শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয়…
তাদের কেউ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু তাদের অদম্য ইচ্ছার কাছে হেরেছে প্রতিবন্ধকতা। হাজারো মানুষের জন্য তারা স্থাপন করেছেন দৃষ্টান্ত। জীবনে সংগ্রাম করে ঘুরে দাঁড়ানো এ চারজন হলেন কুষ্টিয়ার সুজন রহমান, শাপলা খাতুন, হালিম মিয়া ও টিপু সুলতান।
চারজনের একজন সুজন রহমান জন্মগতভাবেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। কুষ্টিয়া পৌরসভার পুরাতন গোশালা রোডের এ বাসিন্দার চোখে আলো না থাকলেও গান গেয়ে ছড়াচ্ছেন আলো। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে পড়ালেখা শেষ করে এখন সরকারি চাকরি করছেন কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। গানের জগতেও তৈরি করেছেন স্বকীয় অবস্থান।
দুই সহোদর শাপলা ও হালিম শৈশব থেকে একসঙ্গে চলাফেরা করেন। শাপলা বিএ পাস করেছেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে। আর হালিম তাকে সহযোগিতা করছেন। জন্ম থেকেই শাপলার এক পা অকেজো। আর হালিম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।
দুজন নিজ গ্রামে ব্যবসা করে সফল হয়েছেন। প্রথমে তারা ছোট পরিসরে মুদি দোকান দেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিসর। কুষ্টিয়ার হাটশ হরিপুরের এ দুজনকে নিয়ে একসময় গ্রামের লোকজন উপহাস করত। যখন ভাগ্য বদলাতে শুরু করল, তখনই স্থানীয়রা তাদের সঙ্গে মেশা শুরু করে।
টিপু সুলতান কুষ্টিয়ায় সংগীত চর্চার ওস্তাদ হিসেবে পরিচিত। তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে গানের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে তার। তার কাছ থেকে গান শিখে অনেক ভালো শিল্পী তৈরি হয়েছে, যারা কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সফলতা দেখাচ্ছে।
জীবন সংগ্রামের গল্প জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সুজন রহমান বলেন, "আমাদের জন্য পড়ালেখার সুযোগ খুব কম। নিজে শুনে শুনে সেটা অন্ধদের অক্ষরে আমাদের লিখতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, শিল্পী হওয়ার ক্ষেত্রে আমাকে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। পরিবার ও বন্ধুদের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে। ''
তিনি আরও বলেন, ''ঝড়, বৃষ্টি, শীত ও তাপদাহসহ নানা প্রতিকূলতাকে পরাজিত করেই আজ সফলতা পেয়েছি। চাকরি করছি, খুব ভালো আছি। অন্য সহযোদ্ধাদের বলব, তোমরা হতাশ হবে না, চেষ্টা করো, সফলতা পাবে।''
শাপলা খাতুন বলেন, "আমি শারীরিকভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন। অনেক বাধা অতিক্রম করে বিএ পাস করেছি। আমি ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আগে আমাদের নাম ধরে কেউ ডাকত না। মানুষ এখন আমাদের নাম ধরে ডাকে ও ভালোবাসে।"
হালিম মিয়া বলেন, "আগে আমাদের 'কানা' বলে ডাকত মানুষ। খুব কষ্ট পেতাম। আমাদের কোনো মতামতের দাম ছিল না গ্রামে। এখন আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। সবাই আমাদের কথা এখন শোনে। "
কুষ্টিয়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রোকসানা পারভিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ''জেলার শারীরিকভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সকলের তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকি আমরা। তারা চারজন প্রতিবন্ধী হয়েও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। "
তিনি আরও বলেন, ''তিনজন পড়ালেখা করে আজ খুব ভালো আছে। সাধারণ মানুষের মতো তারা চাকরি ও কাজ করছে; কারো দয়া নিয়ে বেঁচে নেই।"
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাপস কুমার সরকার বলেন, ‘‘পরিবারে কোনো সদস্য শারীরিক প্রতিবন্ধী, নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয়ে ছেলে-মেয়েরা প্রতিবন্ধী হতে পারে। প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দিলে স্বাভাবিক মানুষের মতো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’’
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, ‘‘শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু চার ছেলে-মেয়ে নয়, জেলার সব প্রতিবন্ধী যেন স্বাবলম্বী হতে পারে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সে ব্যবস্থা করা হবে।’’