অবশেষে বিশ্বের ‘সবচেয়ে প্রাচীন’ কম্পিউটারের প্রতিলিপি তৈরি করলেন বিজ্ঞানীরা
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০ অব্দে প্রাচীন গ্রিসের জ্যোতির্বিদরা দিক নির্ণয়ের জন্য গ্রহ-নক্ষত্রের গণনাকাজে অ্যান্টিকাইথেরা মেকানিজম ব্যবহার করতেন। দুই হাজার বছর পুরানো এ যন্ত্রের কার্যপদ্ধতি নির্ণয়ে প্রায় এক শতাব্দী ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (ইউসিএল) একদল গবেষক দাবি করছেন তারা 'পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন কম্পিউটারের' রহস্য উন্মোচন করেছেন, এক্স-রে প্রযুক্তি ও প্রাচীন গ্রীক গণিত বিশ্লেষণী পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন তারা একাজে, ওয়ার্কিং গিয়ার সিস্টেম ব্যবহার করে যন্ত্রটির ডিজিটাল প্রতিলিপি তৈরি করেছেন তারা।
গবেষণা দলের প্রধান গবেষক অধ্যাপক টনি ফ্রিথ বলেন, "আমাদের তৈরি এই মডেলই যন্ত্রটির কার্যবিধি অনুসারে বানানো প্রথম মডেল। যন্ত্রটিতে ব্যবহৃত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিল রেখেই এটি বানানো হয়েছে,"
"প্রাচীন গ্রীক প্রতিভার এক অনন্য দৃষ্টান্ত যন্ত্রটিতে সূর্য, চাঁদ ও গ্রহগুলোর অবস্থান,"
১৯০১ সালে গ্রীসের একটি দ্বীপের কাছে জাহাজডুবির ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে গিয়ে যন্ত্রটি খুঁজে পায় ডুবুরিরা। তারপর থেকেই বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় ও বিশ্ববাসীর কাছে রহস্য হয়েই ছিল যন্ত্রটি, এতো বছর আগের মানুষ কীভাবে এধরনের একটি যন্ত্র তৈরি করল তা নিয়ে শতাব্দী ধরে চলেছে নানা গবেষণাও।
গণনা যন্ত্রটির সম্মুখভাগ ও গিয়ারে রয়েছে সূর্য ও সৌরজগতের গ্রহগুলো, লুনার ক্যালেন্ডারের সময়সূচি ও রাশিচক্রের গ্রহমণ্ডলের অবস্থান। অলিম্পিক গেমসের মতো পৃথিবীর বড় বড় ঘটনাবলীও যুক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা।
সেসময় পাঁচটি গ্রহের ব্যাপারেই জানতে পেরেছিল পৃথিবীবাসী, গ্রীকরা যন্ত্রটিতে পৃথিবীকে মধ্যিখানে স্থাপন করেছিলেন, যন্ত্রটি বানানোর সময় এব্যাপারটিও মাথায় রেখেছিলেন গবেষকদল।
গবেষকরা জানিয়েছেন যন্ত্রটিতে হয়তো সূর্য ও চাঁদের এবং বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিগ্রহের বৃত্তাকার গতিপথ নির্দেশ করত।
লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়ামের সাবেক কিউরেটর মাইকেল রাইট একাজে যতোদুর এগিয়েছিলেন, সেখান থেকেই কাজ শুরু করেছিলেন তারা। রাইট প্রথমে গ্রহের গতিপথ ও সময়কাল গণনার সিস্টেম বানিয়েছিলেন, তবে পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
খুঁজে পাওয়া যন্ত্রটির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট ছিল। ৮২টি টুকরো নিয়েই যন্ত্রটির রহস্যোদ্ধারের চেষ্টা করা হয়। ফ্রেগমেন্ট এ নামে পরিচিত সবচেয়ে বড় টুকরোটিতে ছিল পিলার ও ব্লক, ফ্রেগমেন্ট ডি-তে ছিল ডিস্ক, গিয়ার ও প্লেট।
এর আগে এক্স-রে পদ্ধতি ২০০৫ সালে টুকরোগুলোর পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করা হয়। পেছনদিকে যন্ত্রটিতে ব্যবহৃত মহাকাশের অবস্থান, গ্রহগুলর বৃত্তাকারে আবর্তনের ব্যাপারে বর্ণনা দেওয়া ছিল। ইউসিএলের গবেষকদল এটিই ব্যবহার করে রেপ্লিকা তৈরি করেছেন।
এক্স-রে'র মাধ্যমে এর সম্মুখভাগে দুটি সংখ্যা খুঁজে পাওয়া গেছে, ৪৬২ ও ৪৪২ বছর। এ দুটি সংখ্যা হল শুক্র ও শনি গ্রহের 'সিনোডিক পিরিয়ড'। পৃথিবী থেকে দেখলে, আকাশের একইস্থানে একটি গ্রহের পুনরায় ফিরে আসতে যতো সময় লাগে তা-ই সিনোডিক পিরিয়ড।
গবেষণা দলের একজন সদস্য অ্যারিস ডাকানালিস বলেন, "এটি সেসময়ের মানুষের জ্যোতির্বিজ্ঞানের দক্ষতার প্রমাণ, তবে তারা কীভাবে নিখুঁত সংখ্যা বের করতে পেরেছিলেন এব্যাপারে কিছু বলা নেই।"
গ্রীক দার্শনিক পার্মেনিদিসের বর্ণিত গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে কীভাবে এই সময়কাল বের করা যায় তা জানিয়েছেন গবেষকরা, অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রেও এই সময়কাল বের করেছেন তারা।
গবেষক দলের আরেকজন সদস্য ডেভিড হিগন বলেন, "বেশ কিছুদিনের প্রচেষ্টার পর আমরা ফ্রেগমেন্ট এ ও ডি তে পাওয়া প্রমাণ মিলিয়ে শুক্রের সময়কাল বের করতে পেরেছি, গিয়ারের কাজ এখানে সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ ছিল।"
অধ্যাপক ফ্রিথ জানান, তারপরই গবেষকরা গণনার জন্য আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, ফলে গিয়ারের সংখ্যাও কমে আসে।
সব কাজ শেষে কীভাবে যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল সেব্যাপারে ধারণা পেয়ছেন গবেষক দল। প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করে যন্ত্রটি পরিচালনাক্ষম করে তোলাই পরবর্তী পদক্ষেপ বলে জানান গবেষণাটির সহ-লেখক ড.অ্যাডাম উজিক।
- সূত্র: নেচার ম্যাগাজিন