবছেন? ২০২০-কে কি আর অতটা খারাপ বলে মনে হচ্ছে?
১৫২০
৫৩৬ তো অনেক আগের কথা। একটু ঘুরে ১৫২০ সালকেই দেখুন না! ইউরোপে সেবার খুব একটা যে ক্ষতিকর ঘটনা ঘটেছিলো তা নয়। তবে আমেরিকার ভাগ্যে একের পর এক দূর্ভোগ নেমে আসে এই বছরে।
সে বছর এপ্রিল মাসে মেক্সিকোর ভেরাক্রুজে একদল স্প্যানিশ অনুসন্ধানী দল ঘুরতে আসে। আরো অনেক কিছুর সাথেই তারা নিয়ে আসে স্মলপক্স বা গুটিবসন্ত। অনেক বছরের আঘাতের পর ইউরোপ তখন গুটিবসন্তে সহনীয় হয়ে গিয়েছে। তবে আমেরিকানদের মধ্যে এই রোগের কোন পূর্ব-অভিজ্ঞতাই ছিলো না। অক্টোবরের মাঝ অব্দিই ভাইরাস পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় অর্ধেক মানুষকে মেরে ফেলে।

শুধু ভেরাক্রুজ নয়, আমেরিকার প্রায় ৯০% জনসংখ্যা সেবার উধাও হয়ে যায় ইউরোপিয়ান এই ভাইরাসে।
১৯১৮
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন প্রায় শেষের পথে। এমন সময় হুট করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এসে আঘাত হানে। ভয়ংকর এই মহামারীটি প্রায় এক বছর স্থায়ী হয়!
কোভিড-১৯ মহামারীতে শিশু ও তুলনামূলকভাবে সুস্থ ও তরুণ শরীরের অধিকারীরা কম আক্রান্ত হলেও সেই মহামারীর প্রকোপ পড়ে পাঁচ বছরের নিচে ও ২০-৪০ বছর বয়স্ক মানুষের উপরে। এখনকার মতো তখনও কোন টিকা ছিলো না এই ভাইরাসের। ভীড় করতে মানা করা হচ্ছিলো সবাইকে, মাস্ক পরতেও বলা হচ্ছিলো। তবে এতে খুব যে একটা লাভ হচ্ছিলো তা না।

১৯১৮ সালের এই ফ্লুর কারণে পৃথিবীর অন্তত ৫০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে ৬৭৫,০০০জন ছিলো শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই। আসল মৃত্যুর পরিমাণ আরো বেশি বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদেরা। শুধু জনগণ নয়, খোদ সরকারও টলে গিয়েছিলো সেবার মহামারীতে!
১৯৩৩
ইতিহাসের সবগুলো বছর শুধু মহামারীর কারণেই নিকৃষ্ট হয়ে যায়নি। আর এমনই একটি মানবসৃষ্ট বাজে বছর ছিলো ১৯৩৩ সাল। সেবার জার্মানির সংসদ ভবনে লাগা আগুনের সুযোগ নিয়ে হিটলার নিজের রাজনৈতিক শত্রুকে আটক করে এবং জরুরী ক্ষমতা হাতে নিয়ে নেয়। ন্যাজি পার্টি সেবার ইচ্ছা করেই সংসদে আগুন লাগিয়েছিলো বলে মনে করা হয়।

বিশ্বজুড়ে তখন ১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া গ্রেট ডিপ্রেশনের ভয়াবহ প্রভাব চলছে। হিটলারের জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করা সেসময় ধীরে ধীরে পরবর্তী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং প্রায় ৭৫-৮০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। হিটলার ও তার বাহিনীর হাতে সেবার মারা যায় অসংখ্য দাস, ইহুদী যাদেরকে হিটলার বেঁচে থাকার যোগ্য মনে করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৪৫ সালে শেষ হলেও এর ভয়াবহতা কখনোই কখনোই ভুলতে পারেনি মানুষ!
সবগুলো বছরের দিকে চোখ বুলিয়ে নিজেকে কি একটু হলেও সৌভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে? খুব দ্রুতই হয়তো বর্তমানের এই মহামারীকে পার করে নতুন স্বপ্নের দিকে হাঁটবো আমরা। তাই নেতিবাচক সবকিছুকে পেছনে ফেলে চলুন এবার ২০২১-কে স্বাগতম জানাই!