টিকটিকির লেজ খসে পড়ার রহস্য: অবশেষে সমাধান মিলেছে!
জীবন-মরণ পরিস্থিতিতে নিজের কোনো অঙ্গ বিসর্জন দেওয়ার প্রবণতা অনেক প্রাণীর মধ্যেই দেখা যায়। কোথাও আটকে গেলে মাকড়সা তার পা ছেড়ে দেয়, কাঁকড়া নখর ফেলে দেয়, ছোট ইঁদুর চামড়ার গুটি ফেলে দেয়। জীবন বাঁচাতে অঙ্গ ছিঁড়ে ফেলতে পারার এই ক্ষমতাকে বলা হয় অটোটমি বা স্ব-অঙ্গচ্ছেদ।
আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত স্ব-অঙ্গচ্ছেদকারী হচ্ছে টিকটিকি। শিকারিদের বিভ্রান্ত করতে টিকটিকি তাদের নাড়াচাড়া করতে থাকা লেজই ফেলে দিতে পারে। লেজ হারানোটাও কিন্তু একেবারে ছেলেখেলার বিষয় না। সঙ্গী আকর্ষণ করা, চর্বি সঞ্চয় করার মতো অনেক কাজেই আসে লেজ। তবে অনেক টিকটিকির লেজ আবার গজায়।
বিজ্ঞানীরা এই শিকারি প্রতিরোধকারী আচরণ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। কিন্তু কীভাবে এই অঙ্গচ্ছেদ হয়, তা নিয়ে একমত হতে পারেননি। একটি টিকটিকি যদি যেকোনো সময় তার লেজ ফেলে দিতে পারে, তাহলে যখন সে জীবন-ঝুঁকিতে ছিল না তখন তার লেজ কীভাবে জোড়া লেগে ছিল?
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি আবুধাবির বায়োমেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ইয়ং-আক সং এই বিভ্রমকে "লেজের প্যারাডক্স" বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। কারণ টিকটিকির লেজ যেন একই সঙ্গে সংযুক্ত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে।
"পরিস্থিতির মুখে লেজকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন করতে হয় টিকটিকির। কিন্তু একই সময়ে, লেজ শরীরের একটি অংশ। শরীরের সঙ্গে এর সংযোগও এতো হালকা হতে পারে না," বলেন ডা. সং।
এই প্যারাডক্স সমাধান করতে সম্প্রতি সং এবং তার সহকর্মীরা বেশ কিছু সদ্য বিচ্ছিন্ন হওয়া লেজের উপর গবেষণা চালান। বেশ কয়েক প্রজাতির টিকটিকির লেজকে নিয়ে করেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
যেভাবে চালানো হয় গবেষণাটি
আঙ্গুল দিয়ে একটি টিকটিকির লেজ টেনে ধরা হয়। যার ফলে টিকটিকিটি অটোটমি করতে বাধ্য হয়। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি ধারণ করা হয় সেকেন্ডে তিন হাজার ফ্রেম রেকর্ড করতে সক্ষম একটি উচ্চ-গতির ক্যামেরায়। এরপর বিজ্ঞানীরা একটি মাইক্রোস্কোপের নিচে রাখেন সেই বিচ্ছিন্ন লেজকে।
মাইক্রোস্কোপে দেখা যায়, যেসব ফাটলের মাধ্যমে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে লেজটি, সেখানে কিছু মাশরুম আকৃতির পিলার রয়েছে। লেজকে শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে এই পিলারগুলো প্লাগের মতো কাজ করে। আরেকটু জুম করলে দেখা যায়, সেই পিলারগুলোতে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে।
প্লাগরূপী পিলারগুলো শরীরের যে অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় সেখানে সকেটরূপী ছিদ্র থাকে কিছু। বিজ্ঞানীরা আশা করেছিলেন, প্লাগ-সকেটের জায়গাগুলো শক্তিশালী কিছুর মাধ্যমেই সংযুক্ত থাকে। কিন্তু এ গবেষণায় তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, সেই ছোট পিলারগুলো বেশ হালকাভাবে স্পর্শ করে থাকে মূল দেহকে।
কম্পিউটার মডেলিংয়ে দেখা যায়, পিলারগুলো লেজকে ধরে রাখতেও বেশ পারদর্শী। কারণ প্রতিটি পিলারই ছোট ছোট ছিদ্রে পূর্ণ, যেগুলো মূল দেহ থেকে শক্তি শোষণ করতে সক্ষম। এই শোষণ ক্ষমতার জন্যই টিকটিকির লেজ সাধারণ অবস্থায় অক্ষত থাকে।
এই কারণেই, লেজ কখন বিচ্ছিন্ন হবে সেই সিদ্ধান্ত সবসময় টিকটিকি নিয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, লেজে যেকোনো ধরণের টান ও হালকা মোচড় সহ্য করতে পারে এই প্রাণী । লেজ টেনে ধরলে টিকটিকি যদি নড়াচড়া না করে, তাহলে সেই লেজ ভাঙার সম্ভাবনা ১৭ গুণ কম।
বিজ্ঞানীরা স্লো মোশন ভিডিওতে দেখেছেন, লেজ টেনে ধরলে সবসময় টিকটিকি নিজে থেকে তার লেজকে এমনভাবে মোচড় দেয় যে সেই অদৃশ্য ফাটল বরাবর তার দেহ দুইভাগ হয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণা আসলে ব্যাখ্যা করে কীভাবে দৃঢ় এবং ভঙ্গুরের মধ্যে নিখুঁত ভারসাম্য করতে সক্ষম হয় টিকটিকির লেজ।
ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির রাসায়নিক প্রকৌশলী অনিমাংসু ঘটকের মতে, এই টিকটিকির লেজের বৈশিষ্ট্য গেকো এবং গেছো ব্যাঙের পায়ের আঙ্গুলে পাওয়া গামযুক্ত মাইক্রোস্ট্রাকচারের মতোই।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, টিকটিকির লেজ ফেলে দেওয়ার এই প্রক্রিয়াকে কিছু প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, কৃত্রিম দ্রব্যের সংযুক্তি, ত্বকের ব্যান্ডেজ বা গ্রাফট লাগানো, এমনকি রোবটের ভাঙা অংশ ছাড়ানোতেও ব্যবহার করা যেতে পারে এই প্রক্রিয়া।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।