খেয়ে না খেয়ে দিন যায় টাঙ্গাইল যৌনপল্লীর বাসিন্দাদের
লিজা বেগম (৪৫)। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে টাঙ্গাইল যৌনপল্লীতে বসবাস করেন তিনি। প্রতিদিন যা আয় হয় তা দিয়ে ঘর ভাড়া, খাবারসহ যাবতীয় খরচ বহন এবং মাস শেষে বৃদ্ধ মাকে সহযোগিতা করতেন। গত প্রায় চার মাস ধরে করোনাভাইরাসের কারণে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। কাস্টমার না আসায় তার আয়ের পথও বন্ধ। অর্ধহারে-অনাহারে কোনমতে দিন কাটে তার।
শুধু লিজা বেগমই নয়, লিজার মতো টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়া যৌনপল্লীর প্রায় ছয় শতাধিক কর্মী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ পরিস্থিতিতে তারা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার দাবি করছেন।
লিজা বেগম বলেন, গত ১৯ বছর যাবত এই পল্লীতে আছি। ১৯ বছরে ৩৮টি ঈদ খুব আনন্দের সঙ্গে পার করেছি। ঈদের তিনদিন প্রচুর কাস্টমার থাকতো। অন্যদিনের তুলনায় ঈদের সময় কয়েকগুণ বেশি টাকা আয় করতাম। সেই টাকা দিয়ে হতো ঈদের কেনাকাটা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে গত ঈদুল ফিতরে কাস্টমারও ছিল না। কোনো টাকা আয় করতে পারিনি।
''গত ঈদে মেয়েকে নতুন কাপড় কিনে দিতে পারিনি, নিজেও একটি সুতা কিনতে পারিনি। সন্তান নিয়ে শুধু ঈদ নয় প্রতিটি দিন খুব কষ্টে পার করতে হচ্ছে। এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা না খেয়েও পার করতে হচ্ছে। কোরবানীর ঈদও খুব কষ্টে পার করতে হবে'', বললেন লিজা বেগম।
২০০ বছরের পুরোনো কান্দাপাড়া যৌন পল্লীটি ৩০২ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ৫৯টি বাড়িতে প্রায় ৬০০ যৌনকর্মী রয়েছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২০ মার্চ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি জনকে ৩০ কেজি করে চাল দিয়ে এই পল্লী লকডাউন ঘোষণা করে। এর পর ঈদুল ফিতরের আগে প্রতি সদস্যকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ৫০০ করে টাকা দেওয়া হয়।
গত মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কান্দাপাড়া যৌনপল্লীর প্রতিটি অলিগলির রাস্তা ফাঁকা। যৌনকর্মী ছাড়া আর কেউ নেই ওই এলাকায়। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ব্যাগ ও হাতে খাতা কলম দেখে কয়েকজন যৌন কর্মী এগিয়ে আসেন ত্রাণ সামগ্রী পাওয়ার আশায়। ত্রাণ সামগ্রীর জন্য কয়েকজন তাদের নাম আগে লিখতে বলেন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তারা হতাশ। তারা কয়েকজন বলেন, ''ভাবছিলাম দীর্ঘদিন পর ত্রাণ সামগ্রী পাওয়া যাবে। কিন্তু তা আর হলো না।''
তাদের মধ্যে তন্নী আক্তার বলেন, লকডাউনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া মওকুফ থাকলেও বাকি খরচগুলো করতে হয় প্রতিনিয়ত। আয় না থাকলেও ব্যয় ঠিকই হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল দেওয়া হলেও চালের সঙ্গে তরকারি, তেলসহ আরও অনেক কিছুই লাগে। এ ছাড়াও নিজের জন্য ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হচ্ছে। নিজের হাতে যা ছিলো সেগুলো আড়াই মাস আগেই খরচ হয়েছে। তারপরও বাড়ি থেকে টাকা এনে চলতে হচ্ছে।
আরেক যৌনকর্মী মৌসুমী আক্তার বলেন, দেড় বছরের মেয়ে নিয়ে প্রায় চার মাস ধরে খুব কষ্টে চলতে হচ্ছে। টাকা না থাকায় মেয়ের জন্য দুধও কিনতে পারিনি। অন্যের বাড়ি থেকে ভাতের মার চেয়ে এনে মেয়েকে খাওয়াতে হয়েছে। নিজেকেও মাঝে মাঝে দুএকদিন করে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। আমি আগে গ্যাসের চুলায় রান্না করতাম। গ্যাস কেনার টাকা না থাকায় এখন গাছের পাতা কুড়িয়ে রান্না করছি।
বিউটি আক্তার নামে আরেক যৌনকর্মী বলেন, ছয় বছর ধরে এই পল্লীতে আমার বসবাস। খাবার ও টাকার জন্য কোনো দিন কারো কাছে হাত পাততে হয়নি। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে প্রায় চারমাস ধরে খুব কষ্টে চলতে হচ্ছে।
''আগে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় করতাম। বাড়ি ভাড়াসহ যাবতীয় খরচ শেষে মাস শেষে কিছু টাকা জমাতে পারতাম। এখন আর আগের মতো আয় না হলেও খরচ ঠিকই হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার টাকা ঋণ করেছি'' যোগ করেন তিনি।
ওই পল্লীর আরেক বাসিন্দা শিখা আক্তার বলেন, লকডাউনে কাস্টমার না থাকায় স্বচ্ছল অন্য যৌন কর্মীর বাসায় কাজ করে তাদের সহযোগিতায় চলতে হচ্ছে। আমি সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার দাবি করছি।
''টাকার জন্য আড়াই বছরের মেয়েকে জামা কাপড় কিনে দিতে পারি না এর চেয়ে আর কি কষ্ট হতে পারে। নিজে না খেয়ে থাকলেও ছোট্ট মেয়েকে তো আর অনাহারে রাখা যায় না। অন্যের সহযোগিতা নিয়ে মেয়েকে খাওয়াতে হচ্ছে'', বললেন ওই পল্লীর আরেক যৌনকর্মী বিলকিস আক্তার।
নারী মুক্তি সংঘের সভাপতি আকলিমা আক্তার লাখি বলেন, করোনাভাইরাসের শুরু থেকে এই পল্লীর সদস্যরা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে। অন্যের সহযোগিতা নিয়ে চলতে হচ্ছে অনেককে। আবার কেউ কেউ বাসায় কাজ করে খুব কষ্টে দিন পার করছে। অতি জরুরিভিত্তিতে সহযোগিতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আজাদ বলেন, মানবিক কারণে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যৌন কর্মীদের চাল ও নগদ অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে। দূর্যোগকালীন পুরো সময় তাদেরকে সহায়তা অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক আতাউল গণি বলেন, যৌন কর্মীদের সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এরই মধ্যে পতিতা পল্লীসহ টাঙ্গাইল পৌরসভার হত দরিদ্রদের জন্য পৌরসভাকে ১০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।