মানুষের আত্মার ওজন কত?
২০১৫ সালে নাইকে হিটনের একটি জনপ্রিয় গান '২১ গ্রাম' যার একটি লাইন এরকম,
"আমি শুধু তোমার আত্মাকে আমার হাতে চাই, অনুভব করতে চাই তোমার ২১ গ্রাম ভর"(I just want your soul in my hands, / feel your weight of 21 grams) ।
আত্মার ওজন আছে, এবং বিশেষ করে এর ওজন ২১ গ্রাম- এই ধারণাটি দিনে দিনে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মজার ব্যাপার হলো, ২০০৩ সালে '২১ গ্রাম' নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। বোঝাই যাচ্ছে আত্মার ওজন আছে এবং এর ওজন ২১ গ্রাম, এমন বিশ্বাস জনমনে আজ প্রায় প্রতিষ্ঠিত। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে এই তত্ত্ব আজও অমিমাংসিতই রয়ে গেছে।
এই বিশ্বাসের শুরু সেই ১৯০১ সাল থেকে, যেদিন ম্যাসাচুসেটসের হাভারহিলের চিকিৎসক ম্যাকডোগাল ডানকান (MacDougall Duncan) বৈজ্ঞানিকভাবে আত্মার ওজনকে মাপা যায় কি না, এ বিষয়ের উপর চিন্তাভাবনা করেন। এরপর এ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান তিনি। ১৯০৭ সালে অর্থাৎ যে বছর আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের উপর মাধ্যাকর্ষণের সুত্র প্রয়োগ করেন, সেই বছরই ম্যাকডোগাল 'আমেরিকান মেডিসিন' এ তার গবেষণালব্ধ ফল প্রকাশ করেন।
এ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা থেকে ম্যাকডোগাল এই হাইপোথেসিস দেন যে, আত্মার শারীরিক ওজন আছে।
কি করে তিনি মাপলেন এই ওজন? তিনি একটি পরীক্ষা করলেন -মানুষের আত্মা মানুষকে ছেড়ে চলে যাওয়ার তাৎক্ষণিক মুহুর্তে এর ওজন মাপার চেষ্টা করেন। মৃত্যু অবধারিত এরকম ছয়জন রোগীর উপর তিনি এই গবেষণা চালান। তিনি দেখতে পান, ছয়জন মৃত্যুপথযাত্রীর একজন মারা যাওয়ার সাথে সাথে, এক আউন্সের তিন চতুর্থাংশ (২১.৩ গ্রাম) ওজন হারায়। তার এই পরীক্ষার নাম পরবর্তীতে '২১ গ্রাম পরীক্ষা' নামে বিখ্যাত হয়।
এই গবেষণার জন্য তিনি নার্সিং হোমের এমন ছয়জন রোগীকে বাছাই করেন, যাদের চারজন যক্ষ্মায় আক্রান্ত ছিল, একজন ডায়াবেটিসে ভুগছিল, আরেকজন ঠিক কোন রোগে আক্রান্ত তা শনাক্ত করা যায় নি। ম্যাকডোগাল বিশেষ করে তাদেরই বাছাই করেন, যাদের শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হয়েছিল এবং যারা মারা যাওয়ার সাথে সাথে তাদের শরীরের ওজন নিখুঁতভাবে মাপার সময় রোগীর আত্মীয়স্বজন বা অন্য কোনো জায়গা থেকে প্রতিবন্ধকতা তৈরী না হয়। যখন সেইসব রোগী মৃত্যুর সন্নিকটে পৌছে যেত, তখন তাদের সম্পুর্ণ বিছানা জুড়ে ব্যবসায়িক স্কেল স্থাপন করা হত। এই স্কেলটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিল, যা এক আউন্সের দুই দশমাংশ(৫.৬ গ্রাম) পর্যন্ত তারতম্যকে হিসাব করতে পারত।মৃত্যুর পুর্ব ও পরমুহুর্তে রোগীর ওজনের তারতম্য থেক আত্মার ওজন বের করাই এই গবেষণার মুল লক্ষ্য ছিল।
ছয়জন রোগীর মধ্যে একজন মৃত্যুর পর ওজন হারালেও, পুনরায় মাপার পর, সেই হারানো ওজন আবার ফিরে আসে, দুইজন রোগী মৃত্যুর পর ওজন হারান বলে গবেষণার নথিতে লিপিবদ্ধ হয়, কিন্তু কয়েক মিনিট পর দেখা যায়, তারা আরো কিছু ওজন হারাচ্ছেন। একজন মৃত্যুর পর এক আউন্সের তিন-চতুর্থাংশ (২১.৩ গ্রাম) ওজন হারান। ম্যাকডোগাল একটি ফলাফলকে বাতিল করে দেন এই বলে যে, ওই রোগীর ক্ষেত্রে স্কেলটা ঠিকভাবে স্থাপন করা হয়নি এবং আরেকটি ফলাফলকে তিনি হিসাবে ধরেননি কারণ রোগী মারা যাওয়ার পর ওজন মাপার যন্ত্রাংশ তখনো মানাঙ্ক নির্ণয় করছিল।
ধর্মীয় মত অনুসারে, মানুষের আত্মা আছে, কুকুরের নেই- এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ম্যাকডোগাল পনেরটি কুকুরের মৃত্যুর পর তাদের ওজন মাপেন। ম্যাকডোগাল বলেন, তিনি তার পরীক্ষার জন্য সেইসব কুকুরকেই বাছাই করেছেন, যারা হয় অসুস্থ ছিল অথবা মৃত্যু যাদের জন্য অবধারিত ছিল। এর পক্ষে অবশ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ম্যাকডোগাল তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, কোনো কুকুরই মৃত্যুর পর ওজন হারায়নি।
ম্যাকডোগাল তার পরীক্ষণ থেকে বিশ্বাস করতেন, মানুষের আত্মার ওজন আছে, যদিও ১৯০৭ সালের পুর্ব পর্যন্ত এটি প্রকাশিত হয় নি। এরপর ম্যাকডোগাল তার গবেষণার ফলাফলকে কোথাও প্রকাশ করার পুর্বেই নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯০৭ সালের ১১ মার্চ এ আর্টিকেল নিয়ে একটি স্টোরি কভার করে, যার শিরোনাম ছিল-
"চিকিৎসক মনে করেন, আত্মার ওজন আছে" (soul has Weight, Physician Thinks)। ম্যাকডোগালের ফলাফল একই বছরের এপ্রিলে জার্নাল অব দ্য আমেরিকান সোসাইটি ফর ফিজিক্যাল রিসার্চ, এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত জার্নাল আমেরিকান মেডিসিনে প্রকাশিত হয়।
এই গবেষণাটি বিস্তৃতপরিসরে খুঁতযুক্ত এবং অবৈজ্ঞানিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এইরকম স্বীকৃতি পাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল- যে পরিমাণ স্যাম্পল নেওয়া হয়েছিল, তা এ ধরনের গবেষণার জন্য যথেষ্ট নয় এবং মাত্র যে ছয়জনকে নেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র একজনের ক্ষেত্রেই এই হাইপোথিসিস খাটে। এই গবেষণাটিতে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে, তা পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদনের উদাহরণ হিসেবেও বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা হয়।
"আমেরিকান মেডিসিনে" পরীক্ষণটি প্রকাশ পাওয়ার পর চিকিৎসক অগাস্টাস পি.ক্লার্ক এই পরীক্ষণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। ক্লার্ক উল্লেখ করেন মৃত্যুর পরপরই ফুসফুস রক্তকে শীতল করা বন্ধ করে দেয়। ফলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এর পরপরই শরীর থেকে ঘাম নিঃসরণ হয়। মৃতের শরীর থেকে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পানি বের হয়ে যাওয়ায় মৃতের ২১ গ্রাম ভর কী করে কমল, তার ব্যাখ্যা দেয়। ক্লার্ক আরো একটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, কুকুরের যেহেতু কোনো ঘর্ম গ্রন্থি নেই, তাই তারা মৃত্যুর পর তাদের ওজন হারায় না।
ম্যাকডোগালের পরীক্ষার পদ্ধতিটি ত্রুটিযুক্ত এবং তার ফলাফলটিকে সুষ্পষ্টভাবে ধোঁকাবাজি বলে উল্লেখ করা হয়। অনেকেই সমালোচনা করে প্রশ্ন তোলেন, ১৯০৭ সালের সেকেলে প্রযুক্তির সাহায্যে কিভাবে ম্যাকডোগাল একজন মানুষের মৃত্যুর তাৎক্ষণিক মুহুর্তকে বুঝতে সক্ষম হলেন?
২০০৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট এল. পার্ক ম্যাকডোগালের পরীক্ষণ নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেন, "এ পরীক্ষাটির আজকের দিনে আর কোনো বৈজ্ঞানিক বৈধতা নেই"। অন্যদিকে মনোবিদ ব্রুস হুড লেখেন, "যেহেতু ওজন হারানো মুলক এ গবেষণাটি, না নির্ভরযোগ্য না পুনরাবৃত্ত হয়েছে, তাই ম্যাকডোগালের এ গবেষণাটি অবৈজ্ঞানিক হয়ে গেল।"
২০১৩ সালে স্নোপস এই পরীক্ষণ সম্পর্কে বলে, এ পরীক্ষণটি ত্রুটিযুক্ত কারণ, এই পরীক্ষায় যে কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, তা সন্দেহজনক, এখানে স্যাম্পল হিসেবে যাদের ব্যবহার করা হয়েছে, তার সংখ্যা খুবই কম এবং ওজন পরিমাপের জন্য যে যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়েছে, তা যথার্থ নয়।
১৯১১ সালে "নিউ ইয়র্ক টাইমস" তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ম্যাকডোগাল এটা আশা করছেন, এ গবেষণাটি পুনরাবৃত্তি করার সময় তিনি আত্মার ছবি তুলবেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রটিতে তিনি আর কাজ করেননি এবং ১৯২০ সালে তার মৃত্যু হয়। তার পরীক্ষণটি আর কখনোই পুনরাবৃত্তি করা হয় নি।
বৈজ্ঞানিক মহল দ্বারা এই গবেষণাটিকে বাতিল করা সত্ত্বেও ম্যাকডোগালের পরীক্ষাটি, আত্মার ওজন আছে এবং তার ভর ২১ গ্রাম, এই ধারণাটি আজও পৃথিবীর মানুষকে কৌতূহলী করে তোলে।