গবেষণায় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে যোজন ব্যবধানে পিছিয়ে বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষনা পত্র প্রকাশের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। গত বছর ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরযুক্ত জার্নালে বাংলাদেশি গবেষকদের আট হাজারের বেশি গবেষণা প্রকাশের পর বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়।
স্কোপাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে সায়েন্টিফিক বাংলাদেশ নামের অনলাইন সাময়িকী তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। স্কোপাস বৈজ্ঞানিক জার্নাল, বই এবং কনফারেন্স সম্পর্কিত সাইটেশনের তথ্য নিয়ে কাজ করে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে বাংলাদেশি গবেষকেরা ২০২০ সালে ১৬০টি পিয়ার-রিভিউড এবং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরযুক্ত জার্নালে মোট ৮ হাজার ১৪০ টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৩৬৩। অন্যদিকে, ২০১৮ সালে গবেষকেরা ৫ হাজার ২৩৪টি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
বিগত তিন বছরে গবেষণা পত্র প্রকাশের সংখ্যা বাড়লেও ভারত ও পাকিস্তানের থেকে এখনও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশি গবেষকেরা। ২০২০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের গবেষকেরা যথাক্রমে এক লাখ ৯৯ হাজার এবং ২৮ হাজারের বেশি গবেষনা নথি প্রকাশ করেছে।
গবেষণা প্রবন্ধ ছাড়াও কনফারেন্স পেপার, রিভিউ, বইয়ের অধ্যায়, পত্র, ত্রুটি, নোট, সম্পাদকীয়, ডেটা পেপার, বই, ছোট জরিপ ইত্যাদি নথিও বিবেচনায় আনা হয়েছে। ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর দ্বারা মূলত কোনো জার্নালের মান যাচাই করা হয়। বিগত বছরগুলোতে জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে সাইটেশনের গড় সংখ্যার ভিত্তিতে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নির্ধারিত হয়। একে জার্নাল ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরও বলা হয়। যেমন, কোনো জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর যদি তিন হয়; এর অর্থ সে বছর জার্নালের আর্টিকেলগুলো গড়ে তিনবার রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
বাংলাদেশি গবেষকেরা যে আটটি জার্নালে সবথেকে বেশি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে তা হলো- প্লাস ওয়ান, সায়েন্টিফিক রিপোর্টস, হেলিভন, আইইইই অ্যাকসেস, বিএমজে ওপেন, রেজাল্টস ইন ফিজিক্স, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এবং পলিউশন রিসার্চ। এরমধ্যে চারটি জার্নাল বাংলাদেশি।
রিসার্চিফাই নামের তথ্য পোর্টালের সূত্র অনুসারে, বাংলাদেশ জার্নাল অব বোটানির ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ০.১৫। অন্যদিকে, বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বুলেটিন, বাংলাদেশ জার্নাল অব মেডিকেল সায়েন্স এবং জার্নাল অব মেডিসিন বাংলাদেশের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর যথাক্রমে ০.০৯, ০.১৭ এবং ০.১০।
বাংলাদেশের অবস্থান
স্কোপাসের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের শীর্ষ তিনটি ক্ষেত্র হল, মেডিসিন (২,১৭৩), ইঞ্জিনিয়ারিং (১,৮২৪) এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান (১৫৮১)। তবে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত গবেষণা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর মেডিসিন সংক্রান্ত নথিপত্র ইঞ্জিনিয়ারিং কে ছাড়িয়ে গেছে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৭৬০ টি প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে শীর্ষ অবস্থানে আছে। আগের বছরের তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবার ১০০টি বেশি গবেষণা প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ৫১০ টি প্রকাশনার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। গত বছরের তুলনায় তাদের প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা কমেছে ১০০টি। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বুয়েট শীর্ষ অবস্থানে ছিল।
৪৫৬টি প্রকাশিত প্রবন্ধ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় অবস্থানে আছে। গত বছরের থেকে এক ধাপ এগিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। অন্যদিকে, ৪৩৭টি প্রবন্ধ প্রকাশ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবার পঞ্চম থেকে চতুর্থ অবস্থানে এসেছে।
৪১৮টি নথিপত্র প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষনা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিসিডিডিয়ার, বি) এবার পঞ্চম অবস্থানে আছে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় অবস্থানে ছিল। এছাড়া তালিকায় অন্যান্য শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ড্যাফোডিল
ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়।
সায়েন্টিফিক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী সম্পাদক ড. মনির উদ্দিন আহমেদ বলেন, "ধীরে ধীরে প্রকাশনার সংখ্যা বাড়তে থাকলেও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য তা যথেষ্ট নয়। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় আমাদের প্রকাশনার সংখ্যা খুবই কম। ভারত যেখানে গত বছর ২৭৬টি পেটেন্ট পেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের নামে এসেছে মাত্র একটি পেটেন্ট।"
"এছাড়াও অধিকাংশ গবেষণাই প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের। গবেষণা ফান্ডও মূলত দেশের বাইরে থেকেই আসে। এর অর্থ হল আমাদের নিজস্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট প্রবন্ধ প্রকাশ করছে না। ফলে দিন দিন বাংলাদেশিরা গবেষণার স্বার্থে দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে।"
পেটেন্টসহ শীর্ষ বাংলাদেশি গবেষকবৃন্দ
স্কোপাসের তথ্যানুসারে গতবছর ৬৫ টি প্রবন্ধ প্রকাশ করে গবেষকদের মাঝে শীর্ষে আছেন আইসিডিডিআর,বি'র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ। তিনি গত তিন দশক ধরে নিরলসভাবে শিশুদের অপুষ্টি ও যক্ষ্মা এবং উদরাময় রোগের ব্যবস্থাপনা সহজ করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন।
ড. তাহমিদ আহমেদ এবং তার দল যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি গরডনের সাথে মিলিতভাবে তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের অন্ত্রে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধি বিষয়ে কাজ করেছেন।
এই কাজের মাধ্যমে মাইক্রোবায়োটা ডিরেক্টেড কমপ্লিমেন্টারি ফুড(এমডিসিএফ) নামে পুষ্টিহীনতার শিকার শিশুদের জন্য শিশুখাদ্যের যুগান্তকারী উদ্ভাবন করেন তিনি। বিশ্ববিখ্যাত সাময়িকী 'সায়েন্স' গবেষণাটিকে ২০১৯ সালের সেরা বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের খেতাব দেয়।
ড. তাহমিদ বলেন, "শিশুদের অপুষ্টিহীনতার বিরুদ্ধে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসবে এই উদ্ভাবন। ২০২০ সালে 'ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি'র কাছ থেকে আমরা এর পেটেন্ট পেয়েছি।"
অন্যদিকে বিদ্যমান তথ্যানুসারে, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষক কাউসার আহমেদ এবং ফার্মাকন নিউরো সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীন যৌথভাবে ৫৫ টি প্রবন্ধ প্রকাশনার মাধ্যমে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন।