স্বপ্নেরা পিষ্ট হয় গাড়ির চাকায়
পৃথিবীর পুরোনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে
যেতে হয়…
চিত্রা পাড়ের মেয়ে 'রেশমা নাহার রত্না' একাধারে পর্বতারোহী, দৌড়বিদ, সাইক্লিস্ট ও শিক্ষক । গত বছরেই সামিট করেছেন লাদাখের দুটি ২০,০০০ ফুটের বেশি উচ্চতার পর্বত। আজ সকালে (৭ই অগাস্ট) সাইকেল চালিয়ে হাতিরঝিলে অনুশীলন শেষে বাড়ি ফেরার পথে চন্দ্রিমা উদ্যান সংলগ্ন লেক রোডে দ্রুতগামী গাড়ীর ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।
প্রথম দেখা হয়েছিল ১৮ পাঠচক্রের উদ্বোধনী ক্লাসে, গিটার বাজিয়ে মাত করে দিয়েছিলেন। তারপর প্রায় দেখা হত বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে, পাঠচক্রের ক্লাসে, ক্লাস শেষের আড্ডায়! আমি দার্জিলিং থেকে ফিরে আসার পর একদিন স্যার ক্লাসে আমায় বললেন তুমিই তো সাইকেলে দার্জিলিং গিয়েছিলে তাইনা? তোমার গল্প শুনবো একদিন। সেদিন ক্লাস শেষে রত্না আপু এসে আমায় কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরেছিলেন! সেই প্রথম তার সাথে ঘনিষ্ঠতা। এরপর কত গল্প আড্ডায় জমে গেছে আসর।
রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক ও স্নায়কোত্তর ডিগ্রি লাভ করে বর্তমানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন তিনি।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের পাহাড় কেওক্রাডংয়ের চূড়া স্পর্শ করার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল রত্নার অভিযান। এরপর আর থেমে থাকেননি। সাদা পাহাড়ের প্রতি অদম্য টানে ওই বছর মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশিতে অবস্থিত পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টিইনিয়ারিংয়ে যান। কিন্তু অ্যাডভ্যান্স বেজক্যাম্পে যাওয়ার পর তার পায়ে ফ্র্যাকচার হয়। দেশে ফেরার পর সুস্থ হতে লেগে যায় দীর্ঘদিন। পরবর্তী সময়ে নিজ উদ্যোগে সফলভাবে পর্বতারোহণের মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর আফ্রিকার মাউন্ট কেনিয়া পর্বতে লাল সবুজের পতাকা উড়ান।
গত বছর পর্বত আরোহনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে মাত্র ৬ দিনের ব্যবধানে দুটি ৬,০০০ মিটার (২০,০০০ ফুট) এর বেশি উঁচু পর্বত সামিট করেন। ভারতের লাদাখের এ দুটি পর্বত হচ্ছে স্তোক খাংরি (৬১৫৩ মিটার) ও কাং ইয়াৎজে ২ (৬,২৫০ মিটার)।
এ ছাড়াও তিনি স্বপ্ন দেখতেন একদিন এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখার।
বই পড়ার প্রতি ছিল তার অদম্য ঝোক। ভালবাসতেন গান, আবৃত্তি, আর সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াতে। লকডাউনের আগেও আমাদের শেষ নিসর্গ পরিচিতি ক্লাসে রমনা পার্কে আশোক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সবাইকে নিয়ে গাইলেন
"তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার
অকারণের সুখে।"
আর আজ সব কিছুর ইতি ঘটলো কি মর্মান্তিক ভাবে! দুর্গম পর্বত শিখর জয় করে আসলেও হাতিরঝিল থেকে মিরপুর অব্দি পৌঁছাতে পারলেন না, ঘাতক চালক তার চাকার তলায় পিষ্ট করে গেল এই বহুমাত্রিক প্রতিভাবান প্রাণ টাকে।
রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় শুক্রবার সকালে গাড়িচাপায় প্রাণ হারান তিনি। দেশ-বিদেশে বেশ কয়েকটি হাফ ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন। এবার নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন ফুল ম্যারাথনের জন্য, সেই লক্ষে প্রতিদিন হাতিরঝিল গিয়ে দৌড়াতেন। সেদিনও দৌড় শেষে সাইকেলে ফেরার পথে সংসদ ভবন এলাকার চন্দ্রিমা উদ্যানের লেক রোডে একটি মাইক্রোবাস তাকে চাপা দেয়। এতে তার মাথায় আঘাত লাগে। পথচারীরা উদ্ধার করে তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অপার সম্ভাবনাময়ী মানুষটার জীবন থেমে গেল এখানেই।