৫৫ কদমতলা: গুলশান লেকের পাড়ে যেভাবে সবুজায়ন ঘটছে!
মনে হয় ঢাকার শীতলতম সকালগুলোর একটি ছিল সেদিন। পকেটের ভিতরে আঙুল ঢোকাতে গেলাম, সঙ্গে সঙ্গে আমার জ্যাকেটের ভেতর হিমশীতল বাতাস ঢুকে গেল।
গুলশান লেকের কাছে গাছের চূড়াগুলো কুয়াশার পাতলা চাদরে ঢাকা থাকলেও, আমার ঘড়িতে দেখা যাচ্ছে প্রায় সকাল ৯টা বাজে। যদিও গুলশান-২ এর ৫৫ নম্বর রোডের বাসিন্দাদের মতো সূর্য তখনও ঘুমিয়ে ছিল।
এই রাস্তার একটি কানাগলি রয়েছে, যেখানে একটি কদম গাছ সোজা নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে; এরপরেই লেকটিকে ঘিরে একটি সরু পায়ে হাঁটা পথ শুরু হয়েছে। গাছের ঠিক নিচের ঢালু স্থানে দুজন লোক কাজ করছিলেন। গ্লাভস পরে তারা চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরা পাতা ও অন্যান্য আবর্জনা কুড়াচ্ছিলেন।
তাদের একজনের পায়ে ছিল নোংরা জুতা, তিনি একটি লাল প্লাস্টিকের বালতিতে করে পানি এনে চারপাশের গাছপালায় ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন।
নিবিষ্ট মনে যিনি এই কাজ করছিলেন, তিনি একজন প্রবীণ ফটোসাংবাদিক। ২০২০ সালে তিনিই '৫৫ কদমতলা: গুলশান লেকের পাড়ে সবুজায়ন' উদ্যোগের সূচনা করেছিলেন।
দেশে থাকলে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে তিনি এখানকার ঝোপঝাড় ছাঁটেন, নতুন চারা রোপণ করেন, গাছে পানি দেন এবং প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে দক্ষ মালীর মতো আরও অনেক কাজ করেন।
তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তার এই কাজে সম্পৃক্ত হতে স্বেচ্ছাসেবীদের আমন্ত্রণ জানান।
স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় তার বাড়ির কাছে গুলশান-২ এর লেকের পাড় থেকে শুরু করে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ৫০ থেকে ৬০টি বিভিন্ন প্রকারের গাছ ও ভেষজ গাছ লাগানো হয়েছে। এভাবেই ময়লা-আবর্জনাময় চত্বরগুলো ধীরে ধীরে সবুজ চত্বরে রূপ নিচ্ছে।
আগের সেই প্লাস্টিকের বোতল আর চিপসের খালি প্যাকেটের বদলে হলুদ দাদ মর্দনের ঝোপ আর লাল জবা ফুল এখন লেকের পাড়ে আলো ছড়াচ্ছে।
এখানকার গাছপালা রক্ষার জন্য বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়েছে, তবে এগুলো রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সহায়তায় গুলশান-১ এ তাদের কার্যালয়ের কাছে দুটি সবুজ চত্বর তৈরি করা হয়েছে। এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরাও মাঝে মাঝে মাহমুদকে সাহায্য করেন।
প্রায়ই এখানকার কদম গাছের কাছে ডালে বিভিন্ন জাতের পরিযায়ী পাখি দেখা যায়।
ধূসর ও বাদামি রঙের একটি পাখির দিকে ইঙ্গিত করে সেদিন মাহমুদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা জাতিসংঘের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম মনোয়ার কামাল বলেন, 'এটি একটি শ্রিক (চিলজাতীয় পাখি), এটি মঙ্গোলিয়া থেকে এখানে উড়ে এসেছে।'
মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 'দোয়া করি কড়াইলের বাচ্চারা যেন গুলতি দিয়ে এটিকে মারার চেষ্টা না করে।' ধনী কি দরিদ্র, শিশুরা (বরং কিশোর-কিশোরীরা) মাঝে মাঝে গাছপালার জন্য হুমকির কারণ হয়।
৫৫ নম্বর রোডের পাশের গলিটি দামি গাড়ি হাঁকানো তরুণদের কাছে বেশ প্রিয় একটি গন্তব্য। এরকম একটি গাড়ি একদিন হ্রদে পড়ে প্রায় বিধ্বস্ত হয়েছিল।
কখনও কখনও আবার গাড়িতে করে প্রেম-প্রেমিক যুগলরা এখানে আসেন এবং পরে ব্যবহৃত গর্ভনিরোধক ফেলে জায়গাটি নোংরা করে।
এসব গাড়ি এখানে দাঁড় করানো ঠেকাতে মাহমুদের মোক্ষম অস্ত্র কী? রাস্তা থেকে ইটের টুকরো কুড়িয়ে চত্বরের মাটিতে বিছিয়ে রেখেছেন, আর বারান্দায় বসানো আছে তার বিশ্বস্ত লেন্স। তার সর্বশেষ অস্ত্র হলো এদের ছবি তুলে রাখার হুমকি দেওয়া, এই মোক্ষম অস্ত্রটি অধিকাংশ সময় বেশ কাজে লাগে।
'কর্তৃপক্ষ আমাদের সব সমস্যা সমাধান করবে আমরা এটা আশা করতে পারি না'
মাহমুদের কথা শেষ হলে মনোয়ার আমাকে লেকের পাড় ঘুরিয়ে দেখাতে বললেন।
হাঁটতে হাঁটতে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক টিয়া পাখি, যা ঢাকার অনেক আবাসিক এলাকায় বিরল দৃশ্য।
তিনি ঢালে বেড়ে ওঠা লাল-কমলা কলাবতী ফুলের গাছের দিকে ইঙ্গিত করলেন।
তিনি বলেন, 'এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা সবচেয়ে সহজ। আমাদের ভুল ধারণা যে এই গাছগুলোতে প্রচুর সার ইত্যাদি লাগে, এটি সত্য নয়।'
তিনি নিজেকে 'লেমনগ্রাস ম্যান' হিসেবেও পরিচয় দেন। কারণ হ্রদের ধারে প্রায় সব লেমনগ্রাস তিনিই লাগিয়েছেন।
এছাড়া আমরা কিছু গোলমরিচের লতা ও রোসেলা গাছ দেখেছি। এক কোণে একটা নিম গাছও সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে।
আমি সেখানে একটি সোনালু গাছও দেখেছি। একটি কৃষ্ণচূঁড়াও সেখানে বসন্তকালে ফুল ফোটার অপেক্ষা করছে।
আমরা বেশ কয়েকজনকে কুকুর নিয়ে হাঁটতে দেখেছি এবং যত্রতত্র কুকুরের মলমূত্র দেখেছি। অনেকে তার পোষা প্রাণীকে মলমূত্র ত্যাগ করানোর পরে সেগুলো আর পরিষ্কার করে না।
গুলশান-২ সম্ভবত শহরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল আবাসিক এলাকাগুলোর একটি, 'লেক ভিউ' থাকার জন্য এখানকার অনেক অ্যাপার্টমেন্ট চড়া দামে বিক্রি হয়। তবে এ এলাকার মালিক ও ভাড়াটিয়া কারোরই লেকের ধারের বাগানগুলো রক্ষায় বেশি মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হয় না।
নির্মাণকাজের প্রচণ্ড শব্দে মনোয়ারের কথা বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছিল।
তিনি বলছিলেন, ভাবুন এই শব্দ যদি আমাদেরই এত বিরক্তিকর লাগে, তাহলে পাখিদের কতটা বিরক্তিকর লাগছে। এর ফলে তারা সবাই এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতেও পারে।
সবুজের প্রতি মনোয়ারের ভালোবাসা গভীর। তিনি প্রকৃতি নিয়েও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, বিশেষ করে অন্যান্য দেশের জঙ্গলে কাজ করার অনেক অভিজ্ঞতা আছে তার।
তিনি বলেন, 'সবসময় আমার শখ ছিল বাগান করা। আর এখন, অবসর নেওয়ার পরে, আমার কাছে এই কাজের জন্য যথেষ্ট সময়ও আছে।'
তিনি তার ছাদে বেশ কিছু গাছ লাগিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে এখানে আরও কিছু করার পরিকল্পনা আছে তার।
মানুষের ব্যবহারের জন্য গাছের পাতা বা ফুল ছেঁড়াটা তিনি দোষের মনে করেন না।
তিনি বলেন, মানুষ নিমপাতা ব্যবহার করলে উপকৃত হয়। রোসেলা চা- ও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
সব দেখে শুনে মনে হয়েছে, মাহমুদ এবং তার প্রায় ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবকের দলটি রাতারাতি কোনো বড় পরিবর্তন আনার জন্য উঠে পড়ে লাগতে চাইছেন না; তারা সময় নিচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছেন।
যদিও তাদের তৈরি করা সবুজ চত্ত্বরগুলো গুলশান সোসাইটির মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ বা সৌন্দর্যমণ্ডিত না, তবে তারা এভাবেই কাজ করতে পছন্দ করে। প্রয়োজনে গুলশান সোসাইটিও তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
তিনি বলেন, 'আমাদের (স্বেচ্ছাসেবীরা) বেশিরভাগই শিল্পপ্রেমী, প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব জায়গা থেকে কাজ করতে চায়। আমরা চাই স্থানীয় মানুষেরা এগিয়ে আসুক; আমরা আশা করতে পারি না যে কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য সবকিছু করবে। যারা সহযোগিতা করতে চাই না, তারা না-ই করতে পারে, তাদের ব্যাপারে আমাদের কী আর করার আছে? '
হাঁটার সময় গুলশান সোসাইটির কয়েকজন শ্রমিককে একটি ট্রাকে ঝরা পড়া পাতা ইত্যাদি তুলে নিতে দেখি। তারা মনোয়ারকে দেখে অভিবাদন জানান এবং কিছু চারা দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এই ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতা দেখতেও ভালো লাগে।
রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে মালী, অনেকেই সাহায্য করেন
মাহমুদকে সাহায্যের আহ্বান অনেকে সহজেই এড়িয়ে গেলেও, কেউ কেই আবার স্বেচ্ছায় তাকে সহায়তা করেন। কিছু বিদেশিও সময় পেলেই এখানে আসেন।
মাহমুদ বলেন, 'ক্রিস্টিয়ানা নামে একজন ইতালীয় নারী যখনই তার কুকুরকে হাঁটতে বের হন, তিনি এখানে অবশ্যই আসেন। তিনি নিজের সঙ্গে হ্যান্ড গ্লাভস নিয়ে আসেন, এসেই নিজের মতো করে কাজ করেন।'
তার সাহায্যকারীদের তালিকায় প্রায় ৩৫ বছর ধরে অভিজ্ঞ মালী হিসেবে কাজ করা আব্দুস সোবহান যেমন আছেন, তেমনি এমপির মতো উচ্চপদস্থ বাসিন্দাও রয়েছেন। তারা সবাই তাকে সাধ্যমতো সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কেউ বেড়া ভাঙলে বা গাছ নষ্ট করলে মাহমুদ রহমান রাগ করেন না। অনেক সময় হয়েছে যে তিনি সারা সকাল একটি চত্বর তৈরির কাজ করেছেন, আর রাতে একটি ট্রাক এটিকে চাপা দিয়ে সব গাছপালা নষ্ট করে ফেলেছে। তবুও তিনি কাজ বন্ধ করেননি।
তিনি বলেন, 'বড় হওয়ার পর আপনি বুঝতে পারবেন, রাগ করা কতটা নিরর্থক। তাই আমরা মানুষের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করি না, আশা করি আস্তে আস্তে সমাজ বদলাবে।'
তবে মাহমুদ এখন মরিয়া হয়ে লেকের পাড় বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তিনি মাঝে মাঝে কদমতলায় (অর্থাৎ কদম গাছের নিচে) পিকনিক ও ছোটখাটো অনুষ্ঠান আয়োজন করেন।
তিনি বলেন, 'আমি মানুষকে এখানে তাদের গিটার নিয়ে আসতে, গান গাইতে এবং কিছু ভাল মুহূর্ত কাটাতে বলি।'
আমাদের কথোপকথন শেষ হতেই লেকের অপর পাড় থেকে একজন পুরো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র লেকে ফেলে দিলেন। আমি বুঝতে পালাম, কদমতলা স্বেচ্ছাসেবকদের আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি