সিনেমা হল থেকে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটক: যেভাবে টিকে আছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি
মুনমুন টকিজ ছিল চিলমারী বন্দরে। সিনেমা হলটির আসন সংখ্যা ছিল ৬০০। নজরুল ইসলাম ঠিক করে ফেলেছিলেন যেমন করে হোক চলচ্চিত্রের সঙ্গেই থাকবেন। চিলমারীর এক ছেলে এফডিসিতে ঘোরাঘুরি করত তখন। তার কাছেই নজরুল খবর পেয়েছিলেন মুনমুন টকিজ ভাড়া হওয়ার কথা। মালিক ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুকুল সাহেব।
নজরুল বেশি দেরি করলেন না। গেলেন চিলমারী, কথাবার্তা বললেন মুকুল সাহেবের সঙ্গে। পনেরো হাজার টাকা মাসচুক্তিতে ভাড়াও নিয়ে ফেললেন। হল তো পেয়েছেন, এবার লাগবে ছবি। গেলেন 'বেদের মেয়ে জোসনা'র প্রযোজক মতিউর রহমান পানুর অফিসে। 'গাড়িয়াল ভাই' নামে নতুন ছবি এনেছেন পানু সাহেব। নব্বই দশকের শুরু। নজরুলের বয়স তখন চৌদ্দ হবে।
নজরুল এফডিসিতে প্রথম গিয়েছিলেন ১৯৮৪ সালে। সাথে ছিলেন মামি রাশেদা চৌধুরী। তখন নতুন মুখের সন্ধান চলছিল এফডিসিতে। মান্না, অমিত হাসান, দিতি, সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে রাশেদা চৌধুরীও নতুন মুখ হয়ে এফডিসিতে যান। মামির শুটিং থাকলে সঙ্গে যেতেন নজরুলও। হঠাৎ একদিন চাষি নজরুল ইসলাম তাকে দেখে বললেন, 'তুমি এই সংলাপটা বলো তো দেখি।' প্রথম চেষ্টাতেই সংলাপটা বলতে পেরেছিলেন নজরুল।
সেদিনই নাম লেখান শিশুশিল্পীর খাতায়। একে একে আধা ডজন ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছিলেন তিনি। তারপর ঢুকে গেলেন চলচ্চিত্র ব্যবসায়। 'গাড়িয়াল ভাই' ছবির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শক হিসাবে যাত্রা শুরু করেন।
'বেদের মেয়ে জোসনা'র প্রযোজক পানু সাহেবর ব্যবসা তখন তুঙ্গে। বললেন, "৩০ হাজার টাকার কমে তো 'গাড়িয়াল ভাই' দিচ্ছি না কোথাও।" নজরুল বললেন, 'আমি মাত্র শুরু করেছি, আমাকে বিশ হাজার টাকায় দেন।' পানু সাহেবের অফিসের চেনা এক স্টাফের দূতিয়ালিতে শেষে পঁচিশ হাজারে রফা হয়।
২,৫০০ দর্শক প্রতিদিন
চারজন বসতে পারে এমন কাঠের বেঞ্চিই বেশি ছিল মুনমুন টকিজে। সামনের দিকে টিকিটের দাম কম আর পেছনে বেশি। মহিলা আসন আলাদা। টিকিটের দাম সাত, আট ও দশ টাকা। "মুনমুনে আসিতেছে কাঞ্চন-অঞ্জু জুটির মনমাতানো, হৃদয় জুড়ানো, নাচে গানে ভরপুর সুপারহিট ছবি 'গাড়িয়াল ভাই'" — মাইকিং শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেই। চিলমারী বন্দরে দর্শকদের তুমুল অপেক্ষা। নামেই বোঝা যায় ছবিটির গল্প গরুর গাড়ি চালক, তার প্রেম ও জীবন সংসার নিয়ে। চিলমারীর লোকের আগ্রহ তাই বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ।
নজরুল 'গাড়িয়াল ভাই' ছবির ৭–৮টি ক্যান একটি ট্রাংকে ভরে ফেরিতে করে যমুনা নদী পার হয়ে আরেকটি বাস ধরে চিলমারী পৌঁছালেন। এবার তার অবাক হওয়ার পালা। দেখেন, শত-শত লোক বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হয়ে তার আগমনের প্রহর গুনছেন। তাকে নামতে দেখে শোরগোল পড়ে গেল। কয়েকজন এগিয়ে এসে ট্রাংকটি মাথায় তুলে নিলেন। নজরুলকে মাঝখানে রেখে শত মানুষ চললেন হল অভিমুখে। সে এক দর্শনীয় শোভাযাত্রা।
পরের পনেরো দিন নারী দর্শকের এত ভিড় ছিল যে, পুরুষ দর্শককে টিকিটই দিতে পারেননি নজরুল। কেউ কেউ নগদ টাকার বদলে চারটি ডিম বা দুই কেজি চাউলের বিনিময়ে টিকিট নিয়েছিলেন। নজরুল দেড় মাস 'গাড়িয়াল ভাই' চালিয়েছিলেন মুনমুন টকিজে। প্রতিদিন চারটি শো-এ আড়াই হাজার লোক ছবিটি দেখেছে। লাখ টাকার বেশি উপার্জন হয়েছিল তার।
খরচও কম ছিল না। বিদ্যুৎ বিলসহ সিনেমা হল পরিচালনা ব্যয় ছিল অন্যতম প্রধান খরচ। সরকারকে রাজস্ব দিতে হতো শতকরা ১৫ টাকা। স্টাফ ছিলেন ১৫–১৬ জন। তাদের মধ্যে অপারেটর, টিকিট মাস্টার, টিকিট চেকার ছাড়াও ছিলেন মাইকম্যান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ইত্যাদি। সবাইকে দিনের টাকা দিনেই বুঝিয়ে দেওয়া হতো। ম্যাইকম্যান পেতেন ২০ টাকা, টিকিট মাস্টার ৩০ টাকা, অপারেটর ৫০ টাকা। কাছাকাছি সময়ে বগুড়ার ধুনটে ঝংকার ও ক্লিওপেট্টা নামের আরও দুটি হল ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে, ভালুকায়, হালুয়াঘাটেও হল চালিয়েছেন নজরুল।
শরণখোলায় সর্বহারা উৎপাত
একবার ধুনট থেকে ঢাকায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল সাত হাঁড়ি দই। মহাখালি বাসস্ট্যান্ডে নেমে একটি স্কুটার ভাড়া নিলেন। স্কুটারটি স্টার্ট নিতে কিছু দেরি করছিল। এরই মধ্যে চার-পাঁচজন ঘিরে ধরে তাকে। নজরুল তাদের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। দলনেতা বললেন, 'আমাদের কাছে খবর আছে, আপনার সঙ্গে দুই লাখ টাকা আছে। টাকা দিয়ে দেন, আমরা চলে যাই।' নজরুল বললেন, 'আমার কাছে যা আছে সব নিয়ে যান, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেন, আমি ক্লান্ত আছি।'
পকেট হাতড়ে হাজার দুয়েক টাকা পেয়ে হতাশ হয়ে গিয়েছিল লোকগুলো। বলেছিল, 'আমরা ভুল ইনফরমেশন পেয়েছি। ভুল হয়ে গেছে, সরি।' তবে একেবারে খালিহাতে ফেরাননি নজরুল। এক হাজার টাকা দলনেতার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন, 'আপনারা এতগুলো মানুষ এতক্ষণ কষ্ট করলেন, এই এক হাজার টাকা নেন, চা-বিস্কুট খেয়েন।' এমন ঘটনা অবশ্য আর ঘটেনি। সাধারণত তখন টাকা আনা নেওয়া করতেন ক্যানের ভেতরে পুরে।
ফরিদপুরের মধুখালি, চর ভদ্রাসন, বাগেরহাটের সুন্দরবনঘেঁষা শরণখোলাতেও হল চালিয়েছেন নজরুল। একবার শরণখোলায় যাওয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন। নদীতে ঢেউ ছিল উঁচু-উঁচু, স্পিডবোট খেলনার মতো ওপর থেকে আছড়ে-আছড়ে পড়ছিল। চালক দক্ষ ছিলেন বলে সে যাত্রায় বেঁচে যাওয়া। শরণখোলায় পরিবেশ সুন্দর ছিল, কিন্তু সর্বহারাদের উৎপাত ছিল বলে আড়াই বছরের মাথায় বাক্সপ্যাটরা গুটিয়ে চলে আসতে হয়েছিল।
এখনো চালাচ্ছেন ক্লিওপেট্রা
ধুনটের ক্লিওপেট্টা হলটি এখনো পরিচালনা করেন নজরুল। ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া ছবি 'তুফান' চালিয়েছেন দুই সপ্তাহ। বেশ ভালো ব্যবসাও করেছেন তুফান চালিয়ে। তবে বছরের অন্য সময় বসে থাকতে হয় বলে হল-ব্যবসায় এখন আর পয়সা নেই বলে জানালেন নজরুল। আগে কোনো কোনো বছর একশ ছবিও মুক্তি পেয়েছে। আশিভাগ ছবিই ছিল ব্যবসাসফল। প্রতি সপ্তাহেই নতুন কোনো ছবি মুক্তি পেত। সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবারের শোতেও জায়গা দেওয়া যেত না দর্শকদের।
বিভিন্ন সময়ে ৫০টির মতো সিনেমা হল পরিচালনা করেছেন নজরুল ইসলাম। তখন সারাদেশে ১,৪০০ সিনেমা হল ছিল। পরিবেশ, আসন সংখ্যা ইত্যাদি বিবেচনায় হলগুলোকে এ, বি ও সি — এ তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হতো। ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ টাকায় তখন সিনেমা বানানো হয়ে যেত। যেগুলো আশি লাখ থেকে এক কোটি টাকা ব্যবসা করত সেগুলোকে বলা হতো সুপারহিট ছবি।
গড়ে চল্লিশ–পঞ্চাশটি প্রিন্ট হতো একেকটি ছবির। প্রথমে সার্কেল বা চক্রে জেলা শহরগুলোতে, দ্বিতীয় চক্রে উপজেলায় আর তৃতীয় চক্রে বাজারের হলগুলোয় সিনেমা মুক্তি দেওয়া হতো। তৃতীয় চক্র শেষ হলে দর্শক চাহিদার প্রেক্ষিতে আবার প্রথম চক্র শুরু হতো। কোনো কোনো ছবি দেড়-দুই বছর ধরেও প্রদর্শিত হয়েছে।
পঁচাশি সালের আগ পর্যন্ত সিনেমা পাইরেসির সুযোগও ছিল না সেভাবে।
ভিএইচএস ক্যামেরা আসার পর থেকে 'হল প্রিন্ট' নামে পাইরেসি ছবির যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে প্রযোজকদের। সাধারণত নিয়মিত প্রযোজকেরা নিজেরাই ছবি পরিবেশন করতেন। রাজ্জাক, শাবানা, উজ্জ্বল, ববিতা, ইলিয়াস কাঞ্চন, আলমগীর, সোহেল রানা প্রমুখ নামি-দামি তারকাদের নিজেদেরই ছিল প্রযোজনা সংস্থা। প্রযোজকেরা তিনভাবে প্রদর্শক বা হল মালিকদের সঙ্গে প্রদর্শন চুক্তি করতেন। এক. প্রযোজককে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিয়ে দুই বা চার সপ্তাহের জন্য প্রদর্শন; দুই. প্রযোজককে মিনিমাম গ্যারান্টি বা এমজি মানি দিয়ে প্রদর্শন; এবং তিন. প্রযোজক-প্রদর্শকের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রদর্শন।
ছবির নতুন বাজার ফেসবুক-টিকটক-ইউটিউব-ওটিটি প্ল্যাটফর্ম
নজরুল ইসলাম চলচ্চিত্র পরিবেশন বা ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ শুরু করেন ২০০৭ সালে। তিনি বলছিলেন, 'দীর্ঘদিন সিনেমা হল পরিচালনার অভিজ্ঞতা এবং হল মালিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হওয়ায় প্রযোজকেরা আমার ওপর আস্থা রাখলেন। আমি পরিবেশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করলাম। মোট বিক্রির শতকরা ১০ বা ১৫ ভাগ কমিশন পাওয়া যেত একটি ছবি পরিবেশন করে। পরিবেশনা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চেকার, ক্যারিয়ারসহ পাঁচ–ছয়জন কর্মী থাকেন। আমি নিজেও দীর্ঘদিন চেকার হিসাবে চাকরি করেছি।'
রিলে ঠিকমতো ছবি ও শব্দ সংযোজিত হয়েছে কি না তা যাচাই করা ছিল ফিল্ম চেকারের কাজ। নজরুলের ছোট ভাই সাইফুল ইসলামও চেকার ছিলেন। যেহেতু রিলে আর ছবি তৈরি হয় না, তাই এখন চলচ্চিত্রের ডিজিটাল আমলে ফিল্ম চেকার বলে কোনো পদ-পদবি নেই। সাইফুল বর্তমানে চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং পরিবেশক।
অ্যানালগ আমলের সাদা-কালো বা আংশিক রঙিন ছবির একটি বিশাল ভান্ডার তিনি গড়ে তুলেছেন। সংখ্যায় তা পাঁচ শতাধিক হতে পারে। যে-সব প্রযোজক ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন, তারা স্বল্পমূল্যে ছবিগুলোর স্বত্ব তার কাছে বিক্রি করে গেছেন। কী করেন তিনি এ ছবিগুলো দিয়ে? 'হাল আমলে ইউটিউব, টিকটক, লাইকি, ফেসবুক, ওটিটি প্লাটফর্ম, অ্যাপস, টিভি চ্যানেলের মতো ছবির নতুন-নতুন বাজার তৈরি হয়েছে। পুরোনো যে-সব ছবি, ছবির গান, বিশেষ বিশেষ দৃশ্য অন্তর্জালে ঘুরে বেড়ায়, তার অনেকগুলোই আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলো নিয়মিত পুরোনো ছবি দেখায়, তারও অন্যতম উৎস আমাদের প্রতিষ্ঠান। শুধু মোহনা টিভিতেই আমরা ১০০ ছবি সরবরাহ করেছি।'
জ্যাজ মাল্টিমিডিয়ার মহাব্যবস্থাপক আবু বকর সবুজ বললেন, 'এখন এই ডিজিটাল সময়ে ছবির টাকা উঠিয়ে আনা আগের তুলনায় সহজ। একে তো পরিবেশন ব্যবস্থা (ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম) কেবল সিনেমা হল নির্ভর নয়, তার ওপর ওভারসিজ বা প্রবাসের বাজারও বড় হচ্ছে।'
তিনি জানান, জ্যাজের প্রযোজিত 'পাপ: প্রথম চাল' ছবিটি হল থেকে দুই লাখ টাকাও উঠিয়ে আনতে পারেনি, অথচ ওটিটি প্লাটফর্মে বিক্রি হয়েছিল ১৫ লাখ টাকায়, টিভিতে বিক্রি হয়েছিল ১০ লাখ টাকায়। 'ঈদুল ফিতরে আমাদের 'মোনা: জ্বিন-২' ছবিটি পাকিস্তানের ২৪টি হলে মুক্তি পেয়েছিল। সেখানকার এক প্রযোজক নিজের উদ্যোগে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ছবিটি প্রযোজনার মোট খরচের অনেকটাই সেখান থেকে উঠে এসেছিল। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক ঘটনা এবং আগামীতে বাড়বে বলেই মনে হয়।'
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ১০ লাখ
সবুজ মনে করেন, চলচ্চিত্র ব্যবসার উপযুক্ত ক্ষেত্র বাংলাদেশ। কারণ তেমন ভালো সিনেমা মুক্তি পেলে দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তবে ভালো সিনেমা হলের অভাব বোধ করেন তিনি। 'তুফান' ছবির উদাহরণ টেনে বললেন, বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ৫০০ টাকা টিকিট কেটেও সিনেমা দেখছেন দর্শক, অথচ কাছের আনন্দ হলে দর্শকের ঘাটতি। জ্যাজ তাই সিনেমা হল সংস্কারের কাজ শুরু করেছিল ২০১২ সালে।'
প্রথম দফায় ৪০টি হলে সিলভার স্ক্রিন, সারাউন্ড সাউন্ড সিস্টেম, ডিজিটাল প্রজেক্টর, অনলাইন ইউপিএস, মিক্সচার মেশিন বসিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। হল মালিকদের পর্যাপ্ত আলোক সরবরাহ, পরিচ্ছন্ন টয়লেট, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সুন্দর আসন স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিল। নিজেদের প্রযোজিত 'ভালোবাসার রং' ছবি দিয়ে আধুনিক প্রদর্শন ব্যবস্থার সূচনা ঘটিয়েছিল বলেও জানান সবুজ।
আগে থেকেই আরও কিছু ছবি যেমন 'অন্যরকম ভালোবাসা', 'ভালোবাসা আজকাল', 'পোড়ামন' প্রস্তুত রেখেছিল জ্যাজ, যেন ধারাবাহিকভাবে ভালো ছবি দেখার অভিজ্ঞতা তৈরি হয় দর্শকের। সে সূত্র ধরে ইতিবাচক ফল পেয়েছে জ্যাজ মাল্টিমিডিয়া। সবুজ জানান, কিছু ব্যতিক্রম বাদে টিভি চ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইন প্লাটফর্মে ভালো দর্শক পাওয়ার পূর্বশর্ত হলে ভালো দর্শক পাওয়া। ছবির ট্রেইলার, গান, ভিডিও চালিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তারা প্রতিমাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা উপার্জন করেন। সম্প্রতি কিছু চীনা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তাদের ছবির অডিও কেনার আগ্রহ দেখিয়েছেন। এগুলো ব্যবহৃত হবে টিকটক বা লাইকির মতো অ্যাপ্লিকেশনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা ভয়েস হিসেবে।
গত দেড়যুগে ৮০টি ছবি প্রযোজনা ও পাঁচশর বেশি ছবি ডিস্ট্রিবিউট করেছে জ্যাজ। পাইরেসি বন্ধে প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় সার্ভার সিকিউরিটি সফটওয়্যারও তৈরি করেছে। এখন আর আগের মতো ছবির প্রিন্ট পরিবহনের প্রয়োজনও পড়ে না। যে হলে প্রদর্শন করা হবে, সে হলের সার্ভারটি কেবল খোলা রাখতে হয়, জ্যাজ তার ঢাকা অফিসের সার্ভার রুম থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ছবিটি প্রদর্শন করে।
'শাবানা কাঁদলে হল হাউজফুল'
জ্যাজ ছাড়া অ্যাকশন কাট-কিবরিয়া ফিল্মস, আলফা আই, শাপলা মিডিয়া, টিওটি ফিল্মস প্রভৃতি ৪–৫টি প্রতিষ্ঠান দেশে এখন মূলধারার ছবি প্রযোজনা করছে। অথচ ১২–১৫ বছর আগেও প্রযোজনা-পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান ছিল সাড়ে তিন শতাধিক। কাকরাইলের ভূইয়া ম্যানসন, ইস্টার্ন কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স, রাজমনি কমপ্লেক্সের সবটা জুড়ে ছিল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিস। স্থানটি সিনেমাপাড়া বা ফিল্মপাড়া নামে পরিচিতি পেয়েছিল। হল মালিক পক্ষের বুকিং এজেন্টদের ভিড় লেগে থাকত প্রযোজকদের অফিসে। শত শত শ্রমিক ছবির প্রিন্ট ওঠানো-নামানোর কাজে ব্যস্ত থাকতেন। নতুন নতুন সব ছবির পোস্টারে ছেয়ে থাকত কাকরাইলের দেয়াল। এখন তার কিছুই নেই। ৫–৭টি অফিস আছে বড়জোর। আবার সবগুলো নিয়মিত খোলাও হয় না।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক আব্দুল গফুরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিবরিয়া ফিল্মসের অফিসে। চুরাশি সাল থেকে তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত। একসময় নায়করাজ রাজ্জাকের রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনসের ম্যানেজারও ছিলেন। আব্দুল গফুর এফডিসি চলচ্চিত্রের স্বর্ণসময়ের সাক্ষী। বলছিলেন, 'কোনো কোনো বছর ১১২টি ছবিও রিলিজ হয়েছে। এত ছবি! প্রদর্শকরা অস্থির হয়ে যেতেন, কোনটা রেখে কোনটা দেখাবেন? সামাজিক, ফোক, অ্যাকশন নানা রকম ছবি হতো।
'নায়ক-নায়িকাদের আলাদা আলাদা ইমেজ ছিল। যেমন জাফর ইকবাল লাভার বয়, জসিম অ্যাকশনম্যান, ফারুক তেজি যুবক, সুচরিতা মিষ্টি মেয়ে, সোহেল রানা ড্যাশিং হিরো। প্রত্যেকের ফ্যান গ্রুপ ছিল। সোহেল রানার ভক্তরা তার ছবি একাধিকবার দেখতেন, যেন প্রিয় নায়কের বাজার চাঙ্গা থাকে। সামাজিক ছবিতে নায়িকা শাবানার জুড়ি ছিল না। তার চোখের পানি ছিল প্রযোজকদের কাছে অমূল্য রতন। এক ফোঁটা পানি লক্ষ দর্শককে হলে টেনে আনত।'
গফুর জানান, বারো-চৌদ্দশ আসনেরও সিনেমা হল ছিল। ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস ছাড়াও গ্র্যান্ড সার্কেল, ডিসি নামে আসন বিভাজন ছিল। 'দিনে হলগুলোতে চারটি শো ছিল বাঁধা, কোনো কোনো ছবি মাঝরাতেও চালাতে হয়েছে। সে ছিল এক অদ্ভুত সময়। বিনোদন বলতে চলচ্চিত্রকেই বুঝতো সবাই।'
দেশের বাজেটের ১৪ শতাংশ আসত প্রমোদকর থেকে
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, 'আশির দশক পর্যন্ত চলচ্চিত্রের চেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশে ছিল না। আশির দশকে যখন দেশের বাজেটের আকার হতো আট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা, তখন চলচ্চিত্র শিল্প থেকে সরকার ১,৪০০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রমোদ কর পেয়েছে।
'অথচ এখন সারা বছর ১০০ হলও খোলা থাকে না। পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে অনেকে হল চালিয়ে যাচ্ছেন। ঈদ মৌসুমে দুইশর মতো হল চালু থাকে। বছরে ৫টি ব্যবসাসফল ছবি হলেও কিন্তু হলগুলো টিকে থাকার উপায় করতে পারত। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা প্রবাসে কোনো ছবির চাহিদা বৃদ্ধিরও কিন্তু পূর্বশর্ত হলে ছবিটি ভালো চলেছে কি না। হলে দর্শক চাহিদা শেষ হওয়ার আগে কোনো প্রযোজকই ছবি অন্য কোনো প্লাটফর্মে রিলিজ দিতে চান না। সিনেমা হলে ছবি দেখা একটি সংস্কৃতি, এর সঙ্গে নির্দিষ্ট অঞ্চলের অর্থনীতিও যুক্ত।'
কিবরিয়া ফিল্মস-এর মহাব্যবস্থাপক রুহুল আমিন জানালেন, ১৯৯৭ সালের এক জরিপে দেখা গেছে সিনেমা ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত লোকের সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার। পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল লোক যোগ করলে সংখ্যাটি ১০ লাখ ছুঁয়ে যাবে। 'ঝালমুড়িওয়ালা, ব্ল্যাকারও সিনেমা হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সবারই জীবিকার মাধ্যম সিনেমা হল। তাই সিনেমা হল বন্ধ হওয়া মানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের জীবিকা নষ্ট হওয়া।'
মিয়া আলাউদ্দিন আরও বলেন, "পঁয়ষট্টি সালে শুধু 'রূপবান' সিনেমাই অনেকগুলো নতুন হল খুলে দিয়েছিল। তারপর 'বাহরাম বাদশা', 'সাত ভাই চম্পা', 'বেহুলা', 'অরুণ বরুণ কিরণমালা', 'বেদের মেয়ে জোসনা' নতুন নতুন সিনেমা হল প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। চলচ্চিত্র ব্যবসা থেকে অনেকেই লাভবান হয়েছেন, তারা অন্য ব্যবসায় এখন টাকা লগ্নি করছেন। আমি তাদেরকে আবার সিনেমা প্রযোজনার আহ্বান জানাচ্ছি। দর্শকের মনমতো গল্প বলতে পারলে দর্শক অবশ্যই সিনেমা দেখবেন, হলে এসেই সিনেমা দেখবেন।"
বড় হচ্ছে বিদেশের বাজারও
গত দুই বছরে 'প্রিয়তমা', 'পরান', 'সুড়ঙ্গ', 'হাওয়া', 'রাজকুমার' দেশের হলগুলোতেই কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত 'তুফান'ও সুপারডুপার হিট। জ্যাজের 'নবাব', 'শিকারি', 'অগ্নি', 'বস-২', 'বাদশা', 'পোড়ামন-২', 'জ্বিন-২' ইত্যাদি ছবিও ভালো ব্যবসাসফল। চলচ্চিত্র ব্যবসার অনলাইন মাধ্যমও খুলে যাওয়ায় প্রযোজকেরা অধিক সাহসী হতে পারছেন। পাঁচ, সাত, দশ কোটি টাকা বাজেটের ছবিও হচ্ছে এখন আমাদের দেশে। তাই সিনেমা ব্যবসায় সুদিন ফিরে আসছে বলে মনে করেন সাইফুল ইসলাম। তিনি আশাবাদী, দেশের বাইরেও বাংলাদেশি সিনামেরা বাজার বড় হবে দিনে দিনে।
১০ থেকে ১২টি ডিস্ট্রিবিউশন প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিবেশন করে থাকে। কানাডার স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো পরিবেশন করে উত্তর আমেরিকায়। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি মিলনায়তন ভাড়া নিয়ে ছবি প্রদর্শন শুরু করে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে থিয়েটারে চলচ্চিত্র মুক্তি দিয়েছে। এজন্য ছবিগুলোকে নির্দিষ্ট দেশে সেন্সর করিয়ে নিতে হয়েছে, যোগ করতে হয়েছে ইংরেজি সাবটাইটেল।
গতবছর স্কেয়ারক্রো এসকে ফিল্মসের 'প্রিয়তমা' ছবিটি কানাডা ও আমেরিকার ৪২টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিয়েছিল। প্রথম সপ্তাহান্তে ছবিটি গ্রস আয় করেছিল ৪৪ হাজার ডলার। উত্তর আমেরিকায় বিভিন্ন সময়ে 'অস্তিত্ব', 'মুসাফির', 'শিকারি', 'প্রেমী ও প্রেমী', 'ঢাকা অ্যাটাক', 'ডুব', 'স্বপ্নজাল', 'হালদা' ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়েছে।
ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যেও বাংলাদেশি ছবির বড় বাজার তৈরি হচ্ছে। বঙ্গজ ফিল্মস, দেশি ইভেন্টস, রিভেরি ফিল্মস, রাদুগা বাংলাদেশি ছবির ওভারসিজ ডিস্ট্রিবিউটর। ওভারসিজ বিজনেসে গ্রস বক্স অফিস আয় থেকে শতকরা ১৩–১৫ ভাগ কর প্রদান করতে হয়। বাকি টাকার অর্ধেক নেয় মাল্টিপ্লেক্স এবং অবশিষ্ট অর্ধেক ভাগাভাগি হয় প্রদর্শক ও পরিবেশকের মধ্যে।