পাওয়া গেল ৫৬৪ কোটি টাকার শিল্পকর্ম
ডিসেম্বর মাস, ইতালির উত্তরের শহর পিয়াসেনজার এক ঠাণ্ডা সকাল। অন্যদিনগুলোর মতোই শহরের রিচি অড্ডি গ্যালারি অব মডার্ন আর্টের বাগান পরিষ্কার করছেন পরিচর্যাকারীরা। গ্যালারির পূর্ব পাশে আইভি লতার ঘন ঝাড় পরিষ্কার করতে গিয়ে তাদের একজন দেখলেন জং ধরা একটা লোহার পাল্লা। টেনেটুনে পাল্লা সরাতেই বেরিয়ে এল মাকড়সার জাল জড়ানো একটা কালো ব্যাগ।
সে ব্যাগেই পাওয়া গেল ২৩ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া চিত্র ‘পোর্ট্রেট অফ এ লেডি’! বহুমূল্য এই চিত্রকর্মের স্রষ্টা শিল্পী গুস্তাভ ক্লিমট।
চিত্রকর্মটি যে গুস্তাভেরই সে বিষয়ে নিশ্চিত করেছে ইতালিয়ান প্রশাসন।
ক্লিমটের এই চিত্রকর্মের দাম আনুমানিক ৬০ মিলিয়ন ইউরো, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৫৬৪ কোটি টাকা!
‘পোর্ট্রেট অফ এ লেডি’ বা নারীর প্রতিকৃতি নামের এই চিত্রকর্মটি ১৯৯৭ সালে উত্তর শহর পিয়াসেনজার একটি গ্যালারি থেকে চুরি যায়।
অনেক তদন্ত আর খোঁজাখুঁজি করেও যখন শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল না, ধরে নেওয়া হলো যে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে ছবিটা। এরপর গত ডিসেম্বরে বাগান পরিষ্কার করতে গিয়ে আইভি লতার ঝাড়ের আড়ালে গ্যালারির বাইরের একটা দেয়ালে খুঁজে পাওয়া গেল ছবিটা!
কিন্তু ছবিটা কে চুরি করেছিল আর কেনই বা গত ২৩ বছর ধরে রিচি অড্ডি গ্যালারি অব মডার্ন আর্টের দেয়ালে লুকিয়ে রাখলো, সেটা রয়ে গেছে রহস্যের অন্তরালেই।
প্রসিকিউটর অরনেলা চিক্কা বলেন, ‘ছবিটি যে ক্লিমটেরই আঁকা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি হলফ করে বলতে পারি।’
তবে এখনও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বাকি আছে। এই পরীক্ষাগুলোর ফলাফলই বলে দেবে যে পেইন্টিংটি চুরির সময় থেকেই প্রাচীরের জায়গার ভিতরে ছিল, না কি সেখানে পরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আর এই পরীক্ষাগুলো শেষ হওয়ার পরেই আর্টওয়ার্কটি গ্যালারির দেয়ালে ফিরে আসবে বলে জানান অরনেলা চিক্কা।
ছবিটি যে গুস্তাভেরই, তা নির্ধারণ করার জন্য বিশেষজ্ঞরা ইনফ্রারেড এবং অতিবেগুনি আলোতে চিত্রকর্মটি পরীক্ষা করেছেন। ১৯৯৬ সালে ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলোর সঙ্গে আসল ছবিটির তুলনা করেছেন।
চিত্রশিল্প বিশেষজ্ঞ গিডো কাউজি বলেছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল বলছে, এটিই মূল চিত্র।
আর ছবিটিও ‘তুলনামূলকভাবে ভালো’ অবস্থায়ই আছে। তবু নিয়মিত কিছু যত্ন দরকার বলে জানান তিনি।
‘পোর্ট্রেট অফ এ লেডি’ ছবিটি ১৯১৬-১৭ সালে জীবনের শেষের দিকে আঁকেন ভিনিস শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট।
এরপর ১৯২৫ সালে ছবিটি কিনে নিজের গ্যালারিতে নিয়ে আসেন জিসেপ রিচি অড্ডি। ৭২ বছর গ্যালারির দেয়ালেই শোভা পাচ্ছিল ছবিটা। কিন্তু ১৯৯৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজনের সময় গ্যালারির দেয়াল থেকে চুরি যায় সে চিত্র।
কিন্তু এত নিশ্ছিদ্র পাহারার ভেতর দিয়ে কি করে চুরি গেল ছবিটা?
ছবির ফ্রেমটি ছাদের স্কাইলাইটের সঙ্গে আটকানো অবস্থায় রেখে যায় চোর, যাতে মনে হয় ছাদ ফুঁড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ছবিটাকে। কিন্তু এটা অসম্ভব, কেননা স্কাইলাইটটি এত ছোট যে, সেখান দিয়ে এত বড় ছবি বের করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
সেই রহস্য এখনও ভেদ করা যায়নি।
অবশেষে ২৩ বছর পর গত ডিসেম্বরে, গ্যালারির বাগান পরিষ্কার করতে গিয়ে পাওয়া গেল গুস্তাভের সেই চুরি যাওয়া চিত্র।
গ্যালারি কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ১০ বছর ধরে পরিষ্কার করা হয় নি এই আইভির ঝাড়।
ছবিটি চুরি যাওয়ার কিছুদিন আগেই শিল্পকলার এক শিক্ষার্থী ক্লদিয়া মাগা আবিষ্কার করেন যে, গুস্তাভ তার আরেক চিত্র ‘পোট্রেট অব এ ইয়াং লেডি’ বা এক তরুণীর প্রতিকৃতির অনুকরণে ছবিটি আঁকেন ‘পোর্ট্রেট অফ এ লেডি’। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, ‘পোট্রেট অব এ ইয়াং লেডি’ ছবিটিও ১৯১২ সালে চুরি যায়! এরপর থেকে আর পাওয়া যায় নি ছবিটি।
অস্ট্রিয়ান শিল্পী গুস্তাভ ক্লিমটের জন্ম ভিয়েনায় ১৮৬২ সালে। ১৮৯৭ সালে ভিয়েনা সাকসেশনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন এই শিল্পী। এসময় অস্ট্রিয়ায় শিল্পীরা একত্র হয়েছিলেন প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে। নারীদেহ গুস্তাভের চিত্রকর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অ্যাডেলে ব্লচ বাউয়ার, দ্য কিস, জুডিথ এন্ড দ্য হেড অব হলোফারনেস ইত্যাদি তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম।