ইয়ং মেনস ক্লাব: জুয়া-ক্যাসিনোয় হারিয়ে গেছে যে সোনালি অতীত
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2019/09/26/young_mens_club.jpg)
ফকিরেরপুল ইয়ং মেনস ক্লাব। ঢাকার অন্যান্য ক্লাবগুলোর তুলনায় সেভাবে কখনো তুমুল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে পারেনি, পারেনি বড় বড় শিরোপা জিততে কিংবা ফুটবলের মাঠে আলো ছড়াতে। তবে ক্লাবটির একটা বিশেষ দিক ছিলো, যা নিয়ে গর্ব করা যায় ঠিক অন্যান্য বড় ক্লাবগুলোর মতোই। ক্লাবটি এমন সব খেলোয়াড়ের সৃষ্টি করেছে যারা বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসকে রাঙিয়ে গেছেন। পাদ প্রদীপের সামান্য আলোয় টিকে থাকা সেই ক্লাবটিই ক্যাসিনোকাণ্ডে বহুবছর পর সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে, আলোচনায় এসেছে দেশজুড়ে।
১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দুই দশক পর তাদের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়ে পৌঁছায়। ৮০’র দশকে এই ক্লাব থেকে বেরিয়ে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নেন মনির হোসেন মনু, হাসান আল মামুন, মোহাম্মদ পনির এবং গোলাম রাব্বানী ছোটনের মতো ফুটবল তারকারা।
৮০’র দশকের ফুটবল তারকা বর্তমানে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে হাসিমুখেই জানালেন ফকিরেরপুলের এই ক্লাবটি ঘিরে তার নানান স্মৃতিগাঁথা।
“প্রতিদিন একটা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ক্লাবে প্র্যাকটিস করতে যেতাম আমি। শুরুতে এটা একটা টিনশেড বিল্ডিং এর মতো ছিল। আমাদের ক্লাবটা তখন খুব একটা বিখ্যাত বা খুব একটা বড় কিছু ছিলো না। তবে আমাদের সবার মধ্যে যেটা ছিলো, তা হচ্ছে তীব্র আবেগ, ভালোকিছু করার প্রবল তাড়না। বড়বড় ক্লাবগুলো যেমন স্থানীয়দের সমর্থন পেত, তেমনি এই ক্লাবটাও স্থানীয় ফুটবল প্রেমীদের সমর্থন পেত।”
খেলোয়াড়দের বাইরেও এই ক্লাবটির সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে ক্লাব কর্মকর্তাদের কঠোর পরিশ্রম এবং ত্যাগ। ক্লাবটির কিংবদন্তীতুল্য কর্মকর্তা মনজুর হোসেন মালু ক্লাবটিকে নিজের পরিবারের মতোই ভাবতেন।
মনজুর হোসেন মালুর কথা বলতে গিয়ে গোলাম রাব্বানী ছোটন জানান, “মাঝে মাঝে খুব কঠিন প্র্যাকটিস শেষে দেখতাম মালু ভাইয়ের বাসা থেকে আমাদের জন্য খাবার এসেছে। মালু ভাই এবং তাঁর স্ত্রী আমাদেরকে তাদের পরিবারের অংশই মনে করতেন। ক্লাবের মঙ্গল ঘিরেই ছিলো তাদের সব ভাবনা।”
গোলাম রাব্বানী ছোটন ক্লাবটি ঘিরে খেলোয়াড়দের যে তীব্র নিবেদনের কথা বলেছেন সময়ের সাথে সাথে সেটিই ক্লাবটিকে নিয়ে যায় অনেক ওপরে। শীর্ষ পর্যায়ে খেলার যোগত্যা অর্জনের পর প্রথম দেখাতেই ঢাকার ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি আবাহনীকে হারিয়ে দেয় ফকিরেরপুল ইয়ং মেনস ক্লাব। তাদের সাফল্য এবং খেলার ধরণ মুগ্ধ করে ঢাকার বড় ক্লাবগুলোকে।
ভালো ফলাফলের জন্য, অবশ্য এর পরই চড়া মূল্য দিতে হয় ক্লাবটিকে। ১৯৯০ সালে ইয়ং মেনস থেকে খেলোয়াড়রা অন্য ক্লাবে নাম লেখাতে শুরু করে।
গোলাম রাব্বানী ছোটন বলেন, “সাফল্যের জন্য লীগের সেরা ক্লাবগুলোর কর্তৃপক্ষের নজরে আমরা পড়ে যাই। এর পরের সিজনেই ১৫ জন প্লেয়ার দল ছেড়ে চলে যায়। এদের অধিকাংশই ব্রাদার্স ইউনিয়নে যোগ দেয়। ক্লাবের নিয়মের কারণে আমি যেতে পারিনি, তাই ক্লাব আর পাল্টানো হয়ে ওঠেনি আমার।”
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2019/09/26/young_mens_club_2.jpg)
তবে এই ধাক্কা সামাল দিয়ে, নব্বইয়ের দশকে ইয়াং মেনস ক্লাব একের পর এক প্রতিভাবান আর তারকা খেলোয়াড় সৃষ্টি করতে থাকে। ক্লাবটি কখনো বড় কোন ট্রফি উঁচিয়ে না ধরতে পারলেও ক্লাবের সমর্থকরা ক্লাবটিকে ছেড়ে যায়নি। হৃদয় দিয়ে নিজেরাই নিজেদের এই অতি-আপন ইয়ং মেনসকে উঁচু করে রেখেছিলেন।
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ছোটন বলেন, “এই এলাকাটি এমনিতেও খেলোয়াড় বের করে আনার ক্ষেত্রে বিখ্যাত ছিলো। ইয়াং মেনসও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আমাদের এই ক্লাব শিবির থেকে বহু ভালো খেলোয়াড় উঠে এসেছে এবং তাদের অনেকেই জাতীয় দলের হয়ে খেলেছে।”
তবে নব্বই এর দশকেই ক্লাবটির দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসে। স্থানীয় জনগনের চিরচেনা ফকিরেরপুল ইয়াং মেনস ক্লাব তার খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের কাছে ধীরে ধীরে অচেনা হতে থাকে।
ঘরোয়া আড্ডার তাস এবং বোর্ড গেইম গুলো বাড়ার সাথে সাথে বহিরাগতদের আনাগোনাও ক্লাবে বেড়ে যায়। অল্প থেকে বাড়তে বাড়তে বড় মাত্রার জুয়া ক্লাবে বাড়তে থাকে, কমতে থাকে ফুটবলের প্রতি ক্লাব সংশ্লিষ্টদের পুরনো নিবেদন, পুরনো আবেগ।
ছোট পর্যায়ের ফুটবলে দলটি তাদের সাফল্য ধরে রাখলেও বড় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় এখন আর ক্লাবটির আগের সেই জৌলুশ নেই। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেও আর্থিক সংকটের কথা বলে শেষমেশ নিজেদের সরিয়ে নেয় দলটি।
বহু আগে চালু হওয়া সেই জুয়ার আসর সময়ের সাথে সাথে অবৈধ ক্যাসিনো হয়ে সম্প্রতি ধরা পড়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বহু মানুষের শ্রম, ঘামে গড়া ক্লাবটি যেখানে খবরের শিরোনাম হতে চেয়েছে তাদের খেলা দিয়ে, সেখানে ক্লাবটি শহরের অন্যতম আলোচিত গল্প হয়েছে অবৈধ ক্যাসিনোর কারণে।
ক্ষুদ্র মানসিকতার একশ্রেণীর লোভীর হাতে সর্বস্ব হারানো এই ক্লাবটি ঘিরে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। কি হবে ক্লাবটির বর্তমান খেলোড়ারদের?
দুয়ারে কড়া নাড়ছে নতুন ফুটবল মৌসুম। কিছুদিনের মধ্যেই ক্লাবগুলোতে খেলোয়াড় অদল-বদল শুরু হয়ে যাবে। ইয়াং মেনস কি তাদের গঠন করতে পারবে? যদি গঠন করতে পারেই, তবে আর্থিক দিকটা কিভাবে সামাল দেবে টিম ম্যানেজমেন্ট, সেসব প্রশ্নও উঠেছে।
আর প্রশ্নগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় উদ্বেগের কারণ। গোলাম রাব্বানী ছোটনও সে কথাই বলছেন। তার মতে, যা কিছুই ঘটুক, ফুটবল কখনো থেমে থাকতে পারে না।
“খেলাটাকে চালাতেই হবে। ঢাকার ক্লাবগুলোতে যে ঘটনা ঘটেছে, সে ঘটনার পরম্পরায় খেলোয়াড়দের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উচিত না। এ বিষয়টি এখন ফুটবল ফেডারেশন এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছে। তাদের উচিত ক্লাবগুলোর ফুটবলারদের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা।”
কর্তৃপক্ষ এবং দেশের ফুটবল সংঘগুলো ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবটির বর্তমান সংকট সমাধানে কি ব্যবস্থা নেয় সেটা এখন দেখার বিষয়। ক্লাবটি তার হারানো অতীত ফিরে পাবে কি পাবে না তা সময়ই বলে দেবে। তবে তার আগ পর্যন্ত এই ক্লাবটির খেলাধুলা বিষয়ক কার্যক্রমকে যারা দীর্ঘ সময় ধরে সমর্থন যুগিয়ে এসেছেন তাদের মন ও মননে ক্লাবটি সবসময় তাদের প্রিয় ফকিরেরপুল ইয়ং মেনস ক্লাব হিসেবেই বেঁচে থাকবে, অবৈধ ক্যাসিনো হয়ে নয়।