ঠিকমতো খেতে না পাওয়া ছেলেটি আজ জজ
অভাবের সংসারের ঘানি টানতে রাজধানীতে গত আট বছর ধরে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেছেন সাতক্ষীরা দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের মোশারফ হোসেন। তার স্ত্রী মাহফুজা খাতুনও কাজ করতেন অন্যের বাড়িতে। দু’জনেরই সংকল্প ছিল, ছেলেকে মানুষ করবেন। কিন্তু স্বল্প আয় দিয়ে কীভাবে ছেলেকে মানুষ করবেন এই চিন্তায় ঘুম আসতো না তাদের।
তবে মোশারফ হোসেনের ভাগ্য এখন বদলেছে। তাকে এখন আর গার্ডের কাজ করতে হয় না। স্ত্রীও ছেড়েছেন পরের বাড়ির কাজ। তার ছেলে গোলাম রসুল সুইট এখন মানুষের মতো মানুষ হয়েছেন। সিকিউরিটি গার্ড মোশারফ হোসেনের ছেলে আজ জজ। ১২তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে ৬৭তম হয়েছেন গোলাম রসুল সুইট। গত ১৯ জানুয়ারি ঘোষিত গেজেটে তার নাম এসেছে। আগামী মঙ্গলবার তিনি সহকারী জজ হিসেবে পিরোজপুরে যোগদান করবেন।
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের কোমরপুর গ্রামের মোশারফ হোসেন ও মাহফুজা খাতুন দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে গোলাম রসুল সুইট। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় নিজের পরিবার ও লেখাপড়া নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
তার জীবন সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুইট বলেন, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতো তাদের। দেবহাটার শাখরা কোমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের গণ্ডি পেড়িয়ে ভর্তি হন স্থানীয় দাখিল মাদরাসায়। সেখান থেকে এসএসসি সমমানের পরীক্ষায় ২০০৭ সালে জিপিএ ৫ পেয়ে ভর্তি হন সখিপুর খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ্ কলেজে। ২০০৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ৪.১০ পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। এরপরই অভাবের কারণে তার লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমির এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে উচ্চ মাধ্যমিকের পর সুইট সিদ্ধান্ত নেন রাজধানীতে গিয়ে কোচিং করবেন। কিন্তু অভাবের সংসারে দু’বেলা খাবার যোগানোই যেখানে কষ্টের সেখানে কোচিং করবেন কিভাবে? পরে মায়ের একটি গরু ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে ২০১০ সালের ১৭ মে রাজধানীর একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন তিনি।
গোলাম রসুল সুইট বলেন, কিছুদিনের মধ্যে গরু বিক্রির টাকা ফুরিয়ে যায়। বাড়ি থেকে টাকা আনার কোনো সুযোগও ছিল না। পরে কোচিং পরিচালকের দয়ায় সেখানে বিনামূল্যে থাকা ও কোচিংয়ের সুযোগ পান। বন্ধুদের কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে সুইট বলেন, সহপাঠী বন্ধুরা আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতো। তাদের সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই এতদূর আসা সম্ভব ছিল না।
২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার গল্প শুনিয়ে সুইট বলেন, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ হয়। বন্ধু ও শোভাকাক্সক্ষীদের পরামর্শে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হই। ভর্তির পর নিজে হাতে পোস্টার ছাপিয়ে অভিভাবকদের কাছে বিতরণ শুরু করি। এভাবে পাঁচটি টিউশনি জোগাড় হয়ে যায়। এভাবেই চলেছে আমার শিক্ষাজীবন। আত্মীয়-স্বজনরা কখনো খোঁজ নেয়নি তবে আমার বন্ধুরা আমার পাশে থেকেছে সবসময়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ফলাফলে ‘বি’ ইউনিটে মেধা তালিকায় হয়েছি ১১ তম। ১২তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে হয়েছি ৬৭তম। এতে ১০০ জন উত্তীর্ণ হয়। এর মধ্যে নিয়োগ হয়েছে ৯৭ জনের। তিনজন পুলিশ ভেরিফিকেশনে বাদ পড়েছেন।
আগামী ২৮ জানুয়ারি পিরোজপুর জেলার সহকারী জজ হিসেবে যোগদান করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার বড়লোক হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। সব সময় ন্যায়ের পথে থেকে মানুষদের জন্য কাজ করে যাবো। কখনোই অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করব না। যখন চাকরিজীবন শেষ করবো তখন যেন অবৈধ উপায়ে উপার্জনের একটি টাকাও আমার ব্যাংক একাউন্টে না থাকে। আমার কাছে সকল মানুষ ন্যায় বিচার পাবে। অসহায় মানুষরা কখনোই ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না।’’
গরীব ও অভাবী মেধাবী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে গোলাম রসুল সুইট বলেন, টাকা পয়সা লেখাপড়ার পথে কোনো বাঁধা নয়। ইচ্ছাশক্তি থাকলে সে এগিয়ে যাবেই, পথ বেরিয়ে যাবেই। দুস্থ পরিবারের সমস্যাগুলো আমি বুঝি, নিজে দেখেছি।
সহকারী জজ গোলাম রসুল সুইটের বাবা মোশারফ হোসেন জানান, রাজধানীর উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে আট বছর সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেছি। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুইজনই থাকতাম। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করতো। এক মাস আগে ছেলে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলেছে। তাই চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে এসেছি। ছেলে বলেছে, আমি এখন চাকুরি পেয়েছি আপনার কাজ করতে হবে না। ভাবছি এলাকায় ছোট একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা করবো।
অন্যের বাড়িতে কাজের বুয়া থাকাকালীন সময়ের কথা মনে করে কেঁদে উঠেন মা মাহফুজা খাতুন। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। স্বামী আর আমার টাকা দিয়েই চলতো সংসার আর দুই ছেলের খরচ। আমরা যেটুকু পেরেছি সাধ্যমত চেষ্টা করেছি ছেলের লেখাপড়া করানোর জন্য। দোয়া করেছি। আল্লাহ্ আমাদের ডাক শুনেছেন। দোয়া কবুল করেছেন। আমি অনেক খুশি। এখন সকল মানুষের কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই।
সুইটের প্রতিবেশী কওসার আলী গাজী বলেন, এগারো শতক জমির উপর ভিটেবাড়ি ছাড়া কিছুই নেই তাদের। অভাবের সংসার। রসুলের বাবা ঢাকায় দারোয়ানের কাজ এবং মা বুয়ার কাজ করতেন। এভাবেই চলেছে এতদিন তাদের সংসার। নতুন করে দুই চালা একটা ঘর করেছে। সম্পদ বলতে শুধু এটুকুই তাদের। রসুল এখন জজ হয়েছে প্রতিবেশীসহ এলাকার মানুষ খুশি।
গোলাম রসুল সুইটের বাল্যবন্ধু জাবিরুল ইসলাম বলেন, ছোটবেলা থেকেই শান্ত ও মেধাবী ছিল রসুল। আমরা এক সঙ্গেই লেখাপড়া করতাম। কখনো কারো সঙ্গে জোর গলায় কথা বলেছে, আমাদের জানা নেই।
দেবহাটার পারুলিয়ার ইউনিয়ন পরিষদের স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, খুব অভাবী পরিবার। মা-বাবা খুব কষ্ট করে ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। ছেলেটাও খুব ভালো। জজের চাকুরি পেয়েছে। এতে এলাকার সকল মানুষ খুশি হয়েছে।
সুইটের সফলতার বিষয়ে জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, শুধু অর্থই মানুষকে অনেক কিছু দিতে পারে না। পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই। পরিশ্রম করে আজ সহকারী জজ হয়েছেন গোলাম রসুল সুইট। জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি তার এ সফলতায় আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। তার মা ও বাবার প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।