সরিষাক্ষেতে মধু চাষ, লাভবান উভয় চাষিই
টাঙ্গাইল জেলার প্রতিটি উপজেলার কৃষি জমিগুলোতে এখন শুধুই সরিষা ফুলের সমারোহ। দিগন্তজুড়ে শুধুই সরিষা ফুল। আর এসব জমির পাশেই মৌচাষের বাক্স বসিয়েছেন মৌচাষিরা। এতে একদিকে মৌমাছির মাধ্যমে সরিষা ফুলের পরাগায়নের সহায়তায় সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে মৌচাষিরা পর্যাপ্ত পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে পারছেন। ফলে সমন্বিত এই চাষে লাভবান হচ্ছেন সরিষা ও মৌচাষি উভয়ই। জেলায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এ পদ্ধতিতে সমন্বিত চাষ।
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ৩০ হাজার টন সরিষা; মধু সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় ৩৫ টন। ২০১৮ সালে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল সরিষা; উৎপাদন হয়েছিল ৬০ হাজার টন সরিষা; মধু সংগ্রহ হয়েছিল ৫০ টন। চলতি বছর জেলার ১২টি উপজেলার ৪১ হাজার ৫০৭ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৫ হাজার টন। আর মৌ বাক্স স্থাপন করা হয়েছে প্রায় তিন হাজার। যা অন্যান্য বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এবার একশ’ টন মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, এ অঞ্চলের কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় উভয় জাতের সরিষা চাষ করেন। দুই জাতের সরিষা নভেম্বরের শুরু থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাত ভেদে ৭০ থেকে ৯০ দিন। বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের সমারোহ।
‘সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ বাক্স স্থাপন করলে সরিষার ক্ষতি হয়’ এক সময় কৃষকদের মধ্যে এমন ভ্রান্ত ধারণা ছিল। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করেছে। কৃষকরা এখন জানেন যে, সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ বাক্স স্থাপন করলে সরিষা উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই টাঙ্গাইলের সরিষা চাষিরা বর্তমানে মৌচাষিদের বাক্স স্থাপনের জন্য সহযোগিতা করছেন।
দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন এলাকায় মৌ বাক্স স্থাপনকারী রাজা মিয়া জানান, তিনি গত বছর ৫০টি বাক্স দিয়ে মৌচাষ শুরু করেছিলেন। গত বছর সব খরচ বাদ দিয়ে তার দেড় লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। এ বছর তিনি ১০০টি বাক্স স্থাপন করেছেন। আশা করছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর তিনি বেশি লাভবান হবেন।
দেলদুয়ার উপজেলার কৃষক আজাহার মিয়া জানান, মৌ বাক্স স্থাপনের আগে প্রতিবিঘায় বারি-১৪ জাতের সরিষার উৎপাদন ছিল সাত থেকে আট টন। মৌ বাক্স স্থাপনের পর প্রতি বিঘায় সরিষা উৎপাদন এক থেকে দেড় টন বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে, দেলদুয়ার উজেলার কৃষক রফিক মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘কৃষি অফিস যদি আমাদের মৌ চাষের প্রশিক্ষণ দিতো তাহলে আমরা সরিষার সঙ্গে মৌ চাষ করে অনেক বেশি লাভবান হতাম।’’
বাসাইল উপজেলার বাসুলিয়া এলাকায় মৌ বাক্স স্থাপনকারী আনোয়ার হোসেন জানান, ৫ বছর আগে তিনি টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প নগরী থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৫০টি বাক্স দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে তার ২৫০টি বাক্স রয়েছে। গত বছর তার আয় হয়েছিলো প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। এ বছরও তিনি তেমনি আশা করছেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকে টাঙ্গাইল অঞ্চলে সরিষার মধু সংগ্রহে ১৫ থেকে ২০ জন মৌচাষি এসেছেন। তাদের সকলেই স্থানীয় সরিষা চাষিরা সহযোগিতা করছেন। মধু সংগ্রহকারীদের আশা, এই মধু তারা ঢাকার বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করতে পারবেন। আগে মধু কম সংগ্রহ করা গেলেও বর্তমানে প্রতি বাক্স থেকে সপ্তাহে ৪-৫ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। তবে অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে মধু সংগ্রহ সবচেয়ে বেশি হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবদুল রাজ্জাক জানান, মৌমাছি সরিষার ফুলে উড়ে উড়ে বসে মধু সংগ্রহ করে। এতে সরিষা ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। তাই সরিষাক্ষেতের পাশে মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করলে সরিষার ফলন প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এতে একদিকে মৌচাষিরা যেমন মধু আহরণ করে লাভবান হতে পারেন, অন্যদিকে সরিষা চাষিরাও লাভবান হতে পারছেন।
টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প নগরীর সহকারী মহা ব্যবস্থাপক শাহনাজ বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্র্ডকে জানান, বিসিক শিল্প নগরীতে নিয়মিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌচাষের প্রশিক্ষণ দিয়ে আগ্রহীদের ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থাও করা হয়।