ঢাকার তৈরি কুলফি যেভাবে হয়ে যায় ‘কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফি’!
ছোটবেলায় কুলফি মালাই পছন্দ করতোনা, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াটা মুশকিল। 'কুলফি মালাই, কুলফি…, কুলফি লাগবে, কুলফি…?' বলে কুলফিওয়ালারা তাদের উপস্থিতি জানান দিতেন। লালরঙের পাতলা কাপড়ে মোড়ানো সিলভারের একটি পাতিল মাথায় নিয়ে আসতেন কুলফিওয়ালা।
পাড়া-মহল্লায় খেলার ফাঁকে কিংবা স্কুলের টিফিনে আমরা ৫ টাকার বিনিময়ে যেন কুলফি নয়, আনন্দ কিনে নিতাম।
এখন আমাদের বয়স বেড়েছে; মহল্লার গলিতে ছুটোছুটি না থাকলেও কুলফি রয়ে গেছে সগৌরবে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এখনও কুলফি বিক্রি করতে দেখা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সেদিন বন্ধুদের সাথে বসে ছিলাম। তীব্র গরমে এক পা-ও নড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল না। শুনতে পেলাম ছোটবেলার কুলফিওয়ালাদের সেই পরিচিত ডাক। হাতের ইশারাতে ডেকে তিনটা কুলফি মালাই দিতে বললাম।
কাছে আসতেই কুলফিওয়ালা বললেন, 'মামা, আপনারা কিন্তু একেবারে অরিজিনাল কুষ্টিয়ার কুলফি কিনলেন'। উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে পাশে থাকা বন্ধু কুষ্টিয়ার কুলফি আবার কেমন সেটা জানতে চাইলো। কুলফিওয়ালা বললেন, 'আমরাই কুষ্টিয়াতে কুলফি বানাতাম। এখন ঢাকাতে নিজ হাতে কুলফি বানিয়ে বিক্রি করি'।
ঢাকায় যেভাবে কুষ্টিয়ার কুলফি মালাই
ফার্সি শব্দ 'কোফলি' থেকে আজকের বাংলা 'কুলফি'র উৎপত্তি। ঐতিহাসিকদের মতে এটি মুঘল সাম্রাজ্যে উৎপত্তি হওয়া অন্যতম মিষ্টান্ন। কোফলির অর্থ 'আচ্ছাদিত কাপ'। মাটির কাপে এই মিষ্টান্ন তৈরি হতো বলে এর নাম পরিবর্তিত রূপ হিসেবে হয় কুলফি। ভারতবর্ষের এই খাবার কিভাবে আমাদের দেশে পরিচিতি পায়- তার সঠিক ইতিহাস অজানা হলেও, বাংলাদেশের বিখ্যাত কুলফি মালাইয়ের প্রসঙ্গ উঠলে কুষ্টিয়া এবং পাবনা অঞ্চলের নাম উঠে আসবে সবার আগে।
দুপুরের রোদে কুলফিওয়ালাও বেশ ক্লান্ত হয়ে আমাদের পাশে বসেই গল্প করতে লাগলেন। 'কুলফি মালাই' তৈরি করাসহ তার জীবনের নানা ঘটনা আমাদের আড্ডার বিষয়ে পরিণত হলো।
তার কাছেই জানতে পারলাম, ঢাকায় যারা এই খাবার 'কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফি' বলে বিক্রি করেন তার অধিকাংশ কুলফিই 'কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী কুলফি' না। 'কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী কুলফি তৈরির প্রণালী একেবারেই সাদাসিধা,' বলেন তিনি।
জানা যায়, আব্দুল জলিল মিয়া নামক এক ব্যক্তি কুষ্টিয়াতে কুলফি ব্যবসা শুরু করেন। মূলত তার মাধ্যমেই কুষ্টিয়ার কুলফি মালাই জনপ্রিয় হয়। জানতে পারি তিনি নিজ হাতে একেবারে 'ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে' কুলফি তৈরি করতেন। ঐতিহ্যবাহী সেই কুলফিতে দুধের পরিমাণও থাকতো বেশি। দুধের সাহায্যে বানানো ক্রিম ঘন দুধের ওপর আলাদা করে দিয়ে তা কুলফি বানিয়ে পরিবেশন করা হত।
বর্তমানে ঢাকায় তৈরি কুলফি কিন্তু কুষ্টিয়ার সেই কুলফি থেকে বেশ আলাদা। ঢাকায় অধিকাংশ কুলফি এখন কাঠি কুলফি নামে পরিচিত। এই কুলফি তৈরি করতে প্রয়োজন হয় নির্দিষ্ট মেশিনের।
তবে, একই ধরনের কুলফি না হওয়া সত্ত্বেও ঢাকার অধিকাংশ বিক্রেতা বিক্রি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে একে কুষ্টিয়ার কুলফি হিসেবে বিক্রি করেন। হিমায়িত কুলফি বরফ ছাড়া বেশিক্ষণ ভালো থাকে না বিধায় এটি তৈরির পর অল্প সময়ের মধ্যেই বিক্রি করতে হয়। ফলে ঢাকার বাইরে থেকে কুলফি নিয়ে আসা সম্ভবও নয়। এজন্য ঢাকার যেখানেই কুলফি পাওয়া যাক না কেন, তা কুলফিওয়ালারা হয় নিজেরাই তৈরি করেন; অথবা, ঢাকারই কোনো কারখানা থেকে তৈরি করে আনেন। এমনকি এখন ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টেও পাওয়া যায় কুলফি।
তবে, কুষ্টিয়াতে কুলফি মালাইয়ের ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন, এমন অনেকেই ঢাকায় চলে এসেছেন। ব্যবসায়ের উন্নতি এবং তুলনামূলক বেশি রোজগারের আশায় তারা ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়েছেন। জমির উদ্দীনও তাদেরই মতো। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে। ঢাকায় থাকেন সোয়ারীঘাটের বেড়ীবাঁধ এলাকাতে। ঢাকায় জমির উদ্দীনের সাথে তার ছেলেসহ আরো পাঁচজন থাকেন।
সকলেই ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন কুলফি। জমির উদ্দীন ঢাকাতেই কুলফি বিক্রি করছেন বিগত ২০ বছর ধরে।
জলিল মিয়ার কাছে অনেকেই কুলফি তৈরি শিখে পরবর্তীতে নিজেদের কুলফি ব্যবসা শুরু করেন। তাদেরই একজন জমির।
যেভাবে হাতেই তৈরী হয় কুষ্টিয়ার কুলফি
কুলফির পাতিল খুলতেই নোনতা-মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এসে লাগে নাকে। কুলফি তৈরিতে ব্যবহৃত হওয়া মশলার কারণে এমন ঘ্রাণ হয়। জমির উদ্দিনের কাছ থেকে জানা গেল কুলফি তৈরির প্রক্রিয়া। প্রথমে দুধ ভালো করে গরম করে এর পরিমাণ অর্ধেকে নিয়ে আসা হয়। এতে করে দুধ ঘন হয়ে যায়। এরপর এতে বাজার থেকে কিনে আনা কনডেন্সড মিল্ক আর চিনির রসের মিশ্রণ যোগ করতে হবে। পরে সারারাত ধরে তা দুধের মালাইতে পরিণত হবে।
কুলফির স্বাদ বাড়ানোর জন্য কুলফিতে এলাচ, দারচিনি, তেজপাতাসহ অনেক ধরনের মশলার ব্যবহারের কথা জানান জমির উদ্দিন। তবে, তিনি শুধু এলাচ ব্যবহার করেন বলে জানালেন। খুব ভোরে ঘন দুধের মালাই ছোট ছোট স্টিলের পাত্রের মধ্যে দিয়ে সিল করে দেয়া হয়। এই অবস্থাতেও কুলফি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় না। স্থানীয় বরফ কল থেকে কিনে নিয়ে আসা হয় বৃহৎ বরফ খন্ড। এগুলো ভেঙে কুচিকুচি করে সিলভারের পাতিলে ভরে ফেলা হয়। ছোট স্টিলের পাত্রগুলোকে এই বরফ কুচির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে পাতিলের মুখ খুব ভালোভাবে বন্ধ করে রাখা হয়।
পাতিলে রাখার পরই মূলত মিশ্রণটি কুলফিতে পরিণত হতে থাকে। প্রথমত, দুধের মালাই ঠান্ডা হয়ে 'কুলফি মালাই'তে পরিণত হয়। দ্বিতীয়ত, বরফ কুচিগুলো দীর্ঘক্ষণ কঠিন অবস্থায় থাকতে পারে বিধায় কুলফিগুলোও জমাট বেধে থাকে।
তবে, এই বরফ সারাদিনই ধীরেধীরে গলতে থাকে। এজন্য কুলফিওয়ালাকে প্রায়ই পাতিল খুলে ভেতরের বরফের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। পানি বেড়ে গেলে তা সাথে সাথেই ফেলে দিতে হয়।
বেচা-কেনা কেমন
প্রতিদিন রাতে জমির উদ্দিন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বাজার করেন। কুলফি তৈরির জন্য প্রায় ৫০ লিটার প্যাকেটজাত তরল দুধ কিনেন তিনি। ঘন করা দুধ থেকে প্রায় ৬০০টি কুলফি তৈরী করা যায়। প্রতিটি কুলফির মূল্য ২০ টাকা।
জমির উদ্দিনেরা পাঁচ জন মিলে কুলফি ভাগ করে নেন। তাদের মধ্যে কনিষ্ঠতম সদস্য অর্থাৎ জমির উদ্দিনের ছেলে মো. সোহেল ৫০-৬০টি কুলফি ভর্তি পাতিলটি নেয়। বরফসহ প্রায় ১২০টি কুলফি রাখা পাতিলের ওজন প্রায় ৩০-৩৫ কেজি।
প্রতিদিন কুলফি বিক্রি করে জমির উদ্দিনেরা কত টাকা আয় করে থাকেন জানতে চাইলে বলেন, 'প্রতিদিন তো আর একই হারে বিক্রি হয় না। এখন গরমের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য কুলফির চাহিদা কিছুটা বেশি। সন্ধ্যার আগেই পাতিলের সব কুলফি শেষ হয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যে ৩০-৪০ পিস কুলফি অবিক্রিত থেকে যায়। আমাদের যেহেতু ফ্রিজ নেই, সেজন্য এগুলো ফেলে দিতে হয়। এতে করে লোকসান হয়'।
'ভাগ্য সহায় থাকলে ১৮০০- ২০০০ টাকার কুলফি বিক্রি হয়। কিন্তু রাতেই আবার বাজার, নিজেদের খাওয়া-দাওয়া এবং অন্যান্য কাজে টাকা খরচ করে শেষ পর্যন্ত ৬০০-৮০০ টাকা থাকে,' জানালেন তিনি।
জমির উদ্দিনের ইচ্ছে আছে কুলফি মালাই বিক্রির জন্য ঢাকাতেই একটি দোকান স্থাপনের। একটি কুলফির পাতিল মাথায় নিয়ে সারাদিন হেঁটে বেড়ানো ভীষণ কষ্টসাধ্য কাজ, বলেন তিনি। তিনি চান না তার ছেলেও বেশিদিন এভাবে সারাদিন হেঁটে ব্যবসা করুক।
তবে, দোকানে কুলফি বিক্রি করলে তখন এখনকার মতো এত কুলফি বিক্রি হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি। জমির উদ্দিন বলেন, 'দোকান নিলে তখন কুলফির দামও বেড়ে যাবে, এতে কমে যেতে পারে বিক্রি'।