রাজশাহীর সিল্ক: করোনায় লোকসান কোটি টাকা
মহানগরীর সপুরা এলাকায় প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী সপুরা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজ ১৯৭৯ সাল থেকেই রেশমের তৈরি পোশাক উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। নিজস্ব কারখানায় রেশমের সুতা ও সেই সুতা থেকে পোশাক তৈরি করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
দেশে সরকারিভাবে লকডাউনের ঘোষণার পর, ২৬ মার্চ থেকে তাদের কারখানা ও শো-রুম বন্ধ। সীমিত পরিসরে মার্কেট চালুর ঘোষণার পর থেকেই গত ১২ এপ্রিল থেকে পুরোপুরি সরকারি নিয়মনীতি মেনেই তারা তাদের শোরুম চালু করেছেন।
রাজশাহী সপুরা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক সাজ্জাদ আলী জানান, গত দুই মাস ধরে তাদের কারখানা ও শো-রুম বন্ধ ছিল। সরকারি ঘোষণা ছিল যাদের কারখানা বন্ধ থাকবে তারা তাদের কর্মচারীদের বেতনের ৬০ শতাংশ দিলেও চলবে। তারপরও আমরা আমাদের ৪০০ কর্মচারীদের সবাইকে মার্চ ও এপ্রিল মাসের পুরো মাসের বেতন দিয়েছি। এই মাসের বেতন ও ঈদের বোনাসও দিবো। শোরুম সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করলেও এখনো বন্ধ রয়েছে কারখানা । যতদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হবে ততদিন বন্ধই থাকবে।
তিনি জানান, গত তিনি মাসে আমার তিন কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এই লোকসান তুলতেই আমার এক দেড় বছর লেগে যাবে। এরপর করোনা পরিস্থিতির কখন উন্নতি হবে তার কোনো ঠিক নেই। তারপরও আমরা সরকারি সিদ্ধান্ত মেনেই সব কাজ করবো।'
শোরুমে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেক ক্রেতাকেই শো-রুমের নিচতলায় জীবাণুশাক দিয়ে পুরো শরীর ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে ভেতরে প্রবেশ করানো হচ্ছে। মেঝেতে ব্লিচিং পাউডার মেশানো পাপোশ রেখে দেওয়া হয়েছে। মূল শো-রুমে প্রবেশের সময় আবার শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর ভেতরে তো সামাজিক দূরত্ব পণ্য ক্রয় করতে হচ্ছে মেনেই ।
শোরুমের ম্যানেজার সাইদুর রহমান বললেন, শোরুম খুললেও বেচাবিক্রি খুব কম হচ্ছে। গতবছর ঈদের কয়েকদিন প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার বিক্রি হতো। এখন সেখানে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকার বিক্রি হচ্ছে। বেশি বিক্রি হচ্ছে বাচ্চাদের পোশাক। আর এখানে যারা আসছেন তারা সবাই সচেতন। সামাজিক দূরত্ব মেনেই পণ্য ক্রয় করছেন।
পাশের ভবনে রয়েছে রাজশাহী ঊষা সিল্কের শোরুম। সেখানেও একই চিত্র। মূল ফটকে জীবাণুনাশক স্প্রে দিয়ে জীবাণুনাশক করে তাপমাত্রা মেপে তারপর ঢুকতে হচ্ছে শো-রুমে। তবে বেচাবিক্রি কম। সেখানকার বিক্রেতারাও জানালেন বেচাবিক্রি কম হচ্ছে।
ঊষা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম বলেন, পহেলা বৈশাখ ও দুই ঈদকে কেন্দ্র করেই আমাদের বেচাবিক্রি বেশি হয়। করোনা ভাইরাসের কারণে পহেলা বৈশাখে তো বিক্রিই করতে পারিনি। তখন কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর ঈদের প্রতিদিন যেখানে কয়েক লাখ টাকার বিক্রি হতো সেখানে ৫০ হাজার টাকাই পুরছে না। আর কারখানা তো বন্ধই রয়েছে। তারপরও মালিক আমাদের সবাইকে বেতন দিচ্ছেন। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে কতদিন লাগবে তার কোনো ঠিক নেই।
রাজশাহীর সিল্কের অন্য শোরুমগুলোর চিত্রই এমনই। লোকসানে পড়ছে সব পোশাকখাতের শো-রুম।
প্রায় সব শোরুমগুলোর মালিকরা জানালেন, এই করোনা ভাইরাসে তাদের কোটি কোটি টাকা লোকসানে পড়েছেন।
এক সময় রাজশাহীর সিল্কের তৈরি পোশাকের চাহিদা ছিলো আকাশচুম্বী। এখনও ঐতিহ্য বজায় থাকলেও রাজশাহীর রেশম শিল্পখাত ধ্বংসের পথে। কয়েকটা উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠান লোকসান গুণেই ধ্বংসপ্রায় এ শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন কোনোরকমে। করোনা ভাইরাসের লকডাউনের কারণে আবারও কোটি কোটি টাকা লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে এ শিল্পখাত।
করোনাভাইরাসের লকডাউনে সারাদেশে রেশম শিল্পের ক্ষতি প্রায় ২০০ কোটি টাকা। তাই এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি প্রণোদনাসহ রেশম শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানালেন- বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো. লিয়াকত আলী।
তিনি বলেন, এমনিতে তো রেশম শিল্প ধ্বংসের পথে। তারপরও কোনোরকমে চলছিল এ খাত। করোনাভাইরাস এসে এ খাত ব্যাপক লোকসানে পড়েছে। সারা বাংলাদেশে রেশম শিল্পের ক্ষতি ২০০ কোটি টাকার মতো।
তিনি বলেন, রেশম শিল্পের দুইটি অংশ। একটি গুটি থেকে সুতা উৎপাদন, আরেকটি হচ্ছে বস্ত্রখাত। বস্ত্রখাতের মাধ্যমে পোশাক তৈরি করা হয়। যারা পোশাক তৈরি করে তাদেরও বেচাবিক্রি বন্ধ। শুধু তাই নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় আড়াইশো তাঁতের সঙ্গে যুক্ত ১০ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাঁত বন্ধ থাকায় তারা বেতনও পাননি।
তিনি বলেন, এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি প্রণোদনা প্রয়োজন। এজন্য রেশম উন্নয়ন বোর্ডকে এগিয়ে আসতে হবে।