কেমন আছেন মিরপুরের বিহারিরা
ঘরের মেঝেটি স্যাঁতসেঁতে, ফাটল-ধরা দেয়াল। এই এক রুমের বাসাটিতেই ৬ থেকে ১০ জনের একটি পরিবারের বাস। এলাকায় পানির সরবরাহ অপর্যাপ্ত। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা চরম অস্বাস্থ্যকর। চলাচলের রাস্তার খুবই বাজে দশা। এমনসব দৃশ্যই চোখে পড়বে মিরপুর ক্যাম্পজুড়ে। যেখানে উর্দুভাষী প্রায় ৮০ হাজার লোকের বাস। ‘বিহারি’ নামেই তারা পরিচিত। এখন জীবনধারণের এ সীমিত সুযোগগুলোও হারাতে বসেছেন তারা। কারণ যে কোনো সময় উচ্ছেদ করা হতে পারে তাদের।
মুক্তিযুদ্ধের পর বিহারিদের দেশের বিভিন্ন কলোনিতে আটকে রাখা হয়। তাদের বেশিরভাগই আশ্রয় নেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার জেনেভা ক্যাম্পে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিন থেকে সাড়ে চার লাখ বিহারির মধ্যে অর্ধেকেরও বেশির বাস ঢাকাতেই।
মিরপুর-১১ এলাকার বিহারি ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করে দেখা যায় কী ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে বসবাস করছেন তারা। পানির সংযোগ বন্ধ হয়ে গেলে একমাত্র ভরসা পানির পাম্পটি। অতঃপর পাম্পের সামনে লেগে যায় বিশাল ভিড়। এসব এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
উর্দুভাষী যুব পুনর্বাসন আন্দোলন বাংলাদেশের (ইউএসওয়াইআরএমবি) সভাপতি সাদাকাত খান ফাক্কু বলেন, "মিরপুরের ক্যাম্পগুলোর বাসিন্দারা উচ্ছেদের হুমকির মুখে আছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন দলের লোকজন তাদের ভয়ও দেখাচ্ছে।সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ রাস্তা থেকে অবৈধ স্থাপনা সরানোর নামে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে চায়। তবে তারা আমাদের পুনর্বাসনের জন্য কোনো নির্দেশনা দেয় না। আমরা কোথায় যাব?”
অতীতেও তারা এরকম বিপদের মুখোমুখি, কেউ তাদের কান্নায় সাড়া দেয়নি বলে জানালেন সাদাকাত।
"একাধিকবার আমাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। আগে থেকেই জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে।"
কর্তৃপক্ষের কাছে তার অনুরোধ, কোনো কিছু করার আগেই যেন তাদের যথাযথ পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হয়।
৯ সেপ্টেম্বর মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বিহারিদের বাসস্থানের বিষয়টি নিয়ে এক আদেশে দু’মাসের জন্য স্থিতি অবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এবং ডিএনসিসিসহ ২৪ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রুলও জারি করা হয়।
কিন্তু নির্ধারিত সময়টুকু শেষ হওয়ার পর কী হবে সেটি নিয়ে এখনও নিশ্চিত নন ক্যাম্পে বসবাসকারীরা।
"আমরা কোনো জমি কিনতে পারি না। আমাদের কোথাও বাড়ি নেই... আমরা অন্যায় কিছু চাইছি না। কেবল বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকার সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি," বলেন এডিসি বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা লিটন।
"কেউ আমাদের নিয়ে কথা বলেন না। আমাদের মধ্যে কেউ যদি উন্নত জীবনযাপনের জন্য আইনিভাবে জমি কিনতে চান, তবে ‘বিহারি’ হওয়ার কারণে তাকে বঞ্চিত হতে হয়," যোগ করেন তিনি।
বিহারিদের তুলনায় কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অনেক বেশি সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে ছেচল্লিশ বছর ধরে এদেশে আটকে পড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তাদের জীবনযাপনের কথা বললেন লিটন।
মিরপুর-১১ এলাকার স্থানীয় বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা মাকসুদ খান বলেন, তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি হয়েছে খুবই কম, বলতে গেলে হয়নি।
"আটকে থাকা প্রত্যেক বিহারির ভাগ্য একই রকম... আমরাও বাংলাদেশের নাগরিক। আমি নিজে এখানে জন্মগ্রহণ করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই আশ্বাস দিয়েছেন যে আমাদের অধিকার সংরক্ষণ করা হবে। তবে আমরা এখনও এর কোনো সুফল দেখতে পাইনি।"
মকসুদ বলেন, বিহারি শিশুদের পড়াশোনা ও বিনোদনের ব্যবস্থাও অপ্রতুল। কয়েকটি এনজিওর সহায়তায় কিছু স্কুল খোলা হলেও আর্থিক সহায়তার অভাবে সেগুলো বন্ধ করে দিতে হয়েছে। শিশুদের খেলার জন্য কোনো মাঠ নেই বলেও জানান তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ বিশ্লেষণ’ নামে এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উল্লিখিত অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বিহারিদের পুনর্বাসন কাজের জন্য কোনো ধরনের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
এদিকে, যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে বেনারসি শিল্প। মিরপুরের বিহারি জনগোষ্ঠীই এই শিল্পের প্রধান কারিগর হিসেবে এতদিন কাজ করে এসেছেন। কিন্তু এখন এই জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠছে ছোট কোনো ব্যবসা বা স্বল্প সময়ের চাকরি।
"খুব কম বিহারিরই তাদের পৈত্রিক পেশা বেনারসি বুনন এবং কারচুপির শিল্প শেখার প্রতি আগ্রহ রয়েছে," জানান ফুটবল গ্রাউন্ড বিহারি ক্যাম্পের এক বাসিন্দা।
ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, "বেশিরভাগ বিহারির জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভোট দেওয়ার অধিকার থাকলেও পাসপোর্ট করার অনুমতি পান না তারা।"
তিনি বলেন, "পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার সময় স্থায়ী হিসেবে বিহারি ক্যাম্পের ঠিকানা ব্যবহার করলে আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। কেননা এই ঠিকানাকে নিশ্চিতভাবে ‘স্থায়ী’ ঠিকানা হিসেবে ধরা হয় না।"
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, মিরপুর ও ডিএনসিসির বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে নির্মিত অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। তবে অবৈধভাবে রাস্তা দখল না হয়ে থাকলে কাউকে উচ্ছেদ বা বাস্তুচ্যুত করা হবে বলেও জানিয়েছেন মেয়র।