জাপানিরা এত সৎ কেন
পকেটের মানিব্যাগ বা পার্স হারিয়ে দিশেহারা হয়নি এমন লোক পাওয়া যায় না। আর এখন আছে স্মার্টফোন। পকেট থেকে ফোন হারানো গেলে রীতিমতো দুনিয়াটাই হারিয়ে যায় আমাদের। হঠাৎ করে মনে হয় পুরো দুনিয়া থেকেই যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি।
কিন্তু পৃথিবীর একটি শহর আছে যেখানে আপনার শত মূল্যবান জিনিসটি হারিয়ে গেলেও ফিরে পাবেন অনায়াসে, দিশেহারা হতে হবে না আপনাকে। জাপানের টোকিও শহর- যেখানে আপনার হারিয়ে যাওয়া বস্তুটির সঙ্গে আবার মিলিত হবেন আপনি।
টোকিও শহরে ১৪ মিলিয়ন লোকের বাস। জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। অথচ ২০১৮ সালে হারিয়ে যাওয়া আইডি কার্ডের ৭৩ শতাংশ মালিকই তাদের কার্ড ফেরত পেয়েছেন। পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার আইডি কার্ড ফেরত দিয়েছে টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশ। শুধু তাই নয়, এক লাখ ৩০ হাজার মোবাইল ফোন (৮৩%) এবং দুই লাখ ৪০ হাজার ওয়ালেট (৬৫%) তাদের মালিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এবং মজার ব্যাপার হলো যেদিন হারিয়েছে সেদিনই ফেরত পেয়েছেন তারা।
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান ল স্কুলের প্রফেসর ড. মার্ক ডি ওয়েস্ট একটি গবেষণা করেন। গবেষণায় হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন তাদের মালিককে ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে টোকিও ও নিউ ইয়র্ক এই দুইটি শহরের পারফরমেন্স যাচাই করেন তিনি। গবেষণায় দেখা গেছে, টোকিও শহরে ৮৩ শতাংশ মালিকই তাদের হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন ফিরে পেয়েছেন, যেখানে নিউ ইয়র্কে ফেরত পেয়েছেন মাত্র ৬ শতাংশ। টোকিওতে বাকি ১৭% মোবাইল ফোন তাদের মালিককে ফেরত দেওয়া যায়নি কারণ সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছিল।
কিছুদিন আগে ঢাকায় এক লোকের ১০ লাখ টাকাসহ একটি ব্যাগ পুলিশের কাছে ফেরত দিয়েছিল বলে টানা দুইদিন লিড নিউজে ছিলেন তিনি। কিন্তু জাপানের লোকজনকে জিজ্ঞেস করুন, তারা বলবে, 'আরে, তাতে কি হয়েছে? এটাই তো স্বাভাবিক'। টাকাটা ফিরিয়ে না দেয়াটাই বরং অস্বাভাবিক তাদের কাছে।
জাপানিদের এই সততা আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু মনে প্রশ্নও জাগায়- কেন জাপানের লোকজন এতটা সৎ?
প্রফেসর ড. মার্ক ডি ওয়েস্ট বলেন, ‘জাপানিরা এই সততা দৈবগুণে পায়নি, তাদের আইন-শৃঙ্খলা যথেষ্ট শক্তিশালী। মানুষ আইন মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু তবুও এটাই একমাত্র কারণ নয়। জাপানিরা উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু একটা পায়, যা তারা মনে প্রাণে ধারণ করে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।’
কিন্তু কি সেই রহস্যময় সূত্র যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বপন করে চলছে জাপানিরা?
১। পুলিশ যখন বন্ধু -জাপানি কাবান
জাপানের মহল্লাগুলোয় কিছুদূর পরপরই ছোট ছোট পুলিশ স্টেশন আছে। এই স্টেশনগুলোকে বলা হয় কাবান। এখানকার পুলিশরা রীতিমতো বন্ধুর মতো আগলে রাখে মহল্লাবাসীকে। মজার উদাহরণ দিই, এলাকায় কোন বয়স্ক বাসিন্দার খোঁজ নিতে হলে তাদের আশেপাশের প্রতিবেশীর বাড়ি যান অফিসাররা। জিজ্ঞেস করেন,”পাশের বাড়ির মুরুব্বিরা কেমন আছেন? খবর রাখেন তাদের?” এভাবেই তরুণ প্রজন্মদের মধ্যে বয়স্কদের প্রতি দায়িত্বশীলতার চর্চা ছড়িয়ে দিতে কাজ করেন তারা।
শুধু তাই নয়, বাচ্চারা যেন বয়স্কদের প্রতি খেয়াল রাখে, রাস্তা পার হতে সহায়তা করে, বাড়ি এগিয়ে দেয় এসমস্ত বিষয়েও উদ্বুদ্ধ করেন অফিসাররা।
২। বুদ্ধের শিক্ষা
জাপানিদের এই সততা ঠিক ধর্ম ভীতি থেকে আসেনি। কিন্তু তবু তাদের অনেকেই ‘শিন্তো’ রীতির চর্চা করেন। এই রীতি অনুসারে মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান হবে মানুষ। কিন্তু তারাই পুনর্জীবন লাভ করবে যাদের হৃদয় শুদ্ধ আর কর্ম সৎ। পারিবারিকভাবে এই রীতির চর্চাও সততা আর দায়িত্বশীলতা তৈরি করে।
৩। পারিবারিক বন্ধন
জাপানিরা ছোটবেলা থেকেই দৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে বড় হয়। এখনও জাপানে কেউ অসুস্থ হলে রোগীকে নয়, বরং তার পরিবারের সদস্যদেরকে রোগের কথা জানান ডাক্তার। কেননা তারা মনে করেন পরিবারের সদস্যদের আদর আর ভালোবাসাই সবচেয়ে বেশি দরকার। মানুষকে যেকোনো বিপদে শক্ত থাকার প্রেরণা যোগায়।
আর এই পারিবারিক বন্ধনই জাপানিদের পরিবার, সমাজ আর মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলে।
৪। ‘হিতো নো মি’
২০১১ সালে জাপানে সুনামির আঘাতে পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে তেজষ্ক্রিয়প্রবণ এলাকাগুলো থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয় মানুষকে। এসময় পাড়া-মহল্লাগুলো একেবারে বিরান পড়েছিল। ছিল না পাহারা দেওয়ার মতো কেউ। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার- মাসখানেক পর এসে দেখা গেল জিনিসপত্র যেভাবে রেখে যাওয়া হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই রয়ে গেছে সব, কারও কোনো কিছু খোয়া যায়নি, চুরি যায়নি!
কিভাবে সম্ভব হলো এটা? সাধারণত যখন দেখার কেউ থাকে না, মানুষের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। কিন্তু জাপানে এরকমটা হয় না। এর কারণ ‘হিতো নো মি’, যার মানে হলো ‘সমাজের চোখ’। প্রতিটি সমাজের একটা সত্ত্বা আছে, যাকে তিল তিল করে তৈরি করি আমরা। কেউ না দেখলেও সমাজের এই চোখ দেখছে বলেই বিশ্বাস করেন জাপানিরা।
৫। আমি নই, আমরা
হ্যাঁ, এটাই তাদের শক্তি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদে নয়, বরং যৌথ সত্ত্বায় বিশ্বাস করেন তারা। এভাবেই শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য চিন্তার চর্চা করেন জাপানিরা।
এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ জাপানি মা-ই চান, তাদের সন্তান একটি সাধারণ জীবন যাপন করুক। খুব উচ্চাভিলাষী, সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবনে তারা অভ্যস্ত হোক, এটা তারা একেবারেই চান না। এর কারণ, জাপানী মায়েরা মনে করেন, একসঙ্গে থাকার শক্তিই মানুষকে বড় করে। মানুষকে উদার আর দয়াশীল করে। আর আজকের পৃথিবীতে এটাই সবচাইতে বেশি দরকার আমাদের।