'মৃত' নদী বুড়িগঙ্গার তীরে থাকা মানুষের জীবন!
মাত্র দুই দশক আগেও নুরুল ইসলাম বুড়িগঙ্গা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ঐ সময় রাজধানী ঢাকার প্রাণ হিসেবে পরিচিত ছিল বুড়িগঙ্গা।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কলকারখানা ও বাসাবাড়ির মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে বুড়িগঙ্গা অনেকটা 'মৃত' নদীতে পরিণত হয়েছে। একসময়ে অহরহ মাছ ধরতে দেখা গেলেও বর্তমানে বুড়িগঙ্গায় মাছ নেই বললেই চলে। তাই জেলে নুরুল এখন রাস্তায় ছোট গাড়িতে খাবার বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। খবর রয়টার্সের।
৭০ বছর বয়সী নুরুলের পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে বুড়িগঙ্গার তীরে বসবাস করে আসছে। সোনালি অতীতের কথা স্মরণ করতে যেয়ে তিনি বলেন, "২০ বছর আগে নদীটির অবস্থা ভালোই ছিল। বেশ প্রাণবন্ত যাকে বলে।"
বুড়িগঙ্গা সম্পর্কে নুরুল আরও বলেন, "আমরা নদীটিতে প্রতিনিয়ত গোসল করতাম। অনেক মাছও পাওয়া যেত। আমাদের মধ্যে অনেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।"
দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গায় অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, বর্তমানে এর পানি কুচকুচে কালো রং ধারণ করেছে। বর্ষাকালে যদিও নদীটির পানির অবস্থা একটু ভালো হয়, তবে বছরের অন্য সময়গুলোতে এর পানি থেকে সবসময়ই বাজে দুর্গন্ধ আসতে থাকে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি; যার মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ রাজধানী ঢাকায় বসবাস করে। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে প্রায় ২২০টি ছোট-বড় নদী। দেশের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশের জীবন জীবিকা নদীকেন্দ্রিক।
চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তবে এ গৌরবময় অর্জনের মাঝেও রয়েছে কিছু অপ্রাপ্তি।
পরিবেশবিদদের মতে, দেশে ক্রমবর্ধমান তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য নির্মিত হচ্ছে নতুন নতুন ফ্যাক্টরি। আর এসব ফ্যাক্টরির বর্জ্য থেকে হচ্ছে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ।
পোশাক তৈরিতে করা ডায়িং ও ব্যবহৃত ক্যামিকেলের বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থাই পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার প্রতিদিন মানুষের ব্যবহৃত পলিথিন ও প্লাস্টিকের অজস্র বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। এতে করে নদী সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, এর পানি হয়ে যাচ্ছে ব্যবহারের অনুপযোগী।
৪৫ বছর বয়সী বুড়িগঙ্গার নৌকাচালক সিদ্দিক হাওলাদারের নৌকাই নিজের ঘর-বাড়ি। তিনি বলেন, "নদীর পানিতে এখন যারা গোসল করেন, তাদের অনেকেই স্কার্ভিসহ নানা চর্ম রোগে আক্রান্ত হন। অনেক সময় আমাদের চোখে জ্বালা-পোড়া ও চুলকানিও হয়।"
১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার দেশের সকল কল-কারখানার জন্য বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি তৈরি ও ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ নিয়ম মানা হচ্ছে না।
এ সম্পর্কে পরিবেশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদ খান পাটোয়ারি বলেন, "ইটিপি মানা হচ্ছে কি-না, সেটার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত তদারকি করা হয়। তবে লোকবল সংকটের কারণে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা সম্ভব হয় না।"
অবশ্য বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস এন্ড এক্সপোর্টারস এসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর পক্ষ থেকে সকল টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে ইটিপি থাকার কথা বলা হয়েছে।
বিজিএমইএ এর কর্মকর্তা শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, "প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে ইটিপির ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এটি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফ্যাক্টরিগুলোকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হয়।"
সম্প্রতি রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের এক সার্ভেতে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিতে দূষণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে কলকারখানার বর্জ্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের শরিফ জামিল বলেন, "একসময়ের দূষণমুক্ত ও খরস্রোতা বুড়িগঙ্গা কল-কারখানা ও মানবসৃষ্ট বর্জ্যের কারণে প্রায় মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এখানে কোনো মাছ কিংবা জলজ জীবের অস্তিত্ব থাকে না। আমরা একে জৈবিকভাবে মৃত অবস্থা বলি।"