একজন সমাজসেবী এবং ব্যারিস্টার রফিক-উল হক
আর ক'দিন পরই, ২ নভেম্বর, ৮৪ পেরিয়ে ৮৫-তে পড়তেন দেশের প্রবীণতম আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে জীবনের সেই 'মাইলফলক' ছোঁয়া হলো না তার।
শনিবার (২৪ অক্টোবর) চিরতরে চোখ বুজলেই তিনি। তবু দীর্ঘজীবনে যে দ্যুতি ছড়িয়ে গেছেন, তার অবদান ভোলা সম্ভব হবে না; হবে না উচিতও।
এক পলকে এক জীবন
২ নভেম্বর ১৯৩৩ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন রফিক-উল হক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৫ সালে স্নাতক, ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ১৯৫৮ সালে এলএলবি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে কলকাতা উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসেবে বারের সদস্য হন তিনি। ১৯৬১ সালে ব্যারিস্টার (বার-এট-ল) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর বার অ্যাট ল করেন যুক্তরাজ্য থেকে।
অন্যদিকে, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ঢাকা উচ্চ আদালতে যোগ দেন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসাবে কাজ শুরু করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন।
১৯৯০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন।
২০০৬-০৮ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার অভিযোগ আনা হলে তিনি তাদের দুজনের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য কোনো সম্মানী নেননি। পেশাগত জীবনে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রকাশ্যে সমর্থন না করলেও নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা সবসময় তাকে পাশে পেয়েছেন।
সমাজসেবা
শুধু প্রতিথযশা আইনজীবীই নয়, সমাজসেবক হয়ে দেশের নানা সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।
সফল আইনজীবী হিসেবে উপার্জিত অর্থের বড় অংশই সমাজসেবা ও মানুষের কল্যাণে তিনি ব্যয় করেছেন। বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ ও মেডিকেল কলেজ করেছেন প্রতিষ্ঠা ।
১৯৮৬ সালে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই শুরু হয় তার। এক সময় সুস্থও হন। এ ঘটনা গরিব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা তাকে আরও ভাবিয়ে তোলে। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সুবর্ণ ক্লিনিক। ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও ছিল তার ভূমিকা। এছাড়া গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। সে কাজ এখনো চলছে; নেই শুধু তিনি।
অন্যদিকে, বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও নূরজাহান ওয়ার্ড, আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল এবং আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ছিলেন এই দুঁদে আইনজীবী। এছাড়া অন্তত ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল।
ছায়াঘেরা বাসায় দিনযাপন
ঢাকার পুরানা পল্টনে 'সুবর্ণা' নামে ছায়াঘেরা, শীতল, ছিমছাম একটি বাড়িতে ছিল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বসবাস।
জীবনের শেষদিনগুলোতে বার্ধক্যে কাবু হয়ে পড়েছিলেন। অনেকটা নীরবে, নিভৃতেই কাটিয়েছেন দিন। শরীর সায় দিলে বই ও পত্রিকা পড়তেন, টিভি দেখতেন। বাসা থেকে বের হতেন না খুব একটা। বের হলেও ভরসা ছিল হুইলচেয়ার।
প্রিয় কর্মক্ষেত্র সুপ্রিম কোর্টে খুব একটা যেতেন না। নতুন-পুরনো প্রায় সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়েছিলেন ছেলে ব্যারিস্টার ফাহিমুল হক ও জুনিয়র আইনজীবীদের কাঁধে।
সম্প্রতি 'সুবর্ণা'তেই এক গণমাধ্যমকর্মীকে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, 'আমার এখন মরার বয়স হয়েছে। ওসব নিয়ে এখন আর চিন্তা করি না। ভাবিও না। আগে ভাবতাম। কথা বলতাম। এখন আর বলি না। বলতে চাইও না।'
অসুখ ও নিঃসঙ্গতার জার্নাল
ক্যানসার জয়ের বেশ কিছুদিন পর, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে বাম পায়ে অস্ত্রোপচার হয় তার। এরপর থেকেই আর স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারেননি।
ঘনিষ্ঠজনদের ভাষ্যমতে, ২০১১ সালে স্ত্রী ডা. ফরিদা হকের মৃত্যুর পর থেকেই তিনি নিঃসঙ্গতায় ভুগতে শুরু করেন। বার্ধক্য যোগ হয়ে সেই নিঃসঙ্গতা বেড়েছিল কয়েকগুণ।
'সুবর্ণা'র দোতলায় তার দেখাশোনা করতেন একাধিক গৃহপরিচারক। তাদের ভাষ্যমতে, বয়সের কারণে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের জীবনযাপনে এসেছিল অনেকটা পরিবর্তন। ঘুম থেকে একটু দেরিতে উঠতেন। গ্রহণ করতেন পরিমিত আহার।
তার জুনিয়র এক আইনজীবী জানিয়েছিলেন, পুরানা পল্টনের ছায়াশীতল, নিরিবিলি এই বাড়িটি ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের এত প্রিয় ছিল, সেখান থেকে কোথাও যেতে চাইতেন না।
এবার চিরচেনা বাড়ি, চিরচেনা কর্মস্থল, চিরচেনা মানুষগুলোকে ছেড়ে অনন্তযাত্রায় পাড়ি জমালেন দুঁদে আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।
- সূত্র: উইকিপিডিয়া, যুগান্তর ও মানবজমিন