টেপ টেনিস ক্রিকেট: শৈশবে ফিরে যাওয়ার ‘ইয়র্কার’
সদ্য সমাপ্ত হয়েছে ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এই আসরের ম্যাচগুলো দেখা এবং তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ যেন আমাকে শৈশবের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। তখন এলাকার অলিতে-গলিতে পরম আনন্দে খেলা হতো টেপ টেনিস ক্রিকেট।
বাচ্চারা রাস্তায় খেলার সময় সে এক জাদুকরী মুহূর্ত তৈরি হতো। বিশেষ করে বিশ্বকাপের মৌসুমে যেন সেই উন্মাদনা বেড়ে যেত বহুগুণে। অলিতে-গলিতে ব্যাটের প্রতিটি সুইং যেন বিশ্বকাপের মুহূর্তের মতোই আনন্দদায়ক হয়ে উঠত। প্রতিটি উইকেট এক মহামূল্যবান জয়ের মতো মনে হতো।
গায়ে থাকত প্রিয় দলের বহুল আকাঙ্ক্ষিত জার্সি। হাতে থাকত প্রিয় ক্রিকেটারের ব্যবহার করা ব্যাটের রেপ্লিকা। আমাদের কাছে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ক্রিকেটিং অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ; যা সাদামাটা রাস্তাগুলোকেও যেন এক কিংবদন্তির আখড়ায় পরিণত করতো।
রাস্তায় খেলা আমাদের প্রতিটা শটের পেছনে যেন শচীন টেন্ডুলকার, ম্যাথু হেইডেন কিংবা অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের মতো কিংবদন্তিরা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেন। আমাদের গলিগুলো যেন একটা মিনি স্টেডিয়ামে পরিণত হয়। ছোট গলিতেই যে-কেউ একটা বড় বিশ্বকাপ ম্যাচের উত্তেজনা অনুভব করতে পারবেন।
গলির ক্রিকেটে ছিল নিজস্ব আইন। নিজেদের বানানো সেই আইনগুলোই ছিল আমাদের ক্রিকেট জগতের নিয়মনীতি। তবে সেই আইনগুলো যে অপরিবর্তনীয় ছিল, সেটাও নয়। বরং প্রতিপক্ষের সাথে ক্রমাগত সমঝোতা ও অভিযোজনের ফলে আইনগুলো পরিবর্তনও হয়।
আমাদের ক্রিকেট খেলার গলিগুলো ছিল বেশ সরু। আর এই সংকীর্ণ জায়গায় খেলার মাধ্যমেই যেন আমরা কিছু অনন্য দক্ষতা অর্জন করেছি। একইসাথে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল নিয়মগুগুলো যেন খেলাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
যেমন, ব্যাটসম্যান শট করার পর যদি বল দেয়ালে লাগে, তবে আমরা সেটিকে চার রান হিসেবে বিবেচনা করি। আর অন্য শটে দুই কিংবা তিন রান ধরা হতো। বল যদি একটু বেশি উচ্চতায় স্পর্শ করতো, তবে সেটি ছয় নয়, বরং আউট হিসেবে গণ্য হতো।
এছাড়াও, খেলাটিকে কেন্দ্র করে বন্ধুদের মধ্যে বাজি ধরার বিষয়টিও প্রচলিত ছিল। এক্ষেত্রে চুক্তিটা বেশ ভালো, হেরে যাওয়া দলকে সবাইকে এক বোতল কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়াতে হতো। এটি খেলায় আলাদা এক উত্তেজনা যোগ করত।
যা-ই হোক, টেপ টেনিস ক্রিকেট বলে অনন্য একটা ব্যাপার ছিল অনুকরণ করা। বোলিং করার ক্ষেত্রে উইকেট নেওয়াটাই মুখ্য বিষয় ছিল না। বরং একইসাথে উইকেট পাওয়ার পর পছন্দের ক্রিকেটারকে অনুকরণ করার একটা রীতিও ছিল।
শ্রীলঙ্কার স্পিন জাদুকর মুরালিধরনের শারীরিক ও চোখের ভঙ্গি কিংবা শেন ওয়ার্নের লেগ ব্রেক বলের অনুকরণ করা যেন এক বাড়তি মাত্রা। কেউবা আবার ওয়াসিম আকরামের মতো করে সরু গলিতেই সুইং বল করার চেষ্টা করতেন।
গলির ক্রিকেটের প্রতিটি বলের ডেলিভারি যেন এক একটি শিল্প। প্রতিটি পারফরম্যান্স যেন একটি মঞ্চনাটক।
খেলায় এত সব মজার মধ্যেও একটা ভয়ও কাজ করত। যদি বল ভুল জায়গায় শট করা হয়ম তবে সেটি হয়তো প্রতিবেশীর জানালায় আঘাত হানত। এতে করে আমাদের আনন্দের মুহূর্ত যেন এক গ্লাস ভাঙার আওয়াজে পরিণত হয়। তবে এটিও ছিল খেলার অন্যতম একটা অংশ, যেটি খেলাকে আরও উত্তেজনাকর করেছে। মজার খেলার মাঝে একটু শঙ্কার উপাদান যোগ করত।
অবশেষে সূর্য অস্ত নামার সাথে সাথে রাস্তাগুলোটে একটা নিস্তব্ধটা নেমে আসে। তখন আমাদের টেপ টেনিস ক্রিকেট খেলা ওই দিনের মতো শেষ হতো। শৈশব পেরিয়ে এখন আমরা যারা বড় হয়েছি, তারা প্রায় সবাই-ই টেপ টেনিসের সেই স্মরণীয় দিনগুলোর কথা হাসিমুখে স্মরণ করি।
টেপ টেনিস খেলার মুহূর্তটা ছিল সহজ, সরল, জাদুকরী। খেলাটি আমাদের একদিকে নতুন বন্ধু বানানো, নতুন করে স্বপ্ন দেখা এবং নিজেদের মধ্যে শিশুসুলভ আচরণ উপভোগ করার মতো বিষয় শিখিয়েছে।
চাইলেও এখন হয়তো আগের মতো গলির ক্রিকেটকে আমরা উপভোগ করতে পারব না। তবুও টেপ টেনিস ক্রিকেটের স্পিরিট প্রজন্মের পর প্রজন্মের বয়ে চলবে।