‘বিশ্ববাসী যেন উহানের ভুল থেকে শেখে’
গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান প্রদেশে দেখা দেয় এক নতুন ভাইরাস- করোনা ভাইরাস। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে পুর বিশ্বে। এপর্যন্ত বিশ্বের ২০৫টির দেশ ও অঞ্চলের প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছেন। ভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেশগুলোতে লকডাউন ঘোষনা করা হয়েছে, সমস্ত মানুষকে পাঠানো হয়েছে হোম কোয়ারেন্টিনে।
আর এদিকে টানা তিন মাসের লকডাউন থেকে অবশেষে মুক্ত হয়েছে উহানের ১১ মিলিয়ন বাসিন্দা। প্রত্যেকেই যার যার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
তারা বলছেন, এমন কিছু সতর্কতার কথা যাতে করে আর কাউকে এরকম করে কষ্ট না করতে হয়, যাতে উহানের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে বাকিরাও।
অনলাইনে কয়েকজন উহানবাসীর সাক্ষাতকার নেয় বিবিসি। তাদের কাছ থেকেই জানা গেল গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপদেশ আর সুস্থ থাকার টিপস।
তারা জানালেন, এই তিন মাসের অভিজ্ঞতা খুব ভয়ানক, কিন্তু শিখিয়ে গেছে অনেক কিছু। লকডাউনে থাকাটাকে ত্যাগ না বলে বরং মহামারি রোধে একটি জরুরি কাজ বলে ধরে নেওয়া উচিত।
যারা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ঘরে আছেন, হোম কোয়ারেন্টিন মেনে চলছেন- তারাও কিন্তু প্রত্যেকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া আটকাচ্ছেন।
প্রথম প্রথম অনেকেই বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি, লকডাউনের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেননি তারা। কিন্তু এরপর দেখা গেল খাবারের সঙ্কট। তখন ভয় পেয়ে গেলেন অনেকেই। জরুরি চিকিৎসা সরবরাহের জন্য অনলাইনে সাহায্য চাওয়া শুরু করেন চিকিৎসকরা। রোগীদের জন্য ছিল না পর্যাপ্ত বেড, চিকিৎসার সুবিধা।
এরপর একসময় জরুরি ত্রাণ সরবরাহ আসতে শুরু করে। আসেন চিকিৎসকরাও। এরপর আস্তে আস্তে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করে।
লকডাউনের স্মৃতি
এই টানা তিন মাসের লকডাউনে তাদের সবচাইতে আনন্দের স্মৃতি কোনটা জিজ্ঞেস করা হলে তারা বেশ মজার অভিজ্ঞতার কথা জানালেন।
কেউ জানান ৩০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ডাম্পলিং বানিয়েছেন তার বাবা। 'ময়দা আর মাংস কিনে এনেছিলাম আমরা। তাই দিয়ে ছোট ছোট ডামপ্লিং বানান বাবা। শেষবার বাবাকে ডামপ্লিং বানাতে দেখেছিলাম, তখন আমি কিন্ডারগার্টেনে পড়ি।'
আবার একজন জানালেন, 'আমার বয়ফ্রেন্ড আমার জন্য অসাধারণ এক ভ্যালেন্টাইন ডে'র আয়োজন করে। আমরা একসঙ্গে ভ্যালেন্টাইন কাটিয়েছি। এর পরপরই ছিল আমার জন্মদিন। ও আমার জন্মদিনেও এত সুন্দর আয়োজন করেছে, কেক আর ফুল নিয়ে এসেছে, বাজার থেকে মাংস কিনে এনে রান্না করেছে আমার জন্য- এই স্মৃতি সারাজীবন মনে থাকবে আমার।'
মুসলিম এক বাসিন্দা জানালেন, 'প্যাকেটজাত হালাল খাবার পাওয়া বেশ মুশকিল। তবে অবশেষে আমরা বেশ কয়েক প্যাকেট হালাল ডামপ্লিং জোগাড় করতে পেরেছি। আমারই এক প্রতিবেশি সেগুলো দিয়ে গেছেন আমার বাসায়। ডামপ্লিং এর বাক্সগুলো অনেক ভারি ছিল। তবুও এত কষ্ট করে তিনি সেগুলো দিয়ে গেছেন, এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। আমি ওনার কাছে কৃতজ্ঞ।'
লকডাউনে সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতে উহানবাসীর টিপস
১। পরিবারকে ফোন করুন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। এতে আপনি যেমন শান্তি পাবেন, ওনারাও স্বস্তি পাবেন আপনি সুস্থ আছেন জেনে।
২। নিজের সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটান, তাকে সময় দিন। নিজেদের উদ্বেগগুলো ভাগ করে নিন।
৩। এখনকার এই ব্যস্ত দুনিয়ায় টানা কয়েকমাস ২৪ ঘন্টা সঙ্গীর সঙ্গে কাটাতে পারছেন, এই সুযোগ আর কখনো পাবেন না। এসময় নিজেদের ভুলগুলো অনেক বেশি নজরে পড়বে। তাই নিজেদের বোঝাপড়াটা ঝালিয়ে নিন, স্মৃতি জমা করে রাখুন।
৪। যদি হোম অফিস বা বাড়ি থেকে কাজ করেন, তাহলে অবশ্যই নিজের ব্যক্তিগত জীবন আর কাজের মধ্যে পার্থক্য রাখুন। বাড়িতে বসে কাজ করলেও প্রফেশনালিজমটা রাখতে হবে।
৫। আগে যা করার সময় পাননি, এখন সেই কাজগুলো করার উপযুক্ত সময়। বই পড়ুন, নতুন কিছু শিখতে পারেন, টিভিতে নিজের পছন্দের শো বা সিনেমা দেখুন, ভিডিও গেম খেলতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- নিজের পরিবারকে সময় দিন।
বিশ্বের জন্য উহানবাসীর উপদেশ
উহানের মতো, পুরো বিশ্বেই এখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাদের এই অনুভূতিটা আমরা বুঝি। দুশ্চিন্তা, হতাশা, রাগ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। ভেঙ্গে পড়বেন না। লকডাউন আপনার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়, বরং ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে এবং আপনাকে বাঁচাতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
আমরা আশা করি, বিশ্ববাসী উহানের ভুল থেকে শিখবে, নিজেরা কম ভুল করবে। এই পৃথিবী সেদিন ভাইরাসের কবল থেকে মুক্ত হবে, সেদিন আমরা সবাই মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেব, আবার মিলিত হবো। প্রিয়জনদের সঙ্গে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত লকডাউন মেনে চলতেই হবে।