যেভাবে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করেছিল ‘জিন অ্যান্ড টনিক’
উপমহাদেশের জনপ্রিয় পানীয়গুলোর মধ্যে জিন আর টনিক অন্যতম। বেশ কয়েক বছর ধরেই ককটেল প্রেমীরা আবারও একে টেনে তুলেছে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। দাদার আমলের কেবিনেট থেকে নামানো জিন-টনিক পরিবেশিত হচ্ছে পার্টির গ্লাসে গ্লাসে। ১৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক জিন ও টনিক দিবস। নতুন প্রজন্মের ককটেলপ্রেমীদের অনেকেই হয়তো জানেন না জিন-টনিকের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের ইতিহাস। তাই উদযাপনের আগে জেনে নেওয়া যাক জিন-টনিক কীভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে পোক্ত করে টানা দু'শ বছর উপমহাদেশের মানুষকে পরাভূত করে রাখার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।
জিনের উদ্ভাবন কে করেছিল?
জিন আদতে বেরি জাতীয় জুনিবার ফলের স্বাদযুক্ত ডিস্টিল্ড অ্যালকোহল ড্রিংক। কিন্তু বেরি ফলের স্বাদ থেকে যে এত দারুণ কিছু হতে পারে সেটা কে আবিষ্কার করল? অনেকে বলে মধ্যযুগ থেকেই জিনের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে ১৭ শতকের দিকে নেদারল্যান্ডসে জিন একরকম জাতীয় পানীয় হয়ে ওঠে।
তবে তখনও একে জিন নামে ডাকা হতো না। ডাচরা একে জেনিভার কিংবা জুনিপার নামেই ডাকত। জেনিভার নামটা অবশ্য সৈন্যরা ব্যবহার করত। বড় বড় দু-তিন পানপাত্র ভর্তি জেনিভার খেয়ে যুদ্ধে যেত সৈন্যরা। জিন পানের এই বিশেষ কেতা তখন বীরত্বসূচক ছিল। এখান থেকেই 'ডাচ কারেজ' কথাটির উদ্ভব।
১৭ শতকের শেষ থেকে শুরু করে ১৮ শতকের শুরুর দিকে অবশ্য জিন গরীব মানুষের সস্তা পানীয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এমনকি জিনকে সমাজের সামগ্রিক অধঃপতনের জন্যও দায়ী করা শুরু হয়। এর পরিবর্তে হালকা ব্রিটিশ এল বিয়ার খাওয়া ভালো ছিল বলে প্রচার লাভ করে।
ধীরে ধীরে অবশ্য জিন সামাজিক পদোন্নতি লাভ করে অভিজাতদের ঘরে প্রবেশ করে নিজের অবস্থান পোক্ত করে।
টনিক ওয়াটারের জন্ম কীভাবে?
জিনের সবচেয়ে ভালো সঙ্গী টনিক ওয়াটার। তখনও অবশ্য এই হিট জুটির মিল হয়নি। তবে কাকতালীয়ভাবে এই টনিক ওয়াটারের জন্মও সেই একই সময় যখন ডাচরা মারামারি কাটাকুটি করে জিন পানে ব্যস্ত ছিল।
১৭ শতকে স্প্যানিশরা আবিষ্কার করে বর্তমান পেরুর এক আদিবাসী গোষ্ঠী সব ধরনের জ্বরের দাওয়াই হিসেবে সিনচোনা বা সিনকোনা গাছের ছাল-বাকল ব্যবহার করে। অল্প সময়েই পুরো ইউরোপ জুড়েই তা ম্যালেরিয়ায় মহৌষুধ হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারা এটাও আবিষ্কার করে এই বাকল শুধু ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবেই নয়, প্রতিষেধক হিসেবেও দারুণভাবে কাজ করে। সিনকোনার বাকলের যে উপাদানটি জাদুর মতো কাজ করছিল তা হলো কুইনাইন। আর এভাবেই কুইনাইন হয়ে ওঠে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা পূরণের অন্যতম হাতিয়ার।
১৮৪০-এর দশকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা যখন তুঙ্গে তখন ভারতে নিয়োগপ্রাপ্ত সৈন্য ও অফিসারদের প্রতিষেধক হিসেবে বছরে প্রায় ৭০০ টন সিনকোনা বাকল ব্যবহৃত হতো।
ভারতের প্রান্তিক সব অঞ্চল দখল ও শাসন করতে যখন ব্রিটিশ সেনাদের পাঠানো হতো তখন যেন ভ্যাপসা-গরমে তারা অসুখ বাঁধিয়ে না বসে তা নিশ্চিত করতে প্রতিদিনই পান করতে হতো কুইনাইন। কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই। এই কুইনাইন ভীষণ তেতো।
কুইনাইনের উপযোগিতা কারও অজানা ছিল না। তারপরও সৈন্যরা তেতো স্বাদ থেকে বাঁচতে প্রায়ই নিয়মিত সেবন করাটা এড়িয়ে যেত। সেই সময় স্বউদ্যোগী হয়ে কয়েকজন আবিষ্কার করল সোডা পানি আর চিনির সঙ্গে মিশিয়ে কুইনাইন পান করাটা খুব একটা মন্দ না। আর এভাবেই জন্ম নিল টনিক ওয়াটার।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্ব কায়েমে জিন ও টনিক কীভাবে সাহায্য করেছিল?
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুকুটে ভারত ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্ন। ভারতবর্ষের গুরুত্ব এতটাই ছিল যে খোদ রানি ভিক্টোরিয়াই তার উপাধি হিসেবে ভারত সম্রাজ্ঞী খেতাব যোগ করেন। রাজা ষষ্ঠ জর্জ পর্যন্ত তাঁর উত্তরসূরীরা এই খেতাব বহন করে গেছেন।
এটা পরিষ্কার ছিল যে ভারতবর্ষের শাসনভার ধরে রাখতে হলে ঠাণ্ডা মাথার দক্ষ কিছু মানুষ দরকার। আর তাই ব্রিটিশরা তাদের সবচেয়ে সেরা প্রশাসকদের পাঠাতো ভারতে। এই ব্রিটিশ অফিসারদের সুস্থ রাখতে সবচেয়ে জরুরি জিনিসটি টনিক ওয়াটার।
কার মাথায় প্রথম অ্যালকোহলের সঙ্গে কুইনাইন পানের আইডিয়া এসেছিল তা জানা না থাকলেও এটা নিশ্চিত কোনো শৌখিন মদিরাপ্রেমীই এর উদ্ভাবন করেছেন। টনিক ওয়াটারের সঙ্গে কুইনাইনকে ওষুধ হিসেবে না খেয়ে সেটাকে রীতিমতো আয়োজন করে জিনের সঙ্গে খাওয়া শুরু হলো। রাতের খাবার সেড়ে রেশনে পাওয়া জিনের সঙ্গে টনিক ওয়াটার পান নিত্যদিনের আচারে পরিণত হলো।
আর এভাবেই মিলন ঘটল জিন আর টনিক ওয়াটারের।
সাম্রাজ্যজয়ী এই ককটেইল পান শুধু শৌখিন আচারই ছিল না, এই জিন আর টনিকই ভারতে আসা লাখো ব্রিটিশের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করেছিল। সেই সঙ্গে ভারতেও তারা নিজেদের অবস্থান শক্ত করার সুযোগ পেয়েছিল। এক কথায় বললে ইতিহাস বদলে দিয়েছিল এই জিন আর টনিক ওয়াটার।
পরের ঘটনা সবার জানা। ব্রিটিশদের সেই শক্ত মুঠো থেকে ভারতবর্ষকে ছাড়িয়ে আনতে দুটো বিশ্বযুদ্ধ, লাখো শহীদের আত্মত্যাগ আর কয়েক হাজার ঘণ্টার বিরতিহীন সমঝোতা আলোচনার প্রয়োজন পড়েছিল। এরপরই তাদের তাড়ানো সম্ভব হলো।
সাম্রাজ্যবাদী সময়টা আমরা পার করে এসেছি বটে। তবে আজও রয়ে গেছে জিন আর টনিক ওয়াটার। যুগ বদলালেও আবারও নতুন করে দম্ভের সঙ্গেই নিজেদের রাজত্ব বিস্তার করে চলেছে এই ককটেল যুগল।
- মানিকন্ট্রোল থেকে অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা