ইভ্যালির বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি
আলোচিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির বিরুদ্ধে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ত্রুটি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া, ইভ্যালির বিরুদ্ধে পাওয়া বিভিন্ন অভিযোগ সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ দ্বারা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগেও চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের উপসচিব জিন্নাত রেহানা স্বাক্ষরিত পৃথক দু'টি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবির ও জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীনের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া, ইভ্যালিকে ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবসা পরিচালনা করতে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে পৃথক চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। হাফিজুর রহমান একই সঙ্গে জাতীয় ডিজিটাল কমার্স সেলেরও প্রধান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে ইভ্যালির বিষয়ে অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করা হয়। ওইসব সুপারিশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি পাঠানো হয়েছে।
'আমরা খুব শিগগিরই ডিটিজাল কমার্স নীতিমালা চূড়ান্ত করে জারি করতে যাচ্ছি। গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে এনে ই-কমার্স সেক্টরের বিকাশ ঘটানো আমাদের অন্যতম লক্ষ্য'- যোগ করেন তিনি।
মূলত ইভ্যালির বিরুদ্ধে উঠা আর্থিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এবং গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম পণ্যমূল্য সংগ্রহের পর সময়মত পণ্য ডেলিভারি না দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে গত মাসে পুলিশ সদরদপ্তরের একটি তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে অভিযোগগুলো বিশদভাবে খতিয়ে দেখতে এ পদক্ষেপ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ইভ্যালি যাতে ভোক্তা অধিকার আইন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা এবং ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর নিয়ম-কানুন মেনে ব্যবসা পরিচালনা করে, সেজন্য নির্দেশনা দিতে মো. হাফিজুর রহমানকে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
'ইভ্যালিতে প্রোডাক্ট কিনতে হলে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করতে হয়। জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা, ২০১৮ এর পরিশিষ্ট-১ এর ১৫ অনুযায়ী ডিজিটাল কমার্স সহজীকরণ এবং ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়পক্ষের অসন্তোষ নিরসনের স্বার্থে ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতি প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে নির্দেশনা প্রদান করবে'- বলা হয়েছে চিঠিতে।
মো. হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অফিসিয়াল কাজে ঢাকার বাইরে থাকায় আমি এখনও চিঠি হাতে পাইনি। মঙ্গলবার চিঠি হাতে পাব। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।'
এছাড়া, ইভ্যালির কার্যক্রম পরিচালনায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে মনিটরিং করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবুল কুমার সাহাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
'ইভ্যালি কতগুলো অর্ডার গ্রহণ করেছে এবং কি পরিমাণ ডেলিভারি করেছে বিষয়টি মনিটরিং করে প্রতি মাসে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে'- যোগ করা হয়েছে এতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাবুল কুমার সাহা মোবাইল ফোনে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি। মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপত্র মো. সিরাজুল ইসলাম।
ইভ্যালীর বিরুদ্ধে পাওয়া বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা সংক্রান্ত চিঠি এখনও পাননি বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মোস্তফা কামাল।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ইভ্যালি নিয়ে একটি তদন্ত করে প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। তবে নতুন করে কোন তদন্তের নির্দেশনা এখনও আমার হাতে এসে পৌঁছেনি।
গত জানুয়ারিতে 'ইভ্যালিডটকম এর এন্টি কনজ্যুমার রাইট প্র্যাকটিস' বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের করা তদন্ত প্রতিবেদনে ইভ্যালির বিরুদ্ধে আট ধরণের অনিয়ম পাওয়ার কথা উঠে এসেছে। এসব অপরাধের দায়ে বিদ্যমান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন,২০০৯ এবং দন্ডবিধি ১৮৬০ এর বিভিন্ন ধারায় তিন বছরের কারাদন্ডাদেশের বিধান রয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী, ইভ্যালির এসব অপরাধের দায় কোম্পানির মালিকের ওপর বর্তায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্ডার করা পণ্য নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি না দেওয়া, গ্রাহকদের সঙ্গে যথাযথভাবে যোগাযোগ না করা ছাড়াও প্রতিবেদনে উঠে আসা ইভ্যালির বিরুদ্ধে অনিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে- কোন পণ্য শেষ পর্যন্ত ডেলিভারি দিতে না পারলে ক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া অগ্রিম টাকা সম্পূর্ণ ফেরত না দেওয়া বা ক্যাশব্যাক হিসেবে টাকা না দিয়ে ইভ্যালির ই-ব্যালেন্স দেওয়া হয় এবং সঠিক সময়ে রিফান্ড না করা।
ক্যাশব্যাক অফারের মাধ্যমে পাওয়া অর্থ নগদ বা ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে ফেরত না দিয়ে ই-ওয়ালেটে যোগ করা এবং ই-ব্যালেন্স থেকে পণ্য কেনার সময় ১০০% ব্যবহার করতে না দেওয়ার অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর। এছাড়া, ইভ্যালি অর্ডার করা পণ্যের বিপরীতে অনেক সময় অন্য পণ্য, কমমূল্যের পণ্য ও মানহীন পণ্য সরবরাহ করে বলেও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
২০১৮ সালের ১৪ মে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধিকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নিয়ে একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর ইভ্যালি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। মাত্র ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই কোম্পানির বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি টাকা। ইভ্যালীর নিবন্ধিত গ্রাহক ৩৭ লাখেরও বেশি এবং মাসিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ইভ্যালি শুরুর দিকে ভাউচার নামক একটি পদ্ধতি চালু করে। এ পদ্ধতির আওতায় বিভিন্ন পণ্যে ২০০-৩০০% পর্যন্ত ক্যাশব্যাক করতো। বর্তমানে ১০০-১৫০ পর্যন্ত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৪০% পর্যন্ত ক্যাশব্যাক সুবিধা দিয়ে থাকে। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় চার হাজার ধরণের পণ্য বিক্রি করে কমিশন পাচ্ছে ইভ্যালি। মোবাইল ফোনসেট, মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন এমনকি গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ সকল ধরণের পণ্য ইভ্যালি বিক্রি করছে।
ইভ্যালি মূলত ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে। যেমন-গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডারকৃত পণ্য তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোন প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহ করে এবং তা থেকে কমিশন লাভ করে। ইভ্যালির পেমেন্ট পদ্ধতি দেশের অন্য সকল অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন। এখানে ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতি মানা হয় না বরং পণ্য সরবরাহের পূর্বেই মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে ক্রয়কৃত পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়।
অনলাইনে পণ্য কিনলে সময় বাঁচে এবং ঝূঁকি ঝামেলা এড়ানো যায়, একই সঙ্গে ইভ্যালির ১০০-১৫০% ক্যাশব্যাকসহ বিভিন্ন লোভনীয় অফারে ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়ে ইভ্যালির দিকে ঝুকছে।
ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মো. রাসেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে বিএসসি (অনার্স) সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে ঢাকা ব্যাংকে প্রায় দুই বছর চাকরি করার পর ইভ্যালি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।