ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দিয়ে গাড়ি চালককে আটক করল পুলিশ
চার যুবক চট্টগ্রামের লালদিঘী এলাকা থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য একটি প্রাইভেটকার ভাড়া করে। এই চার যুবকের সাথে ছিল দুটি প্ল্যাস্টিকের ক্যারেট (খাঁচা)। বেশকিছু কবুতরের বাচ্চাসহ ক্যারেট দুটি রাখা হয় গাড়ির পেছনে বাক্সে। ঢাকা যাওয়ার পথে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে পুলিশ গাড়িটি থামায় এবং গাড়ির পেছনে রাখা ক্যারেটগুলো থেকে তিন হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের দাবি করে। কিন্তু যারা এই ক্যারেট দুটি ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে তুলেছিল, পুলিশ তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে চালককে গ্রেফতার করে!
অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ গাড়ি চালক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে তা না পেয়ে চালককে আদালতে চালান দেয় এবং চার ইয়াবা ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেয়।
গাড়ির মালিক মো. লিটন বলেন, "২৭ মে রাত দশটার দিকে চারজন লোক চট্টগ্রাম নগরের লালদিঘী এলাকা থেকে আমার প্রাইভেট কারটি (চট্টমেট্রো-গ-৮৬৪৯) ঢাকার পোস্তগোলা এলাকায় যাওয়ার জন্য ৮ হাজার টাকায় ভাড়া করেন। রাত তিনটার দিকে গাড়িটি দাউদকান্দি ব্রীজের কাছে পৌঁছালে বলদাখাল চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি তল্লাশি করে যাত্রীদের বহন করা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা পায়। ইয়াবা উদ্ধারের পর দায়িত্বে থাকা পুলিশের এসআই হারিছুল হক আমাকে টাকার বিনিময়ে 'ঝামেলা নিষ্পত্তি' করার প্রস্তাব দেন। আমি সে প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গাড়ি আটকের একঘন্টা পর গাড়িতে থাকা ইয়াবা কারবারিদের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়ে নিরীহ গাড়ি চালক মো. আলমগীরকে তিন হাজার পিস ইয়াবাসহ কোর্টে চালান দেয়।"
সাংঘর্ষিক বিবৃতি
ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় বাদি উপ-পরিদর্শক হারিছুল হক উল্লেখ করেছেন, ২৭ তারিখ রাত ২ টা ১৫ মিনিট নাগাদ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তিনি জানতে পারেন কক্সবাজার থেকে একটি প্রাইভেট কার মাদকদ্রব্য নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। সেই সংবাদের ভিত্তিতে দাউদকান্দি-বলদাখাল চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামায়। এ সময় গাড়ি চালক মো. আলমগীর দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে তাকে আটক করা হয়, পরে তার দেখানো তথ্য অনুযায়ী গাড়ির পেছনে একটি শ্যাওলা রংয়ের প্লাস্টিকের ট্রে থেকে চারটি পোটলা বাঁধা ৩ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। কিন্তু যারা গাড়ির যাত্রী ছিলো বা ক্যারেটগুলো নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের এই মামলায় আসামি করা হয়নি।
পুলিশের দাবি অনুযায়ী ইয়াবাসহ আটক গাড়িটি কক্সবাজার থেকে ঢাকা যাচ্ছিলো। কিন্তু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২৭ মে রাত দশটার দিকে শাহিন নামে এক ব্যক্তি মুঠোফোনে ঢাকায় বন্ধুর বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করে মালিক লিটনের কাছ থেকে। রাত ১০টা ১০ মিনিটে চট্টগ্রামের লালদিঘী মোড়ের সোনালী ব্যাংকের সামনে থেকে শাহিনসহ চার যাত্রী নিয়ে চালক আলমগীর গাড়ি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সঙ্গে ছিলো চার যাত্রীর দুটি প্লাস্টিকের ক্যারেট।
ওইদিনের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও স্থির চিত্রে দেখা যায়, রাত ১০টা ৫ মিনিটে চট্টগ্রাম শহরের লালদিঘী মোড়ের সোনালী ব্যাংকের উল্টো পাশের ফুটপাতে দুটি প্লাস্টিকের ক্যারেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই যুবক। সঙ্গে আছেন গাড়ি মালিক লিটন ও গাড়ি ভাড়াকারী শাহিন ও আরও এক যুবক। তিন মিনিট পর ১০টা ৮ মিনিটে সেখানে এসে পৌঁছায় গাড়িটি। ১০টা ৯ মিনিটে চালক আলমগীর গাড়ির পেছনের ডালাটি খুলে দেন। এসময় চার যাত্রীর দুইজনের হাতে থাকা দুটি প্লাস্টিকের ক্যারেট গাড়ির পেছনে রাখেন। এ সময় যাত্রীদের তিনজনের কাঁধে তিনটি ব্যাগ ছিল। ১০টা ১০ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে গাড়ি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অথচ পুলিশের মামলায় যাত্রীদের বহনকরা প্লাস্টিকের ক্যারেট থেকে ইয়াবা পাওয়ার দাবি করা হলেও, গাড়ির ওই চার যাত্রীর বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।
তবে মুঠোফোনে কথা বলার সময় গাড়ির দুই যাত্রীর পালিয়ে যাওয়া ও অপর দুই যাত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে স্বীকার করেছেন মামলার বাদি উপ-পরিদর্শক হারিছুল হক।
তিনি বলেন, "গাড়িতে চালকসহ পাঁচজন ছিল। এরমধ্যে গাড়ি থামানোর পর পরই প্রকৃত মালিক (ইয়াবার) সহ দুইজন পালিয়ে যায়। বাকি দুজন 'বাচ্চা ছেলে' হওয়ায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।" যদিও সিসিটিভির ফুটেজ ও ওই দিনের ছবি অনুসারে গাড়িতে যেসব যাত্রী ছিলো তাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
এমনকি মামলায় গাড়ি চালক মো. আলমগীরের দেখানো তথ্য অনযায়ী গাড়ির পেছনে থাকা প্লাস্টিকের ক্যারেট থেকে ইয়াবা উদ্ধারের দাবি করা হলেও উপ-পরিদর্শক হারিছুল হক এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন গাড়িচালক নয় বরং গাড়িতে থাকা দুজনই তাদের গাড়ির পেছনে ইয়াবা থাকার কথা জানিয়েছে।
হারিছুল বলেন, "প্রকৃত মালিক তো পালিয়েছে, আমরা তখন ইয়াবা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওই বাচ্চা ছেলে দুইটাই তখন গাড়ির পেছনে ইয়াবা দেখায় দিছে।"
তাহলে মামলায় পালিয়ে যাওয়া দুইজন ও ইয়াবার খোঁজ দেওয়া দুইজনের বিষয়ে কেন উল্লেখ নেই এমন প্রশ্নের জবাবে হারিছুল কোনো উত্তর দেন নাই।
পুলিশের মামলাটিতে সাক্ষী করা হয়েছে দাউদকান্দি ব্রিজের টোল কর্মী রাজিবকে। তিনি বলেন, "একটি গাড়ি আটকের পর পুলিশ আমাকে ডেকে নিয়ে বলে ওই গাড়ি থেকে তিন হাজার ইয়াবা পাওয়া গেছে। এসময় পুলিশ আমাকে একটা কাগজে সাইন করতে বললে আমি করেছি।" তবে তিনি গাড়ি থেকে ইয়াবা উদ্ধার হতে দেখেন নি।
গাড়িচালক আলমগীরের স্ত্রী সাদিয়া সুলতানা লিজা বলেন, "আমার স্বামী একজন অসহায় গাড়ি চালক। মালিকের ফোন পেয়ে তিনি গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন। এখন শুনেছি তাকে ইয়াবাসহ আটক করা হয়েছে। মূলত তাকে পুলিশ ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আমার দেড়মাসের বাচ্চা নিয়ে এখন কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না।"
লালদীঘি রেন্ট-এ-কার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইব্রাহীম বলেন, "আটক গাড়ি চালক আলমগীরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তার অতীতে এমন কোনো রেকর্ড নেই। এসব চালকরা নিরীহ। ভাড়া পেলেই বেতন পায়। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।"
গাড়ির খোঁজে গিয়ে থানা হাজতে ষাট বছরের বৃদ্ধা, ৫০ হাজার টাকায় রফাদফা
গাড়ি মালিক লিটন অভিযোগ করেছেন, গাড়ি আটকের পর প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য কুমিল্লায় থাকা তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শ্যালক ও বৃদ্ধা শাশুড়ি শাহিনুর বেগমকে দাউদকান্দি থানায় পাঠালে, এসআই হারিছুল হক তাদের 'ইয়াবা ব্যবসায়ী' বলে হাতকড়া পরিয়ে থানা হাজতে বন্দি করে রাখে এবং মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। পরে তার হুমকিতে জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তিন ঘন্টা বন্দি থাকার পর তারা থানা হাজত থেকে মুক্তি পায়।
ভুক্তভোগী শাহিনুর বেগম বলেন, "আমার ছেলেসহ আমি দাউদকান্দি পুলিশ চেকপোস্টে গিয়ে গাড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে, আমাদের ইয়াবা ব্যবসায়ী বলে থানা হাজতে আটকে রাখা হয়। পরে এক আত্মীয় টাকা-পয়সা দিয়ে আমাদের ছাড়িয়ে আনে।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দাউদকান্দি মডেল থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, "এগুলো ভিত্তিহীন কথা।"
উপ-পরিদর্শক হারিছুল বলেন, "ঘটনার পরে রবিন আর তার মা গাড়ি ছাড়াবার জন্য আসছিলো। তারা তিন ঘন্টা আমাদের কাস্টডিতে ছিলো।" টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।"
এদিকে এ ঘটনায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি বরাবর অভিযোগ করেছেন গাড়ির মালিক মো. লিটন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, "এ ঘটনা যদি ঘটে থাকে তা খুব খারাপ হয়েছে। আমি ইতোমধ্যেই বিষয়টির ব্যাপারে কুমিল্লার পুলিশ সুপারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। তারা এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।"