বায়ুবাহী করোনাভাইরাস: পাঁচটি বিষয় না জানলেই নয়
করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্তের সাত মাসেরও বেশিকাল পার হয়ে গেলেও বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এখনো ঘাম ঝরাচ্ছেন এই ভাইরাস কীভাবে ছড়ায় এবং এর সংক্রমণ কীভাবে রোধ করা যায়, সেই গবেষণায়।
কোভিড-১৯ আক্রান্তের সরাসরি সংস্পর্শের পাশাপাশি ভাইরাসটি লেগে থাকা বস্তু থেকেও ছড়ায় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বাতাসের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানো সম্ভব কি না, সম্প্রতি এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা জোরাল হয়ে উঠেছে।
বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমণ বলতে যা বোঝায়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ ও নাক থেকে বের হওয়া ভাইরাসটির ড্রপলেট বা কণাগুলো সামান্য সময়ের জন্য বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে।
কিন্তু কিছু বিজ্ঞানী ও গবেষক বারবার বলে আসছেন, এরোসোল বা অতি ক্ষুদ্র কণা হয়েও বাতাসে ভাসতে পারে এই ভাইরাস । মানুষ যখন জোরে কথা বলে ও গান গায়, তখন বের হওয়া ওই কণার পক্ষে বাতাসে বেশ কিছুক্ষণ এবং বেশ দূরত্ব পর্যন্ত ভেসে বেড়ানো সম্ভব।
ড্রপলেট আকারে ছড়ানোর সঙ্গে এর পার্থক্য
হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে শ্বাসযন্ত্র থেকে বের হওয়া ড্রপলেট বা কণাগুলো তুলনামূলক ভারি, ৫ থেকে ১০ মাইক্রোমিটার ব্যাস আকারের হতে পারে। এটির পক্ষে তিন থেকে ছয় মিটার দূরত্বে ছড়ানো সম্ভব।
অন্যদিকে এরোসোল বা অতি ক্ষুদ্রকণার আকার পাঁচ মাইক্রোমিটারের চেয়েও ছোট; এর পক্ষে বাতাসে ভেসে ছয় ফুটের চেয়েও বেশি দূরত্বে যাওয়া সম্ভব।
যুক্তরাজ্যের কনসালট্যান্ট মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজিস্ট স্টেফানি ড্যান্সার বলেন, 'ড্রপলেট কিংবা এরোসোল- উভয় আকারের কণার পক্ষেই তিন ঘণ্টার মতো জীবিত থাকা সম্ভব; অবশ্য সেটা তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, অতি বেগুনী রশ্মি, এবং এমনকি বাতাসে অন্যান্য উপাদানের অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করে।'
'ইনডোর পরিবেশে বাতাসে ভর দিয়ে অন্তত প্রায় বিশ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারে মাইক্রোস্কোপিক এরোসোল। বাতাস অনুকূলে থাকলে আরও দূর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব। এরোসোলটি আকার কেমন, এটি তার ওপর নির্ভর করছে,' বলেন তিনি।
বাতাসে যেভাবে ছড়ায় কোভিড-১৯
নিঃশ্বাস নেওয়া, কথা বলা, হাসাহাসি করা, হাঁচি দেওয়া, কাশি দেওয়া, গান গাওয়া, চিৎকার করা- নানাভাবেই কণাগুলো ছড়াতে পারে।
ড্যান্সার বলেন, 'নিঃশ্বাস নেওয়ার মধ্যে খুব একটা জোর না পড়লেও, চিৎকার করা, গান গাওয়া, কাশি ও হাঁচি দেওয়ার ক্ষেত্রে তুলনামূলক জোর বেশি পড়ে এবং এর ফলে অতি ক্ষুদ্র কণাগুলো বিভিন্ন বেগে ছড়িয়ে পড়ে।'
'যদি কোনো কণায় সংক্রমণ করার মতো যথেষ্ট ভাইরাস নাও থাকে, সে রকম কণা বারবার নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করার ফলে আপনার মুখ, নাক ও শ্বাসযন্ত্রে জমে জমে আপনাকে আক্রান্ত করার মতো যথেষ্ট আকার ধারণ করবে,' বলেন তিনি।
চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সময়ও আক্রান্তের শরীর থেকে বের হওয়া ক্ষুদ্রকণা বাতাসের মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটিয়ে ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে স্বাস্থ্যকর্মীদের।
অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিকস অব পাকিস্তানি ডিসেন্ট অব নর্থ আমেরিকার (এপিপিএনএ) প্রেসিডেন্ট নাহিদ ওসমানি বলেন, 'নেবুলাইজার, ব্রঙ্কোস্কপি, ইনটিউবেশন, ডেন্টাল ও অন্যান্য ওরাল চিকিৎসাসেবাদানের সময়ও বিশেষ পরিস্থিতিতে অতি ক্ষুদ্র কণার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে।'
'শুধুমাত্র এন৯৫ মাস্ক-সহ যথাযথভাবে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) পরার মাধ্যমেই এই ঝুঁকি থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের সুরক্ষা দিতে পারেন,' বলেন তিনি।
বাতাসে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা কম?
ড্রপলেটের তুলনায় এরোসোল আকারে করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে তর্কের শেষ হয়নি এখনো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই ড্রপলেট আকারে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার কথা প্রকাশ করলেও, বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর বিষয়টি এখনো স্পষ্ট করেনি।
এ সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির টেকনিক্যাল লিড ফর ইনফেকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল, বেনেদেত্তা আলেগ্রাঞ্জি বলেন, 'বিশেষত জনসমাগম, বদ্ধ, বাজে রকমের ভেন্টিলেশন প্রেক্ষাপটে বাতাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে।'
৩২ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ২৩৯ জন বিজ্ঞানীর একটি দল বিশেষ করে বায়ু প্রবাহের যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেই- এমন বদ্ধ ও ভীড় পরিবেশে বাতাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়ানোর 'ব্যাপক ঝুঁকি' উল্লেখ করে একটি খোলা চিঠি প্রকাশের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমন অভিমত প্রকাশ করল।
ওই চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের একজন হিসেবে ড্যান্সার বলেন, উৎস বা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরত্ব যত বেশি, আপনার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও তত।
ইউনিভার্সিটি অব কলোর্যাডোর রসায়নবিদ জোসে-লুইস জিমেনেজ বলেন, 'একদম ঘরের ভেতর থাকলে কিংবা এক ঘণ্টার মতো পেরিয়ে গেলে ভাইরাসটি কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।'
নিজেকে রক্ষা করবেন কীভাবে?
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথাযথভাবে মাস্ক পরা এবং শারীরিক দূরত্বের বিধি মেনে চলার বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, জনসমাগম, বিশেষ করে গণ পরিবহন ও পাবলিক বিল্ডিং এড়িয়ে যেতে হবে।
স্কুল, অফিস ও হাসপাতালের মতো বদ্ধ জায়গায় বাইরের বাতাসের আসা-যাওয়ার বা ভেন্টিলেশনের যথাযোগ্য ব্যবস্থা থাকলে ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমে বলে জানিয়েছেন জিমেনেজ।
'যেখানে ভেন্টিলেশন সুবিধা বাড়ানোর উপায় নেই, সেখানে পোর্টেবল হাই-ইফিসিয়েন্সি পার্টিকুলেট এয়ার (এইচইপিএ) ফিল্টার এয়ার ক্লিনার কিংবা সম্ভাব্য আল্ট্রাভায়োলেট (ইউভি) জার্মিসিডাল লাইট ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছি। এর বাইরে অন্য কোনো ধরনের এয়ার ক্লিনার ব্যবহারের কথা বলব না আমরা,' বলেন তিনি।
- সূত্র: আল জাজিরা