একটি নতুন জাতির জন্ম: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংবাদ
বাংলাদেশ ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছে। একাত্তরের ডিসেম্বরে বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জন ছিল দ্বারপ্রান্তে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী সামনে রেখে পেছন ফিরে একাত্তরের দিকে তাকালে দেখা যায়- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিল, যে, শেষপর্যন্ত বিজয়টা যেন কেবল বাংলাদেশের নয়, গণমাধ্যমেরও বিজয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র বিভিন্নভাবে উচ্ছ্বাস প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। মূল সুরটির সুত্র একই-স্বাগত বাংলাদেশ, স্বাধীনতা অর্থবহ হোক, বৈরিতার অবসান ঘটুক, আ লিক শান্তি ও সংহতি ফিরে আসুক। বিদেশি সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কি বর্ণনা দিয়েছে কিভাবে দেখেছে এবং স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটকে কিভাবে দেখেছে তার বয়েকটি নিদর্শন তুলে ধরা হচ্ছে:
আমাদের কাছে অপরিচিত পত্রিকা মালয়েশিয়ার উতুসান ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ শিরোনাম করেছে একটি নতুন জাতির জন্ম:
একটি নতুন জাতির জন্ম
গত রাতে ঢাকা শহর রাস্তায় ভেঙে পড়েছে। আনন্দে নৃত্য করেছে, ফুল ছিটিয়েছে, ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। চিৎকার করে বলেছে, 'বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক'।
বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি ইউনিটগুলোতে পাকবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের খবর পৌঁছলে গোলন্দাজ গোলা ও ছোট অস্ত্রের গুলির শব্দ একাকার যায়।
নতুন বাংলাদেশের জনপ্রশাসন আজ ঢাকায় পৌঁছার কথা⎯প্রাথমিক মেরামত ও পুনর্গঠন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে যেতে পারে।
ভারতীয় পূর্বা লের কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা সেনাবাহিনী, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানদের নিয়ে ঢাকা শহরের মধ্যে রেসকোর্সে হাজির হন। এখানেই ভারতীয় ডেডলাইনের ১০ মিনিট আগে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ স্বাক্ষরিত হয়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পরও ওয়াশিংটন থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, পৃথিবীর বৃহত্তম উড়োজাহাজবাহী নৌযান এন্টারপ্রাইজে যুক্তরাষ্ট্রের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে।
প্রতিবেশী নেপালেল নবীন খবর লিখেছে:
বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা
সাম্প্রতিক যুদ্ধে পাকিস্তানকে তার অর্ধেকের বেশি অংশ হারাতে হয়েছে। এর কারণগুলো বিবেচনা করা দরকার। কিন্তু তা না করে নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ভুট্টো সাহেব তার দেশের নামে বিবৃতি জারি করছেন, যে দেশ আমাদের কেবল হতাশাই বৃদ্ধি করেছে। সবাই জানেন পাকিস্তান ভেঙে যাওযার দায় ইয়াহিয়া খানের চেয়ে ভুট্টোর কম নয়। সাধারণ নির্বাচনের পর ভুট্টো যদি ইয়াহিয়া খানকে কুপরামর্শগুলো না দিতেন, পূর্ব পাকিস্তান তাহলে আজ আর আলাদা দেশে রূপান্তরিত হত না। যেভাবেই হোক পূর্ব পাকিস্তানের সব নাগিরকের প্রত্যাশার মুখে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।
পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর এ সত্যকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ভুট্টো সাহেবের উচিত সত্য অনুধাবন করা। আমরা তাকে সেই পরামর্শই দেই। গতকাল তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন তা স্ববিরোধী ও হতাশাব্যঞ্জক। তিনি দাবি করেন, তিনি পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা। কিন্তু তাকে স্বীকার করতেই হবে নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান তার চেয়ে আরো বড় নেতা। তিনি যদি নির্বাচনের রায়কে গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে মেনে নিতেন তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য কোনো মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজন হত না। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লাগত না এবং এমনভাবে পাকিস্তানকে পরাজিতও হতে হত না। যাক, গত ক' মাসে যেসব ঘটনা ঘটেছে ভুট্টো সাহেব তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন এবং এখনো টিকে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানের ঐক্য অটুট রেখে রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন বলে আশা করা যায়। অন্য কথায় তাকে অবশ্যই বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হবে। অপরপক্ষে তিনি যদি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেন তাহলে ইয়াহিয়া যেভাবে পূর্ব পাকিস্তান হারিয়েছেন তাকেও তেমনি পশ্চিম পাকিস্তান হারানোর জন্য পৃথকভাবে সম্পূর্ণ দায়ী থাকতে হবে-পাকিস্তানের অপরাধের দায় তাকেই গ্রহণ করতে হবে।
২৯ মার্চ নিউজউইক-এর প্রতিবেদন ছেপেছিল:
আগ্নেয়গিরির উপর পাকিস্তান
গত সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান তার দ্বিখ-িত দেশের পূর্বা লে যাওয়ার সময় উড়োজাহাজে চড়ার আগে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার রিবনখচিত সেনাপোশাক ছেড়ে ধূসর রঙের স্যুট পরে নিলেন। তার পরও তিনি যখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পৌছালেন, যুদ্ধক্ষেত্রের জ্ঞানী সৈন্যের মতো সতর্কতার সঙ্গে শত্রুপক্ষের মাইনফিল্ড নিয়ে আলোচনায় নামলেন। তাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বাগত জানাতে যে দলটি উপস্থিত হল, তাতে থাকল ক'জন সেনা কর্মকর্তা আর তার জোরদার নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত বিষণœমুখ সেনাদল। এখানেই শেষ নয়, তার পরও প্রতি ১০০ ফুট দূরে এয়ারপোর্ট থেকে প্রেসিডেন্টের সবুজ দেয়ালঘেরা প্রাসাদ পর্যন্ত মেশিনগান হাতে সতর্ক সৈন্য, তাদের পায়ের কাছেই কাতুর্জের বাক্স⎯যদি আরও লাগে।
প্রেসিডেন্টের গাড়িবহর যে লৌহকপাট তার বাড়ি পাহারা দেয়, সেই কপাট অতিক্রম করার পর যখন মিলিয়ে গেল, ঢাকার নাগরিকদের একজন প্রেসিডেন্টকে দেখার জন্য যে চোখ ঘুরিয়েছিল, মাটিতে একদলা থুতু নিক্ষেপ করে ঘৃণাভরা স্বরে আওড়াল, 'তিনি আমাদের প্রেসিডেন্ট নন। যে লোক মানুষকে এত ভয় পায়, তিনি কেমন করে ভান করেন যে তিনি আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন?'
তার পরও ইয়াহিয়া যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের পূর্ব পাকিস্তানে এলেন, এটাকে একটা সাহসী কাজই বিবেচনা করতে হবে। কারণ তিনি ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুখোমুখি হলেন, যিনি ইয়াহিয়া সরকারের কর্তৃত্বই অস্বীকার করেছেন; কার্যত এ মাসের শুরু থেকে তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসক। দুজনের ব্যক্তিগত স্টাইলেও বৈষম্য। ইয়াহিয়া কর্কশ, কঠিন পেশাদার সৈনিক, জনসমক্ষে কথাবার্তা শুনলে মনে হয় অনুশাসনের বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর মুজিব (যে নামে তাঁকে ডাকা হয়) নিখুঁত রাজনীতিবিদ, বর্ণাঢ্য বক্তা। তবু দুজনের বৈঠকে একমত হওয়ার ওপর ঝুলে আছে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ।
পরস্পরবিরোধী দুজন দৈনিক রুটিন-কাজে মনোনিবেশ করলেন। কালো পতাকা ওড়ানো সাদা টয়োটা সেডানে তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢুকছেন⎯কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনীর হাতে রাস্তায় নিহত বাঙালিদের স্মরণে শোক প্রকাশের জন্য। সেখানে উপস্থিতির পর তিনি এবং ইয়াহিয়া স্থির হয়ে বসলেন, কোনো সহায়তাকারী ছাড়াই, একান্ত আলাপে। একদিন উত্তেজক আলোচনার সময় ইয়াহিয়া বলেন, 'আমি সৈনিক, আমাকে বকাঝকা করবেন না।'
মুজিব ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে এলেন। বলে এলেন, 'আপনার সঙ্গে আর আলাপ করে লাভ নেই। আপনি আলোচনার আসল জায়গায় আসছেন না।' ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা, বাতাসে আর্দ্রতা, মেজাজ চড়ে যাওয়ারই কথা⎯একান্তে কী আলাপ হয়েছে তা দুজনের কেউ বলবেন না⎯আসল কথা, দুজন যে একসঙ্গে কথা বলেছেন, এটাই যথেষ্ট⎯এটাই অন্তত সাময়িকভাবে হলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে এখনই দ্বিখ-িত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে।
গত সপ্তাহের আলোচনার ওপর নিউজউইক-এর লোরেন জেঙ্কিন্স ঢাকা থেকে রিপোর্ট করেছেন⎯মুজিব চাচ্ছেন এখনই পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন তুলে নিয়ে গত ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত দলের কাছে পাকিস্তানের একটি নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। কারণ মুজিবের আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল-এ ধরনের সংবিধান পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়নে আলগা বন্ধনে থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অনিবার্যভাবে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনেরই প্রতিফলন ঘটাবে। আর ইয়াহিয়া যেহেতু বিষয়টি সম্পর্কে গভীরভাবে অবহিত, তিনি সামরিক আইন উঠিয়ে নেওয়া কিংবা যেকোনো সংবিধানে প্রেসিডেন্টের না-সূচক ভেটো প্রয়োগক্ষমতা প্রত্যাহার মেনে নেবেনই না।
ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার ভেতরের খবর প্রকাশিত না হওয়ায় ভয়ার্ত-গুজব ঢাকাকে ছেয়ে ফেলে। সফরকারীরা জানান, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে সৈন্য টানা হচ্ছে এখানকার সেনাশক্তি আরও জোরদার করার জন্য। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বেসামরিক পোশাকে আড়াল করেও আনা হচ্ছে না। বোমা ও গোলাগুলির ঘটনা হামেশাই ঘটে চলেছে। মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের বাড়িতে অজানা ঘাতক শটগানের তিনটি গুলি ছুঁড়েছে⎯সব মিলিয়ে শহরে উত্তেজনা তুঙ্গে।
তারপর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রথম একটা ইশারা পাওয়া গেল যে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার অচলাবস্থা কেটে গেছে। যেখানে মুজিব সতর্কভাবে দ্ব্যর্থক রয়ে গেলেন, বিজয় দাবি করা থেকে বিরত রইলেন, তিনি সানন্দে ঘোষণা দিলেন, প্রেসিডেন্টের উঁচুদরের উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বিস্তারিত দরকষাকষি ও সমঝোতার জন্য বৈঠকে বসবেন। উৎফুল্ল জনতাকে তিনি বললেন, 'আমার জনগণ ঐক্যবদ্ধ, কেউ তাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।' জনতা চিৎকার করে বলল, 'বাংলাদেশ স্বাধীন কর।' কিন্তু সমস্ত উৎফুল্লতা হয়তো অকালপক্ব হয়ে উঠতে পারে। বিষণœ বদনে মুজিবের একজন সহযোগী বললেন, 'আমরা একটি আগ্নেয়গিরির উপর বসে আছি, যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।'
বাঙালিরা পালটা আঘাত করছে
১৯ জুলাই, ১৯৭১
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, 'আমি সন্তুষ্টচিত্তে আপনাদের বলতে চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সব দু®কৃতকারী, অন্তর্ঘাতক এবং অনুপ্রবেশকারীকে সেনাবাহিনী গুঁড়িয়ে দিয়েছে।'
হায়! ইয়াহিয়া। বাস্তবতার গল্প তো ভিন্ন। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে যুধ্যমান বাঙালিদের প্রতিরোধ আন্দোলন মনে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি অঙ্গীকারাবদ্ধ, যা প্রমাণ করে এই আন্দোলন জীবিত এবং ভালোই ছিল এবং বহুল অস্ত্রসজ্জিত কিন্তু দূরে দূরে অবস্থানরত পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
পাকিস্তানের বিধ্বস্ত পূর্বা লীর প্রদেশে বিদ্রোহী ইউনিটগুলো নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে গত সপ্তাহে তাদের উপস্থিতির নিশ্চিত জানান দিয়েছে। ভারত থেকে সরবরাহ করা অস্ত্র ও গোলাবারুদের জরুরি প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে। কলকারখানায় নাশকতামূলক কাজ হয়েছে, যথাযথভাবে ডিনামাইট বসিয়ে প্রধান প্রধান সেতু উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, লুকানো মেশিনগানে গুরুত্বপূর্ণ নৌপরিবহনের ওপর আক্রমণ চালান হয়েছে। দু-চারটি রেল-রুট যা অক্ষত ছিল সে সব রেললাইনে মাইন পুঁতে তা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
যদিও সবচেয়ে বড় ধরনের হুমকি ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় কেন্দ্রীভূত ছিল, সেখান থেকে ৯০ মাইল দূরে, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী শহর ঢাকাও বিদ্রোহীদের আক্রমণের আওতায় এসে পড়েছে। শহরের রাস্তায় গোলাগুলি ও মাঝে মাঝে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এ মাসের গোড়ার দিকে একটি সাহসী হামলায় বাঙালি বিদ্রোহীরা ঢাকা পাওয়ার প্লান্টের প্রধান ট্রান্সফরমার গুঁড়িয়ে দিয়ে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় রাজধানী শহর অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখে। গত সপ্তাহে একজন পশ্চিমা কূটনীতিবিদ বলেন 'মুক্তিবাহিনীকে এখনই গুরুত্বপূর্ণ সামরিক হুমকি মনে করা ঠিক হবে না। তবে কোনো সন্দেহ নেই আমরা এখন যা দেখছি তা দীর্ঘমেয়াদি রক্তাক্ত গেরিলাযুদ্ধেরই প্রথম যাত্রা।'
বিদ্রোহীদের উত্থান রোধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচার সহিংসতা আজ বিদ্রোহীদেরও বেপরোয়া করে তুলেছে। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তারাও বাড়িয়েছে গেরিলা আক্রমণ, সেই সঙ্গে নিজেদের বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস। যেসব স্থানে রাষ্ট্রীয় কর আদায় করা হয়ে থাকে সেসব স্থানে না যাওয়ার হুমকিই জানান দিতে ছুঁড়ে দেওয়া বিদ্রোহীদের একটি গ্রেনেড আক্রমণে ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলে একজন নিহত এবং চৌদ্দজন আহত হয়েছে। একইভাবে ধানমন্ডিতে মার্কিন কনসাল জেনারেলের বাসার সামনে একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তান সরকারের জন্য জাহাজবোঝাই অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর প্রতিবাদেই তা করা হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানও এমনভাবে জবাব দিয়েছেন। গেরিলারা ঢাকার উত্তরে একটি সেতু উড়িয়ে দেওয়ার পর পাঞ্জাবি সৈন্যরা বহুসংখ্যক নিকটবর্তী গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, বহু লোক হত্যা করে এবং অনেককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
খুলনা হত্যাকা-ের পর সেনাবাহিনীর জবাব আরো ভয়াবহ। লরেল জেঙ্কিন্স লিখেছেন, 'সারওয়ারের মাথা দেহচ্ছিন্ন করার পরদিন সকালে খুলনার পাটকলের দিকে কাজে যাওয়া শ্রমিকরা রেলস্টেশনের পাশে রাস্তায় সতেরোটা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে। তাদের হাত পেছন থেকে বাঁধা এবং প্রত্যেককেই গুলি করা হয়েছে। সেনাবাহিনী পুরো চব্বিশ ঘণ্টা মৃতদেহগুলো ফেলে রেখেছে, যাতে সেখানকার মানুষ প্রতিশোধের বার্তা পায়।'
কিন্তু ৩০ হাজার গেরিলার আক্রমণ সামলাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কৌশল কতটা সফল হবে তা নিয়ে অনেক সন্দেহ রয়ে গেছে। কোনো সন্দেহ নেই টিক্কা খান যেখানে সেনাবাহিনী জড়ো করতে চাইবেন সেখানে সেনাবাহিনী কর্তৃত্বে থাকবে। কিন্তু অন্যত্র পাকিস্তানি বাহিনীর সে সম্ভাবনা নেই। পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষের মধ্য থেকে মুক্তিবাহিনী কেবল নিতেই পারবে⎯কিন্তু এই বিশাল জনসংখ্যাকে ভয় দেখিয়ে নতুন করে সহিংসতার শক্তি বাড়িয়ে বশীভূত করা অনেক দূরের ব্যাপার।
পূর্ব পাকিস্তান পুড়ছে, ইয়াহিয়া ঝিমেচ্ছেন
বি জেড খসরু বি লিখেছেন :
যদিও পাকিস্তানের গলার ফাঁস ক্রমেই দৃঢ় হয়ে আসছিল, এমনকি নভেম্বর পর্যন্ত এতোটা সময় পার হবার পরও ইয়াহিয়া পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলেন।
সাপ্তাহিক বুলেটিনে ১৯ নভেম্বর সিআইএ বলেছে, বিদ্রোহীদের অবিলম্বে স্বাধীনতার দাবির পরিপ্র্রেক্ষিতে এবং প্রকুতপক্ষে মুক্তিবাহিনীর শক্তি ক্রমেই বাড়তে থাকা সত্ত্বেও তাদের সাথে সমঝোতা আলোচনা শুরু করার মতো কোন তাগিদ ইসলামাবাদ অনুভব করছে কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
ইয়াহিয়া বরং বাংলার সমস্যায় তার নিজস্ব সমাধান নিয়ে এগোতে চাইছেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের কিছু সংখ্যক সদস্যের খালি হয়ে যাওয়া আসনে তিনি ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে চান। তিনি সাতটি দলের একটি কোয়ালিশন দাঁড় করাতে পেরেছেন যারা জাতীয় সংসদে প্র্রাধান্য বিস্তার করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন। পাকিস্তানপন্থী বাঙালি নুরুল আমিন এই গোষ্ঠির নেতৃত্বে থাকবেন।
বলতে গেলে এ ধরনের সরকারের পূর্ব পাকিস্তানে কোনো সমর্থনই থাকবে না। কিন্তু আমেরিকান সরকার এই উপসংহারে পৌছেছে যে এছাড়া জেনারেল ইয়াহিয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই।
সিআইএ বলেছে, 'তার নিজের প্র্রতিষ্ঠিত পথ থেকে বেশি রকম দূরে সরে গেলে নিজের পদ রক্ষা করতেই ইয়াহিয়া সমস্যায় পড়ে যাবেন।'
ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এটা বুঝতে সমর্থ হয়েছে এমনকি নেতারা যদি ইয়াহিয়ার সাথে কোনো চুক্তি করেও ফেলে বাঙ্গালিরা স্বাধীনতার প্রাপ্তির চেয়ে কম কোনো কিছুতেই রাজি হবে না। 'এমনকি ইয়াহিয়া যদি কারারুদ্ধ বাঙ্গালি নেতার সাথে কোনো সমঝোতা করতে সমর্থ হন, আর তা যদি অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কম কিছু হয়, তারা মুজিবুর বহমানকেই অস্বীকার করবে।'
দু'সপ্তাহ আগে ইয়াহিয়ার উপর একটি প্র্রতিবেদন উইলিয়াম উপস্থাপন করেছেন যে এই সামরিক স্ট্রংম্যান (ইয়াহিয়া) ক্রমেই ক্রমবর্ধমাহারে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা প্র্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন, বর্তমান পরিস্থিতির কাছে তা তামাশা ছাড়া কিছু নয়।
২৭ অক্টোবর উইলিয়াম পাকিস্তানের কেবিনেট সেক্রেটারি গোলাম ইসহাক খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইসহাক খান বিশ^াস করেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে সামরিক রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে তা-ই প্র্রেসিডেন্টকে বেপথু করছে বাস্তবে যা ঘটছে রিপোর্টে তার প্র্রতিফলন ঘটছে না।
জেনারেল ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এমএম আহমেদ ইয়াহিয়ার ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং সামরিক বাহিনী বেপথু প্র্রতিবেদন সম্পর্কে আগেই বলেছেন। তিনি বললেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্র্রায় সার্বভৌম ক্ষমতা পেয়ে গেছে, বিভিন্ন বিষয়ে ইয়াহিয়ার নীতি ও নির্দেশের বাইরে তারা কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনা থেকে ইয়াহিয়ার এই বিচ্ছিন্ন হওয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আহমেদ বললেন :
প্র্রথমত পূর্ব পাকিস্তানে সেনা কমান্ডাররা ইচ্ছেমত স্বাধীনভাবে সামরিক অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত বেসামরিক পুতুল গভর্নর এম এ মালিক ও তার মন্ত্রিপরিষদের চেহারা দেখিয়ে আসলে সামরিক বাহিনীই শাসন করে যাচ্ছে- তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য তারা সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল।
তৃতীয়ত পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা সমূহ পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করার কোন স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত ইয়াহিয়ার নেই।
পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে এ নিয়ে অবশ্য ইয়াহিয়ার সম্পূর্ণ উল্টো একটি ধারণা ছিল। ২৮ অক্টোবর জেনারেল ইয়াহিয়া আমেরিকানদের বলেন পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রিসভার বেসামরিকীকরণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করে এনেছে। নির্বাচন যখন আওয়ামী লীগের শূণ্য ঘোষিত আসনগুলো পূর্ণ করল পূর্ব পাকিস্তানে অনুগত প্র্রাদেশিক সরকারের রাজনৈতিক স্থান সংকুলানের কাজটি সম্পন্ন হলো।
ইয়াহিয়া বিশ^াস করতেন নির্বাচনোত্তর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কাছে বিদ্রোহীদের প্র্রতি ভারতের সমর্থন মার খেয়ে যাবে। তখন নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া ইন্দিরা গান্ধীর হাতে আর কিছু থাকবে না।
পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মিথটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে গিলিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক গভর্নর এবং সেনা কমান্ডারগণ। তারা প্র্রকৃত অবস্থার সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অযথার্থ একটি চিত্র ইয়াহিয়ার কাছে তুলে ধরেছেন।
বাস্তবতা হচ্ছে বেসামরিক সরকারের আচ্ছাদনে সামরিক নীতিমালা এবং অপারেশন বাঙ্গালীদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
কেবল ভারতই বিদ্রোহের বীজ বপন করেছে তা নয় ইয়াহিয়ার কাছে ক্রমবর্ধমান স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমোবনতির মধ্যকার যে শূণতা তা অনেক বড়। ২১-২৬ অক্টোবর আমার পূর্ব পাকিস্তান সফরের সময় পর্যবেক্ষণ এবং ইতিপূর্বের ১৯-২৫ আগস্টের পর্যবেক্ষণের তুলনা করলে আমি তা-ই পাই। যদিও ইয়াহিয়া পুতুল সরকার বসিয়েছেন আসলে প্র্রদেশ শাসন করেছে তার সেনাবাহিনী।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংবাদ
১৮৭৭ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। । এটি তৈরি করেন প্র্রতিবেদক লি লেসেইজ। সংবাদ প্র্রতিনিধি তার মূল কর্মক্ষেত্রে হংকং হলেও ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি দিল্লিতে ছিলেন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফেরি বোটে রণাঙ্গণে চলে আসেন। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টের বিদেশ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। শেষে এই পত্রিকা র সহকারি ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের উইকএন্ড এডিটর ছিলেন। ২৭ জুলাই ১৯৯৬ লি লেসেইজ ৫৭ বছর বয়সে ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে ঢাকা রেসকোর্সে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান সমাহিত হয়। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এ ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রকাশিত লি লেসেইজের প্র্রতিবেদনটির একাংশ অনূদিত হলো।
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শেষ:
ফুল ও করতালির মধ্যে ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা প্র্রবেশ
ঢাকা ১৬ ডিসেম্বর।
হাজার হাজার বাঙ্গালির 'জয় বাংলা' স্লোগান ও আনন্দধ্বনির মধ্য দিয়ে ভারতীয় সৈন্যদল আজ ঢাকা শহরে প্র্রবেশ করল।
মেজর জেনারেল গান্ধর্ব নাগরার কমান্ডের অধীন ভারতীয় সৈন্য এবং পূর্ব পাকিস্তানি গেরিলাদের একটি দল খুব ভোরে শহরের বাইরের দিকটাতে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেবার পর জানতে পারে ভারতের কাছে আত্মসমর্úন করার চূড়ান্ত ঘোষণা পাকিস্তানি কমান্ড মেনে নিয়েছে।
নাগরা বলেন, স্থানীয় সময় সকাল ৮-৩০ (ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম বুধবার রাত দশটা) টায় তিনি পাকিস্তানি সামরিক সদর দফতরে একটি বার্তা পাঠান এবং তাৎক্ষণিকভাবে জবাব পেয়ে যান যে পাকিস্তান তাদের আর প্র্রতিরোধ করবে না। তারপর দলবলসহ তিনি ঢাকা শহরে প্র্রবেশ করলেন।
তিনি এখানে সকাল দশটার দিকে পাকিস্তানি কমান্ডার লেফেটন্যান্ট জেনারেল এ একে নিয়াজির সাথে দেখা করলেন। নাগরা বললেন, 'আমরা পুুরোনো বন্ধু, সেই কলেজের দিনগুলো থেকে।'
ভারতীয় জেনারেল তারপর ঢাকা এয়ারপোর্টে গেলেন, ভারতের ইস্টার্ন কমান্তের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবের আগমনের প্র্রতীক্ষায় রইলেন, তিনি কোলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে আসছেন।
এয়ারপোর্টে জেনারেলের সাথে কেবল তিনজন ভারতীয় সৈনিক। অমসৃণ কাঠের স্টিক হাতে নিয়ে তিনি যখন ঘোরাচ্ছেন পাকিস্তানি এয়ারপোর্ট ডিফেন্স ইউনিট রানওয়ের শেষপ্র্রান্তে একত্রিত হয়েছে, এখান থেকে তারা তাদের আত্মসর্ম্পন করার নির্ধারিত স্থানে চলে যাবে।
বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে রাস্তায় পাকিস্তানি সৈন্যের সংখ্যা ভারতীয় সৈন্যের চেয়ে অনেক বেশি, মাঝে মধ্যে বিক্ষিপ্ত গোলাগুলিও হচ্ছে। অনেক ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছে, হোটেল ইন্টারকন্টিনেটালের সামনে ভারতীয় একজনের মৃত্যু হয়েছে।
মুক্তি বাহিনী-পূর্বর্ পাকিস্তান লিবারেশন আর্মির সদস্যরা জনতার সাথে মিলে গেছে। আনন্দিত জনতার সাথে মিশে তারা আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ছে।
টাইমের প্রচ্ছদে বাংলাদেশের স্বাধীনতার উচ্ছাস
নাগরা ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লেরকে হোটেল ইন্টারকান্টিনেন্টালে পাঠালেন। এটি রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ অ ল ঘোষিত হয়েছে। এখানে অবস্থানকারী বিদেশি এবং এখানে আশ্রয় নেওয়া পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক বেসামরিক সরকারের সদস্যদের রক্ষা করার জন্য ক্লের-এর এখানে আগমন।
বাঙ্গালি জনতা বারবার ক্লের গাড়ি রাস্তায় ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে তাদের নেতা ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসতে চেষ্ঠা করে। ব্রিগেডিয়ার ক্লের নিজেই বেরিয়ে আসেন, বাঙ্গালিরা তার উপর আছড়ে পড়ে, একজন তার হাতে গুঁজে দেয় এক গোছা গাঁদা ফুল। বাঙ্গালিরা চিৎকার করে বলতে থাকে, অনেক ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। ২ ব্রিগেডের কিছু বেশি সৈন্য নিয়ে ৪ ডিসেম্বর সকালে নাগরা ও ক্লের পাকিস্তানি সীমান্ত অতিক্রম করেন, উত্তর দিক থেকে লড়াই করতে করতে ঢাকায় এসে উপস্থিত হন।
তারা ১৬০ মাইল পেরিয়ে এসেছেন আংশিক গরুর গাড়িতে এবং আংশিক পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করে, সবগুলো শহরেই। একজন বিদেশি রিপোর্টার এয়ারপোর্টে নাগরাকে বললেন, 'আমরা আপনাদের উপর ভরসা করেছিলাম, ক্রিশমাসের আগে বাড়ি ফিরে যাব।'
জেনারেল বললেন, আমরা সে ব্যবস্থাই করেছি।
তিনি বললেন, আমরা যে পথে ঢাকায় প্র্রবেশ করেছি সে পথে পাকিস্তানি সৈন্যদের মৃতদেহ পড়ে আছে। ' এটা মর্মান্তিক, হাতে সময় না থাকায় আমরা তাদের কবর দিতে পারিনি।'
নাগরা বললেন, 'সারাপথ আমাদের জন্য করতালি ও আনন্দধ্বনি দেওয়া হয়েছে।' জেনারেল নাগরার একজন সহকারি বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে তার কাছে এলেন।
জনতার কাছে উপেক্ষিত পাকিস্তানের পরাজিত সৈন্য ও পুলিশ সারিবদ্ধভাবে নিজেদের অস্ত্র বহণ করে আত্মসমর্পন ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সেখানে তাদের নিরস্ত্র করা হবে।...
চারদিকে আনন্দের গুলিবর্ষণ ও উল্লাসের চিৎকারের মধ্য দিয়ে বিকেল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্úনের ঘটনা ঘটে।
বাসভর্তি ভারতীয় সৈন্যদের গাড়ি থামিয়ে উল্লসিত বাঙ্গালিরা ধন্যবাদ দিচ্ছে। ২৫ মার্চের পর নিয়ন্ত্রণ প্র্রতিষ্ঠিার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নির্মম কর্মকান্ড চালিয়েছে তখন থেকে লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটি বের করে তারা আবার উড়িয়ে দিচ্ছেন।
(উৎস: নিবন্ধকারের গ্রন্থ: বিদেশির চোখে ১৯৭১, উনিশ শত একাত্তর, একাত্তরের দলিল ১ , একাত্তরের দলিল ২)