সংগীত কি অনিদ্রা কমাতে পারে? নির্ভার ঘুমের জন্য ঔষধের বিকল্প খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা
জন্ম থেকেই আমাদের ঘুমের সাথে সংগীতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মায়েরা শিশুদের ঘুম পাড়াতে গান শোনান। আবার বড়রাও অনেক সময় ঘুমানোর আগে রিলাক্সিং মিউজিক শুনে থাকেন। বহুদিন ধরেই গবেষকেরা স্লিপ ডিসঅর্ডার থেরাপির জন্য সংগীতের ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন।
বার্সেলোনার পম্পেউ ফাব্রা বিশ্ববিদ্যালয় (ইউপিএফ) এমনই একটি প্রকল্পে কাজ করছে। লুলাবাইট গবেষণা প্রকল্প নামক এ গবেষণায় দেখা হচ্ছে কীভাবে ঘুমানোর আগ মুহূর্তে এবং ঘুমানোর সময় সংগীত আমাদের মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও কোন ধরনের সংগীত আমাদের ঘুমের জন্য উপকারী হতে পারে সেটাও জানার চেষ্টা করছেন গবেষকেরা।
ঘুম এবং সংগীতের মধ্যে সম্পর্ক দেখার ক্ষেত্রে গবেষকেরা বেশ কয়েকটি দিক থেকে বিবেচনা করছেন। এর মধ্যে ব্যক্তিভেদে সংগীতের প্রভাব কেমন এবং ঘুমাতে ঔষধের বিকল্প হিসেবে কী করা যেতে পারে সেটিও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
গবেষণা প্রকল্পে ইউপিএফ-এর প্রধান গবেষক সেরহি হোরদা বলেন, "কেবল সংগীতের মাধ্যমে ঘুমাতে সাহায্য করাই এই গবেষণার উদ্দেশ্য নয়। একইসাথে কীভাবে ব্যক্তির ঘুমের মান আরও বাড়ানো যায় এবং শরীরের ক্লান্তি আরও ভালোভাবে দূর করা যায়, সেটিও এ গবেষণার উদ্দেশ্য।"
লুলাবাইট প্রকল্পে মিউজিকোলজি এবং নিউরোলজির সাথে যুক্ত আছে মনোবিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স এবং ডেটা সায়েন্সের মতো বিষয়। গবেষক হোরদা জানান, ঘুম এবং সংগীত নিয়ে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের একসাথে কাজ করার ঘটনা এটাই প্রথম। এছাড়াও এই প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্কসহ বেশ কয়েকটি দেশের ৯টি প্রতিষ্ঠান।
২০২৩ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৬ সালে। হরাইজন ইউরোপ প্রোগ্রাম এই প্রকল্পের জন্য খরচ করছে আড়াই মিলিয়ন ইউরো।
প্রকল্পে ইউপিএফ-এর গবেষকদের কাজ হবে ঘুমন্ত অবস্থায় রোগীদের মস্তিষ্কের তথ্যগুলোকে সংগীত বা শব্দে রূপান্তর করা। হোরদা জানান, মস্তিষ্ক থেকে পাওয়া সংকেত থেকে তারা 'ইলেকট্রনিক মিউজিক'-এর মতো সিনথেটিক সাউন্ড তৈরি করবেন। একজন ব্যক্তির মস্তিষ্কের কার্যক্রম অনুযায়ী এই শব্দসংকেত তৈরি হবে, যেটি ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য কাজে লাগানো হবে।
স্প্যানিশ নিউরোলজি সোসাইটির স্লিপ স্টাডি রিসার্চ গ্রুপের কো-অর্ডিনেটর এনা ফারনান্দেজ মনে করেন, ঘুম ও সংগীতের মধ্যকার সম্পর্ক ভালোভাবে বুঝতে পারলে সেটি অনিদ্রায় ভুগতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য উপকারী হবে।
এনা বলেন, "এর ফলে খুবই কম খরচে চিকিৎসাটি করা যাবে এবং এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ ভাগ স্প্যানিশ নাগরিক ক্ষণস্থায়ী ইনসমনিয়ায় (অনিদ্রারোগ) ভোগেন। আর প্রায় চার লাখ মানুষ ক্রনিক ইনসমনিয়ায় ভোগেন।"
২০২১ সালে বিহেভিওরাল স্লিপ মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, করোনারি ও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে সংগীত খুবই কার্যকর। একইসাথে এর ব্যবহারে বয়স্ক ব্যক্তিদের ঘুমের মানও অনেক উন্নত হয়।
গবেষণা মতে, প্রায় তিন সপ্তাহ পর ঘুমের ক্ষেত্রে সংগীতের সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যায়। যদিও এ কার্যকারিতা যে অনেক উপকারী, বিষয়টি এমন নয়। তবে এটি নিঃসন্দেহে ঘুমের মান, গভীরতাকে সমৃদ্ধ করে।
অন্যদিকে একই বছরে জার্নাল অভ দ্য আমেরিকান জেরিয়াট্রিক্স সোসাইটি-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৪০ থেকে ৭০ ভাগ বয়স্ক মানুষ ঘুম নিয়ে সমস্যায় ভোগেন এবং এদের মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ ইনসমনিয়ায় ভোগেন।
গবেষণা অনুযায়ী, ঘুমানোর আগে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সংগীতের থেরাপি নেওয়ার ফলে ব্যক্তির ঘুম ভালো হয়। একইসাথে এর ফলে দেহের রক্তচাপ ও হার্টবিট কমে আসে। ফলে ব্যক্তির সারাদিনের দুশ্চিন্তা এবং চাপ হ্রাস পায়।
এনা ফারনান্দেজ বলেন, "শব্দের একটা 'মাস্কিং ইফেক্ট' রয়েছে। কিছু কিছু অনিদ্রার ক্ষেত্রে বাহ্যিক প্রভাবকগুলো বেশ সমস্যা তৈরি করে। এর ফলে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। এক্ষেত্রে সংগীতের মাধ্যমে 'মাস্ক নয়েজ' তৈরি করে প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রতিরোধ করা যেতে পারে।"
ফারনান্দেজের মতে, রাতের বেলা ঘুমানোর সময় সংগীত শুনলে মানসিক প্রশান্তি ও বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা দূর করে থাকে।
তবে কিছু গবেষণায় আবার সঙ্গীত ও ঘুমের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুই বছর আগে টেক্সাসের বেলর ইউনিভার্সিটির প্রকাশিত একটি গবেষণা মতে, ঘুমানোর সময় সংগীত শোনার ফলে সেটি মাথায় বারবার চলতে পারে। এক্ষেত্রে অস্বস্তিকর ঘুমের সম্ভবনা ছয় গুণ বেড়ে যেতে পারে।
অনিদ্রার সমাধানে অনেক সময় ব্যক্তি ঔষধ নিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে দিনের বেলা ঘুম ঘুম ভাব থেকে শুরু করে স্মৃতিশক্তি হ্রাসের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
এ বিষয়ে হোরদা বলেন, "ঘুমানোর জন্য ঔষধ ব্যবহারে ঘুম আসে ঠিকই। কিন্তু সেটা খুব বাজেভাবে। কেননা ঔষুধের ফলে আসা ঘুম কৃত্রিম ও কম কার্যকর।"
তাই লুলাবাইট প্রজেক্ট মূলত ঘুমানোর ক্ষেত্রে ঔষধের বিকল্প খুঁজে বের করা চেষ্টা করছে যেন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই রাতে ভালোভাবে ঘুমানো যায়।