বাফুফের অর্থ খরচে যতো অনিয়ম পেয়েছে ফিফা
অনিয়ম আর বাফুফে যেন একে অপরের পরিপূরক। দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফুটবলের উন্নয়ন ছাড়া বাকি সব কিছুতেই যেন সবার ওপরে। দুর্নীতিতেই যেন বসবাস তাদের। আর্থিক অনিয়মের দায়ে ফিফা নিষিদ্ধ করেছে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে। সাথে জরিমানাও হয়েছে তার।
যেসব অনিয়মের জন্য সোহাগের এই শাস্তি, তার সব ঘটনা ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে। যেটির তদন্ত শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে।
গত বছর অক্টোবরে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ফিফার সদর দপ্তরে শুনানি হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি। যেখানে সোহাগ ও তার পক্ষে চারজন আইনজীবী অংশ নেন। কিন্তু নিজের দোষ ঢাকতে পারেননি সোহাগ। ফিফার আনা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তি পেতে হয়েছে তাকে।
বাফুফে সাধারণ সম্পাদকের ব্যাপারে দীর্ঘ তদন্ত ও শুনানি কার্যক্রমের পরই সিদ্ধান্তে আসে ফিফা। মোট ৪টি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। ধারা ১৫ , ধারা ১৩, ধারা ২৪ ও ধারা ২৮, মোট এই চারটি নিয়মের বেড়াজালে আটকেছেন সোহাগ।
চারটির মধ্যে প্রথম তিনটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিফার এথিকস কমিটি। কেনাকাটা ও ফিফার তহবিল অপব্যবহার নিয়ে আবু নাঈম সোহাগকে পাঠানো ৫১ পৃষ্ঠার চিঠিটি ফিফার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। যে চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে বাফুফে ও এএফসিকে।
বাফুফেকে দেওয়া ফিফার তহবিলের ব্যবহার নিয়েও বেশ কিছু অসংগতি ধরা পড়েছে ফিফার তদন্তে। কেনাকাটায় চারটি অনিয়মের কথা বিস্তারিত উল্লেখ করেছে ফিফা।
খেলোয়াড়দের খেলার সরঞ্জাম ও জার্সি
২০২০ সালের জুনে আবাসিক ক্যাম্প ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ম্যাচের জন্য খেলোয়াড়দের খেলার সরঞ্জাম কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাফুফে। দরপত্র জমা দেয় স্পোর্টস লিংক, স্পোর্টস কর্নার ও রবিন এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। নিলামে জিতে পণ্য সরবরাহের কাজ পায় স্পোর্টস লিংক। বা
বাফুফে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৩০ হাজার ২৭ ডলার (প্রায় ৩৩ লাখ টাকা) মূল্যের পণ্য সরবরাহের কার্যাদেশ দেন সোহাগ।
কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপের তদন্তে উঠে আসে, যে তিনটি প্রতিষ্ঠান বিড করেছিল, প্রত্যেকটিই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। তিন বিডেই 'কোটেশন' শব্দটি 'Qutations' বানানে লেখা। কোনোটিতেই প্রতিষ্ঠানের সিল নেই। দুটি বিডের বক্তব্য শুরু হয়েছে একই কথা দিয়ে, '...পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে।' যদিও তাদেরকে পণ্যের কোনো অর্ডারই দেওয়া হয়নি।
২০২১ সালের ৫ মার্চ ফিফার নিয়োগ করা বিডিও এলএলপির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনটি দরপত্রের ডিজাইন একই রকম। রবিন এন্টারপ্রাইজের দরপত্রে যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে সেটির অস্তিত্ব নেই। স্পোর্টস কর্নার এবং স্পোর্টস লিংক পাশাপাশি ঠিকানায় অবস্থিত।
আবার স্পোর্টস লিংকের মালিক রবিনই স্পোর্টস কর্নারের সাবেক মালিক। এ ছাড়া দরপত্র প্রস্তাব ও সরবরাহ নিশ্চিতের সময়েও ধারাবাহিকতা নেই। যা থেকে ফিফার কমিটি সিদ্ধান্তে আসে যে তিনটি দরপত্রের উৎসই এক, তিনটি আলাদা কোম্পানির নয়।
ফুটবল কেনা
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১৩ হাজার ৯২১ ডলার (প্রায় ১৬ লাখ টাকা) দামে ৪০০টি ফুটবল কেনে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। এখানেও দরপ্রস্তাব দিয়েছিল তিনটি প্রতিষ্ঠান। মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এইচ ইউ জামান ট্রেডিং ও ওফেলিয়াস ক্লোজেট, দরপ্রস্তাবে জেতে ওফেলিয়াস।
সোহাগের চালান করা কাগজে লেখা আছে, 'ফিফা অনুমোদিত বাফুফের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ২০১৯–২০ মৌসুমের ম্যাচ পরিচালনার জন্য এই কেনাকাটা জরুরি।' ব্যাখ্যায় বলা হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ক্রীড়াসামগ্রী সরবরাহ করে থাকে।
কন্ট্রোল রিস্কের প্রতিবেদনে উঠে আসে, ওফেলিয়াস ক্লোজেটের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে তাদের অস্তিত্ব নেই। এবং তারা নারীদের পোশাক বানায়। বাফুফেকে ফুটবল সরবরাহের প্রতিষ্ঠান নয় এটি।
মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের দরপ্রস্তাবে তাদের খুঁজে পাওয়ার মতো তথ্য নেই। কোনো সিল নেই দরপ্রস্তাবে।
নিরীক্ষায় উঠে আসে, ওফেলিয়াসের ফুটবল সরবরাহের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাদের কোনো আমদানি সনদও নেই। বন্ধুর সনদ ব্যবহার করে কাজ করেন বলে জানিয়েছেন সরবরাহকারী। প্রতিষ্ঠানটিকে কোনো চালান ছাড়াই অর্থ পরিশোধ করে বাফুফে।
প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়, এটি স্পষ্ট যে সব কটি দরপ্রস্তাবই বানানো। মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের স্বাক্ষরসহ যে দরপত্র দেওয়া হয়েছে, সেটিও মূল কাগজ নয়, ফটোকপি।
বিমানের টিকিট কেনা
২০১৯ সালের নভেম্বরে জাতীয় দলের ওমান সফরের জন্য টিকিটের দাম হিসেবে আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনালকে ১৯ হাজার ৯২৫ ডলার (প্রায় সাড়ে ২১ লাখ টাকা) দেয় বাফুফে। এ ক্ষেত্রে দরপ্রস্তাব দেয় আর মারওয়া, পূরবী ইন্টারন্যাশনাল ও মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস।
তিনটি দরপ্রস্তাবই শুরু হয়েছে একই কথা দিয়ে, যেখানে রুট শব্দটি একই বানানে লেখা 'rout'। সব কটিতে সংখ্যার ভুল একই রকম (১, ৩, ৪), একই তারিখে জমা দেওয়া এবং দেখতে একই রকম। পূরবী একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, যাদেরবিমানের টিকিট কেনায় দরপ্রস্তাব দেওয়ার কথা নয় বলে উল্লেখ করে কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপ। পূরবী ও মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, তারা দরপ্রস্তাব দেয়নি। বাফুফের সঙ্গে কোনো কাজও করেনি।
ঘাস কাটার যন্ত্র কেনা
২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ৪১২ ডলার ব্যয় করে (প্রায় দেড় লাখ টাকা) ঘাস কাটার যন্ত্র কেনে বাফুফে। দুটি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দেয়। একটি বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার, আরেকটি শোভা এন্টারপ্রাইজ। বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার কাজটি পায়। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর সোহাগ কার্যাদেশ দেওয়ার দুই দিন পর শারমিন এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দেয়।
এখানে পাওয়া অনিয়মের মধ্যে আছে বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার প্রতিষ্ঠানের নামের বানানে ভুল। শোভা এন্টারপ্রাইজ আর শারমিন এন্টারপ্রাইজের দরপ্রস্তাব দেখতে এক রকম। শারমিন এন্টারপ্রাইজে যোগাযোগ করলে তারা নিজেদের শোভা এন্টারপ্রাইজ হিসেবে পরিচয় দেয়। বাংলাদেশ হার্ডওয়্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এ বিষয়ে উপসংহার হচ্ছে, সব দরপত্রই একই জায়গা থেকে করা হয়েছে।
কেন সোহাগই নিষিদ্ধ হলেন
যেসব অনিয়মের ঘটনা তদন্তে উঠে এসেছে, সব জায়গাতে দায়িত্বরত ব্যক্তি হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন আবু নাঈম সোহাগ। ফিফার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাফুফে সচিবালয়ের পরিচালক হিসেবে ফেডারেশনের প্রশাসনিক কার্যক্রমের দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদকের ওপর বর্তায়।
বাফুফে গঠনতন্ত্রের ৫৯ ধারায়ও লেখা আছেে, ফেডারেশনের হিসাব ব্যবস্থাপনা ও ফিফার যোগাযোগের দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদকের। ফিফার বিচারিক চেম্বারের মতে, প্রতিটি লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সোহাগ। দরপ্রস্তাব অনুমোদন এবং কার্যাদেশও দিয়েছেন তিনি।
ফিফা নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং ফিফার তহবিল ব্যয়ের ব্যবস্থাপনায় নকল কাগজপত্র ব্যবহার তিনি এড়াতে পারতেন। এ জায়গায় সোহাগের গাফিলতি ও অনিয়মের দায় পাওয়া গেছে।