মার্তা সিলভা: ব্রাজিল ফুটবলের মুকুটবিহীন রানি
ব্রাজিলের নারী ফুটবলের ইতিহাসে মার্তা সিলভা যেন এক উজ্জ্বল তারকার নাম। ভক্তদের কাছে এই ফুটবলার 'কুইন মার্তা' নামেই বেশি পরিচিত। এবার যৌথভাবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে শুরু হওয়া ফিফা নারী ফুটবল বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে অংশ নিচ্ছেন তিনি।
মার্তা সিলভা নিশ্চিত করেছেন যে, এটিই হতে যাচ্ছে তার শেষ বিশকাপ। সম্প্রতি এ সুপারস্টার ইউটিউবভিত্তিক চ্যানেল ক্যাজটিভি-এর সাথে কথা বলেছেন।
যদিও ব্রাজিলের হয়ে শেষমেশ মার্তা বিশ্বকাপ জিততে পারবেন কি-না সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কেননা একদিকে এ খেলোয়াড় ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে এসে ইনজুরিতে ভুগছেন। অন্যদিকে তারুণ্যনির্ভর খেলোয়াড়দের নিয়ে স্কোয়াড সাজানোরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
আজ পানামার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ব্রাজিল নারী বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু করবে। নিজের প্রস্তুতি সম্পর্কে মার্তা সিলভা বলেন, "এটা অনেকটা স্বাভাবিক যে, আমি সেই আগের ২০ বছর বয়সী খেলোয়াড় নেই। কিন্তু শারীরিকভাবে আমি সুস্থ বোধ করছি। মানসিকভাবে আমি আরও ভালো অনুভব করছি।"
ছোটবেলা থেকেই মার্তা বেশ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন। কখনো দরিদ্রতা আবার কখনো যৌন সহিংসতার কবলে পড়েছেন তিনি। আর সম্প্রতি সবচেয়ে বাজে হিসেবে ধরা দিয়েছে ইনজুরি।
নিঃসন্দেহে নারী ফুটবলের ইতিহাসে মার্তাকে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্রাজিল নারী ফুটবল দলকে ২০০৭ বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়াও ২০০৪ ও ২০০৮ অলিম্পিকে ব্রাজিলের হয়ে রৌপ্য জিতেছেন তিনি।
বিশ্বকাপের মোট পাঁচটি আসরে অংশগ্রহণ করে মার্তা গোল দিয়েছেন মোট ১৭ টি। নারী ও পুরুষ উভয় ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাস এটি সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড।
মার্তার থেকে এক গোল কম দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন জার্মানির তারকা ফুটবলার মিরোস্লাভ ক্লোসা। চলতি বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে যেন এই রেকর্ডটি আরও একধাপ এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন এই নারী ফুটবলার।
তবে এতদিনের মাঠের দুই অভিজ্ঞ সঙ্গীকে এবার আর চলতি আসরে পাচ্ছেন না মার্তা। মোট সাতটি বিশ্বকাপ খেলার পর ২০২১ সালে অবসর নিয়েছেন ব্রাজিলের তারকা ফুটবলার ফোরমিগা। ৩৮ বছর বয়সী আর ক্রিস্টিয়ানে বয়সের ভারে এবার দল থেকে ছিটকে পড়েছেন।
মার্তা নিজেও গুরুতর হাঁটুর চোটে গত এক বছর মাঠের বাইরে ছিলেন। তিনবারের কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন (২০০৩, ২০১০, ২০১৮) এ তারকা গত বছর আসরটিতেও খেলতে পারেননি। তবে তিনি না খেললেও সতীর্থরা গত বছরও কোপাতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছিলেন মার্তা। জাপানের বিরুদ্ধে শি-বিলিভস কাপের ঐ ম্যাচে ১-০ গোলে জয়লাভ করে ব্রাজিল।
ইনজুরি কাটিয়ে ঐ সময় দলে ফেরার প্রসঙ্গে মার্তা বলেন, "ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো আমি এত লম্বা সময় খেলার বাইরে থেকেছি। আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি।"
মার্তা হয়তো পেলের মতো এখনো দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারবেন না। কিন্তু তিনি ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়। তিনি মোট ছয়বার ফিফার বর্ষসেরা নারী ফুটবল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
তবে মার্তার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা বোধহয় দরিদ্রতাকে পেছনে ফেলে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে উপস্থাপণ করা। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বের অনুর্বর রাজ্য হিসেবে খ্যাত আলাগোয়াসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
বর্তমানে মার্তা জাতিসংঘের 'জেন্ডার সমতা' নিয়ে দূত হিসেবে কাজ করছেন। একইসাথে ব্রাজিলের হয়ে ফুটবল খেলতে চাওয়া নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর।
মার্তা নিজের স্বপ্ন পূরণে সারাজীবনই লড়াই করেছেন। নিজের বয়স এক বছর হওয়ার আগেই তার পিতা-মাতা আলাদা হয়ে যায়। তার মাকেই নিজের এবং চার সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল।
স্কুলে পড়াশোনা করানোর মতো সামর্থ্য মার্তার পরিবারের ছিল না। তাই নয় বছর বয়সে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি ঘটে।
শৈশবে মার্তা স্কুলের লিগে ফুটবল খেলতেন। একদিন একজন লোকাল স্কাউট মার্তাকে প্রথমবারের মতো রিও ডি জেনেরিওতে নিয়ে যান। ১৪ বছর বয়সে তিনি ন্যাসেন্ট উইমেন্স ক্লাবের সাথে ট্রায়াল দেন।
প্রথম ট্রায়ালেই মার্তা সকলের নজরে আসেন। ভাস্ক দা গামা ইয়ুথ টিমের তার সাথে চুক্তি হয়। তৎকালীন ব্রাজিল ফুটবলের আরেক তারকা সিসি ঐ ক্লাবেরই সিনিয়র দলে ছিলেন।
সিসি আজও মার্তাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলেন সেটিকে স্মরণে রেখেছেন। ঐ ঘটনা সম্পর্কে বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, "মার্তার টেকনিক্যাল দক্ষতা ও তীব্র গতি ছিল অতুলনীয়। প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো বিষয়ে অনন্য যোগ্যতা থাকে। মার্তার ক্ষেত্রেও এই অনন্য দক্ষতাগুলো ছিল।"
২০০৩ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে মার্তা জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে সুইডিশ ক্লাব উমেয়াতে যোগ দেন তিনি। একইসাথে আধুনিক চ্যাম্পিয়ন্স লিগের পূর্ববর্তী ভার্সন ইউয়েফা উইমেন্স কাপেও নাম লেখান তিনি।
২০০৬ সালে মার্তা প্রথমবারের মতো ফিফার বর্ষসেরা নারী খেলোয়াড়ে ভূষিত হন। এরপর ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা আরও চারবার একই পদক লাভ করেন তিনি।
বর্তমানে মার্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ওরল্যান্ডো প্রাইডের হয়ে খেলছেন। ব্রাজিলের হয়ে তিনি রেকর্ড ১২২ টি গোল করেছেন। যা পেলে ও নেইমারের মতো বিশ্ব তারকার চেয়েও বেশি। ব্রাজিলের জার্সি গায়ে এই দুই তারকার গোলের সংখ্যা ৭৭ টি।
নিজের ক্যারিয়ারে মোটামুটিভাবে প্রায় সবকিছুই অর্জন করেছেন মার্তা। এবার চলমান বিশ্বকাপে যদি অধরা ট্রফিটি পেয়েই যান তবে হয়তো ব্রাজিলের নারী ফুটবলের ইতিহাসে তার মুকুটহীন রানির খেতাবও ঘুচবে।