ঈদ: উদযাপনে নেই উৎসবের আমেজ
মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। করোনাভাইরাসের কারণে এবারের ঈদ উদযাপনে উৎসবের কোনো আমেজ নেই।
পুরো এক মাস রমজানের রোজা পালন করার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা অপেক্ষা করে এই দিনের জন্য। উদযাপনের জন্য সকল প্রস্তুতির মধ্যে থাকে অন্য রকম আমেজ আর আনন্দ। করোনাভাইরাসের কারণে এবারের প্রস্তুতিও নেই বললেই চলে। ঈদ উদযাপনের স্বাভাবিক কার্যক্রম থেকেও বিরত পুরো দেশ।
ঈদগাহ মাঠে বা ফাঁকা মাঠে ঈদের নামাজ আদায়ের সুযোগ নেই। মসজিদে এই নামাজ অনুষ্ঠিত হবে, নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্ব মেনে। তবে নামাজ আদায়ের পর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ 'কোলাকুলি' করতেও মানা করেছে ইসলামী ফাউন্ডেশন।
আর ঈদ উপলক্ষে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান, এমনকি ঘরোয়া পার্টি থেকেও বিরত থাকছেন সবাই।
সময়মতো বেতন-বোনাস, এক সপ্তাহের অধিক সময় ছুটি সব মিলিয়ে প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঈদ আনন্দটা একটু বেশিই হয়। ছুটি পেলেই তারা ছুটতেন গ্রামের বাড়িতে প্রিয়জনের কাছে। কিন্তু এবারের চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তারা এবার যেতে পারেননি গ্রামে। কর্মস্থলেই ঈদ করতে আদেশ জারি করেছে সরকার। ফলে ঈদের ছুটিতে কর্মস্থলেই ঈদ করতে হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখ সরকারি চাকরিজীবীকে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন নিয়োগ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শফিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রতিবছরই সন্দ্বীপে গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করি। কিন্তু এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সরকার কর্মস্থলেই ঈদ করার আদেশ জারি করেছে। ফলে যেরকম হওয়ার কথা সেরকমই ঈদ হবে।'
করোনার সংক্রামন থেকে বাঁচতে এবং সড়কে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায়, ছুটি পাওয়ার পরেও ঢাকার বেশিরভাগ বেসরকারি চাকরিজীবীও অবস্থান করছেন রাজধানীতেই। তাদের বেশীরভাগই ঈদ বোনাস পাননি। আবার অনেকে গত এপ্রিল মাসেরও বেতন পাননি।
একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এহসানুল হক চৌধুরী বলেন, যেহেতু গ্রামে বাবা-মা'র কাছে যাওয়া যায়নি, তাই ঈদটা আর তেমন জমছে না।
তিনি বলেন, 'এবার ঈদ বাসায় বউ-বাচ্চার সঙ্গেই কাটাচ্ছি। দিনভর আড্ডা আর গল্প করেই সময কাটানোর পরিকল্পনা করেছি।'
পুলিশের অনুমতি থাকায় যাদের প্রাইভেট গাড়ি আছে, অনেকেই গাড়িতে করে গ্রামে গেছেন ঈদ করতে। আবার অনেক গার্মেন্ট শ্রমিক ও স্বল্প আয়ের মানুষও নানা কৌশলে ফিরেছেন গ্রামে।
প্রবীন অভিনেতা ড. ইনামুল হক- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমরা এখন একটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আছি। করোনাভাইরাসে সারা বিশ্বের মানুষ আজ দিশেহারা। নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সবাই আজ ঘরবন্দি। এমন সময়ে ঈদের আনন্দ কেমন হবে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।
তিনি বলেন, প্রতিদিন আমাদের দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। একটা অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে আমরা আছি বলতে হয়। আমি মন থেকে চাই, যে যেখানে আছি সেখান থেকেই এই ঈদ কাটাব। বেঁচে থাকলে আগামী ঈদ আমাদের জন্য অনেক সুন্দর হবে।
এবারে ঈদ পুরোটাই ঘরে কাটাবেন বলে জানান তিনি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জাতীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা ঈদ উপলক্ষে তাদের নিজস্ব এলাকায় অবস্থান করেন। ঈদকে কেন্দ্র করে তারা এলাকায় ভালো অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেন। জনগণের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন।
তিনি বলেন, হাতে গোনা দুই-একজন এমপি বা মন্ত্রী ছাড়া এবার সকলেই ঈদের সময় রাজধানীতে অবস্থান করছেন।
পলক বলেন, 'আমি ঈদের দিন সম্ভব হলে, সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখে ঈদের নামাজ আদায় করব। ওইদিন বাসায় বা কোথাও কোনো অনুষ্ঠান-দাওয়াতে অংশ নেব না। তবে ভার্চুয়ালি যাদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় সম্ভব, তাদের সঙ্গে অনলাইনে সেটি করব। এক্ষেত্রে আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষের সঙ্গে বেশি ভার্চুয়ালি কথা বলার চেষ্টা করব।'
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাংলাদেশে ঈদের অন্যতম আকর্ষণ হলো 'ঈদ সালামি'। ঈদের আগের দিন বা ঈদের সকালে এটি আদান-প্রদান হয়। আমাদের দেশের প্রচলন অনুযায়ী পরিবারের বড়রা ঈদের নামাজ আদায়ের আগে সাধারণত এই সালামি দেন ছোটদের। আবার অফিসের সিনিয়র কর্মকর্তারাও দেন এই সালামি।
তিনি বলেন, করোনার কারণে এবারে ঈদে সেই সালামি বাকির খাতায় লিখে রাখতে হচ্ছে প্রাপকদের। কারণ এবার সবার সঙ্গে সবার দেখা হচ্ছে না।
করোনার কারণে দীর্ঘ ছুটি থাকার পরেও, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রকিবুল ইসলাম যেতে পারেননি রংপুরে তার গ্রামের বাড়িতে।
তিনি বলেন, 'এবারের ঈদ একবা্রেই ফ্যাকাশে। দুই মাস ঘরে অবস্থান করে একবা্রেই ক্লান্ত। ঈদের দিনটিও একইভাবে কাটাতে হবে। কারণ ওইদিন করোনাকালীন অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন দিন হচ্ছে না।'
নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ নেই, তার ওপরে আবার খাবার যোগানোর চিন্তা। রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় ভাঙ্গারি দোকানি আজগর আলী বলেন, 'দুই মাস হলো ব্যবসা নেই। আগে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ টাকা আয় হতো। এখন চার সদস্যের পরিবার নিয়ে বেকায়দায় আছি। কিছু টাকা জমানো ছিল, তা শেষ। কিছু ধার কারা টাকাও শেষ।'
তিনি বলেন, 'করোনার কারণে ঈদ তো নেই-ই, এখন ঘরে খাবারও নেই। তাহলে বুঝতে পারছেন আমাদের ঈদ কেমন এবার!'
ঈদ মানে টেলিভিশনে নতুন নতুন গল্প আর টিভি তারকাদের রাজত্ব। বর্তমানে বাংলাদেশে অনুমোদিত ৪৫টি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মধ্যে ৩০টি পূর্ণ সম্প্রচারে আছে। নিউজ চ্যানেল বাদ দিলে ২২টি চ্যানেল কাজ করে বিনোদন নিয়ে।
সারা বছর নানা আয়োজন থাকলেও শুধু ঈদকে ঘিরে থাকে টানা সাত দিনের আয়োজন। ঈদের লম্বা ছুটিকে বিনোদনে রাঙিয়ে তুলতে প্রায় প্রতিটি চ্যানেল উঠে-পড়ে লাগে। রিয়েলিটি শো, রান্না, নাচ-গান ও নানা আয়োজনে মুখর থাকে টিভি চ্যানেলগুলো।
কিন্তু এবারের ঈদে এসবের কিছুই নেই।
অভিনেতা ড. ইনামুল হক বলেন, অন্য ঈদে আমাদের বিভিন্ন শ্রেণীর দর্শক টেলিভিশনে ঈদের হরেক রকম আয়োজন উপভোগ করে। এবার কোনো আয়োজন না থাকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার, বা ইউটিউবে সিনেমা বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান দেখে সময় কাটাবে।
এবারের ঈদটা একেবা্রেই বাজেভাবে কাটাতে হচ্ছে উল্লেখ করে এই প্রবীণ অভিনেতা বলেন, 'আশা করি আগামি কুরবানি ঈদের আগে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আগামি ঈদে করোনামুক্ত একটা পৃথিবীতে আমরা আবার মেতে উঠব নতুন করে।'