উদ্বোধন হলেও কাজে আসবে না মৈত্রী সেতু, এখনো অসম্পূর্ণ রামগড় স্থলবন্দরের অবকাঠামো
সম্প্রতি উদ্বোধন করা হয়েছে রামগড় স্থলবন্দরকে ঘিরে নির্মিত 'ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু-১'। তবে সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হলেও আপাতভাবে কোন কাজে লাগছে না এই সেতু। এখনই চালু হচ্ছে না বহুল প্রত্যাশিত রামগড় স্থলবন্দরটি। কেননা এখনো শুরুই করা হয়নি স্থলবন্দরের অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণের কাজ। এছাড়া বন্দর সংশ্লিষ্ট রামগড়-বারৈয়ারহাট সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের জন্য দরপত্রও আহবান করা হয়নি এখন পর্যন্ত।
স্থলবন্দরটির অবকাঠামো নির্মাণের পর আমদানি ও রপ্তানী চালু করতে আরও প্রায় আড়াই বছর সময় লাগতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। স্থলবন্দরের কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়া অবধি কোনপ্রকার পণ্য আমদানি ও রপ্তানী সম্ভব নয় বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ।
'বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রকল্প-১' -এর আওতায় স্থাপিত হচ্ছে এই রামগড় স্থলবন্দর। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত ফেনী নদীর বাম তীরে (ফেনী নদীর কূল) স্থলবন্দরটি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ সাঈদ মোমেন মজুমদার বলেন, 'স্থলবন্দরের অবকাঠামোসহ যাবতীয় স্থাপনা নির্মাণের জন্য ১০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিলো। যার মধ্যে ০.২৭ একর আবাসিক ভূমি এবং অবশিষ্ট ৯.৭৩ একর কৃষি জমি। অধিগ্রহণকৃত এই ১০ একর ভূমিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার রয়েছে ৬১টি। অধিগ্রহণকৃত ভূমির অনুকূলে তাদের পুনর্বাসন ব্যয় প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে ক্ষতিপূরণের প্রায় ৬০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে এবং শীঘ্রই ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণ টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের প্রদান করা হবে।'
তবে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের অর্থপ্রাপ্তির বিষয়ে ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের। পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি এখনো চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়নি বলে স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। তবে নিষ্পত্তি না হলেও বিরোধপূর্ণ ভূমি বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারীর শেষ দিকে অধিগ্রহণকৃত ভূমি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হয় বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক।
'বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রকল্প-১' -এর প্রকল্প পরিচালক মো. সারোয়ার আলম (যুগ্ন-সচিব) বলেন, 'স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য আগ্রহী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে গত ডিসেম্বরের শেষদিকে দরপত্র আহবান করা হয়। যেখানে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে আগ্রহী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবেদন করতে বলা হয়েছিলো। ইতিমধ্যে দেশী এবং বিদেশী ৭টি নামকরা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন করেছে। এখন তাদের আবেদন মূল্যায়ন করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে স্থলবন্দর নির্মাণের অনুমতি প্রদান করা হবে। এরপর চলতি বছরের ১লা জুলাই থেকে বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এবং ২০২৩ সালের ৩০ জুন এই কাজ সমাপ্তির জন্য প্রাথমিকভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হবে এই স্থলবন্দরটি'।
তবে প্রয়োজনে এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে বলেও ধারণা দিয়েছেন তিনি।
এখানে নির্মিত হবে- সীমানা প্রাচীর ও গেইট ঘর, ওয়ান স্টপ বন্দর ভবন (চেক পোস্ট), কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন, শৌচাগার, শ্রমিক শেড, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ট্রান্সশিপমেন্ট শেড এবং গুদাম ঘর, আরসিসি ফুটপাথ এবং স্ট্যাক ইয়ার্ডস ও পথচারীদের ওভারপাস ইত্যাদি। একইসাথে অভ্যন্তরীণ বিদ্যুতায়ন এবং প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম স্থাপন করা হবে।
মো. সারোয়ার আলম আরও বলেন, 'এইসব অবকাঠামো নির্মাণ না করা পর্যন্ত কোনভাবেই পণ্য আমদানি-রপ্তানীর সুযোগ নেই। আমদানি-রপ্তানী করতে হলে বন্দরে পণ্যগুলো খালাস করতে হয়। এছাড়া আরও কিছু জটিল প্রক্রিয়া রয়েছে যেগুলো বন্দর পুরোপুরি প্রস্তুত না হলে সম্ভব নয়। আর এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আড়াই বছরের মতো'।
বারৈয়ারহাট-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প
গেল বছরের ১৮ আগস্ট বারৈয়ারহাট থেকে হেঁয়াকো হয়ে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়কের প্রশস্তকরণ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিলো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। তবে এখনো শুরু করা হয়নি প্রকল্পটির কাজ।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৪৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ক্রেডিট লাইনের ঋণের অংশ হিসেবে ৫৮১ কোটি ২০ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। বাকী টাকা আসবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, 'বারৈয়ারহাট থেকে স্থলবন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ কিলোমিটারের সড়কটি বর্তমানে বেশ সরু। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তা ৫ দশমিক ৫ মিটার থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থে উন্নীত করা হবে।'
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঠিকাদার নিয়োগের জন্য শীঘ্রই দরপত্র আহবান করা হবে এবং এরপরই শুরু করা যাবে সড়কটির প্রশস্তকরণের কাজ। আর তা শেষ হতে সময় লাগবে অন্তত দুই থেকে তিন বছর। প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে সড়কটি উভয় দেশের যোগাযোগ খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় ৯টি সেতু ও ২৩টি কালভার্ট এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা (জাইকা)'র অর্থায়নে এই সড়কটিতে ৮টি সেতু ও ৮টি কালভার্ট নির্মিত হতে যাচ্ছে।
তবে স্থলবন্দর থেকে রামগড়-খাগড়াছড়ি সড়কটি সংস্কার কিংবা প্রশস্তকরণে আপাতত সরকারের কোন পরিকল্পনা নেই বলে জানালেন খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সবুজ চাকমা। এই সড়কটি প্রশস্ত করা হলে স্থলবন্দরকে ঘিরে খাগড়াছড়ির ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও প্রসারিত হবে।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু-১ উদ্বোধন
গত ৯ মার্চ ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী 'বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১' এর উদ্বোধন করেছেন। ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু খাগড়াছড়ি'র রামগড়ের সঙ্গে ত্রিপুরার সাবরুমকে যুক্ত করেছে। এর ফলে প্রথম কোনো সেতুর মাধ্যমে এই দুটি দেশের সীমান্ত যুক্ত হলো। ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরামসহ পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ৬ জুন দুই প্রধানমন্ত্রী এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
১৩৩ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত এ সেতু থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৭২ কিলোমিটার। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম বন্দরের হাতের নাগালে চলে আসবে, যা এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আমরা এমন একটি অঞ্চলে আছি, যেখানে কানেকটিভিটি চালুর বিষয়ে রক্ষণশীলতা ছিলো এবং যেখানে সম্ভাবনার চেয়ে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য অনেক কম।'
'আমরা ভারতকে কানেকটিভিটি দেওয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন যুগের সৃষ্টি করেছি'।
অন্যদিকে সেতুটিকে দুই দেশের মধ্যে নতুন 'বাণিজ্য করিডোর' হিসাবে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের বাণিজ্য ও মানুষে মানুষে সংযোগের ক্ষেত্রে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো।
বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু উভয় দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এই সেতুর মাধ্যমে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরামসহ ৭ রাজ্যের (সেভেন সিস্টার) সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় পণ্য পরিবহণের খরচ ও সময় কমবে। এছাড়াও সংস্কৃতি ও পর্যটন ইত্যাদির প্রসার ঘটবে এবং এতে উভয় দেশই উপকৃত হবে। এর ফলে কেবল দু'দেশের অর্থনীতিরই ভিত মজবুত হবে না, একইসঙ্গে দু'দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কেরও বিকাশ ঘটাবে। তবে স্থলবন্দর পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত এই সেতুর সুফল পুরোপুরি ভোগ করা যাবে না।