সৌদিগামী শ্রমিকদের ভিসা পেতে দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত ২২০ ডলার
সৌদিগামী বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিবাসন খরচ অন্তত ২০ হাজার টাকা বেড়েছে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ঢাকাস্থ দূতাবাস থেকে ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে 'অনাকাঙ্ক্ষিত খরচে'র কথা বলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে তাদের থেকে।
বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্টদের অভিযোগ, প্রতিটি ওয়ার্ক ভিসার আবেদনের জন্য 'অনানুষ্ঠানিকভাবে' মধ্যসত্বভোগীদের মাধ্যমে দূতাবাসকে ২২০-২৫০ ডলার দিতে হয়, অন্যথায় দূতাবাস ভিসা দেয় না।
তবে, সৌদি দূতাবাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করতে কোনো ফি বা চার্জ দিতে হয় না।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো আরও দাবি করেছে, এক বছর ধরে এভাবে গোপন অর্থ লেনদেন চলছে।
তারা বলছে, ওয়ার্ক ভিসা পেতে হলে দালালদের মার্কিন ডলারে সরাসরি এ অর্থ দিতে হয় এজেন্সিগুলোকে। দিনশেষে, এ অতিরিক্ত অর্থের ভার চাপে শ্রমিকদের ওপর। এর আগেই আনুষ্ঠানিক রেটের চেয়ে বেশি খরচ পড়তো, তা আরও বেড়েছে এর ফলে।
সৌদি আরবে যেতে সরকার-নির্ধারিত অভিবাসন খরচ ১.৬৫ লাখ টাকা, তবে সৌদিগামী শ্রমিকদের খরচ করতে হয় ৩.৫ থেকে ৪ লাখ টাকা।
'ভিসা বাণিজ্যে' নতুন সংযোজন
'ভিসা বাণিজ্য'- নিয়োগদাতাদের থেকে মধ্যসত্বভোগীদের মাধ্যমে চাহিদাপত্র নেওয়া ও রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে বিক্রি করা বাংলাদেশে বেআইনি।
কিন্তু, এ দৃশ্য বদলায়নি। এ কারণে বিদেশে কাজ করতে যেতে চাইলে শ্রমিকরা মোটা অংকের অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হয়।
বিদ্যমান অন্যান্য অবৈধ চুক্তির মধ্যে ভিসার আবেদনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ প্রদান নতুন সংযোজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রিক্রুটিং এজেন্ট টিবিএস-কে বলেন, "আমার এজেন্সি গত মে মাস পর্যন্ত ৬ মাসে যত পাসপোর্ট জমা দিয়েছে, কারো ভিসা দেয়নি সৌদি দূতাবাস"।
"আর কোনো উপায় না থাকায় আমি প্রতি পাসপোর্টের বিপরীতে ২২০ ডলার করে দেই দালালদের। এরপর, গত তিন মাসে আমার এজেন্সির জমা দেওয়া ২০০ পাসপোর্টের ভিসা দিয়েছে দূতাবাস"।
এসব দালাল কারা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা সৌদি দূতাবাসের স্টাফ সদস্য না। "কিন্তু, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দূতাবাসের ভেতর এসব দালালদের পরিচিত মানুষ আছে। বিশেষ করে, সেখানকার কিছু বাঙালি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ আছে তাদের"।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) তথ্য অনুসারে, বর্তমানে নিবন্ধিত ১৫০০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে প্রায় ৭০০টি সৌদি দূতাবাসে তালিকাভুক্ত এবং দেশটিতে শ্রমিক পাঠাতে পারে।
একটি এজেন্সিকে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৩০টি পাসপোর্ট সৌদি দূতাবাসে জমা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তবে নারী শ্রমিকদের পাসপোর্টের সংখ্যার কোনও নির্ধারিত সীমা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বায়রা'র এক সাবেক নেতা বলেন, "কোনো এজেন্সির যদি মাসে শ্রমিক পাঠানোর ৪০০টি চাহিদা পত্র থাকে, বৈধভাবে সর্বোচ্চ ১২০টি পাসপোর্ট পাঠাতে পারবে দূতাবাসে। কখনো কখনো কোনো কারণ উল্লেখ না করেই অনেক পাসপোর্ট ফেরত দেয় কর্তৃপক্ষ"।
"কিন্তু, একবারে ১০০টির বেশি পাসপোর্ট জমা পড়ছে এবং গোপনে ভিসা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে ডলারে অর্থ দিতে (ভিসা পেতে) বাধ্য করা হচ্ছে"।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, "দালালদের মাধ্যমে টাকা দেওয়া ভিসা বাণিজ্যের নতুন সংযোজন। সৌদি দূতাবাসের এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ"।
সৌদি দূতাবাস কী বলছে
এ অভিযোগ সম্পর্ক জানতে সৌদি দূতাবাসকে ই-মেইল পাঠিয়েছিল টিবিএস।
ই-মেইলের উত্তরে ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দাহিলানের উদ্ধৃতি দিয়ে দূতাবাস বলেছে, "সৌদি দূতাবাস আশ্বস্ত করতে চায়, দূতাবাসে ভিসার আবেদন করতে কোনো ফি বা চার্জ দিতে হয় না। তবে, এনজাজ ভিসার ক্ষেত্রে নামমাত্র ফি দিতে হয়, এই অর্থ আবার অনলাইনে লেনদেন হয়, নগদে না"।
"অনেক ভিসার দালাল, মধ্যসত্বভোগী ও এজেন্টরা দূতাবাসের নাম ভাঙ্গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিতে পারে। সৌদি দূতাবাসের সঙ্গে সরাসরি লেনদেনের কোনো উপায়ই নেই"।
এদিকে, চলতি বছরের ২২ জুন দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সৌদি রাষ্ট্রদূত বলেন, চলতি বছর এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ ভিসা দিয়েছে, এর সবকটিই ছিল ওয়ার্ক ভিসা।
"বিজনেস ও টুরিস্ট ভিসাও দিচ্ছি আমরা", বলেন তিনি।
"ভিসা আবেদনের এ চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। প্রতিদিন ৮,০০০-১০,০০০ ভিসা দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে দৈনিক ভিসা দেওয়ার হার বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে"।
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ১২,৩০০ ভিসা দেয় দূতাবাস- একদিনে ভিসা দেওয়ার সর্বোচ্চ সংখ্যা এটি।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, এ বছরের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের ৬৩ শতাংশই হয়েছে সৌদি আরবে।
২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে সৌদিতে কর্মসংস্থান হয় প্রায় ৩.৮৫ লাখ বাংলাদেশির, অন্যদিকে মোট বৈদেশিক কর্মসংস্থান ছিল প্রায় ৬.১৪ লাখ।
সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশিরা এই সময়ে প্রায় ৮,৯৫৫ মিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ২৩ লাখ বাংলাদেশি দেশটির বিভিন্ন খাতে কর্মরত আছে।
২০১৯ সালে 'ভিসা বাণিজ্য' বন্ধে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। কিন্তু এ অবৈধ চর্চা বন্ধে এখন পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ওয়ার্ক ভিসার ফি হিসেবে নেওয়া অবৈধ লেনদেনের ২.১ বিলিয়ন ডলার পাচার হয় সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ায়।
যেখানে ভিসার আবেদনে কোনো ফি দেওয়ার নিয়ম নেই, সেখানে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই অবৈধভাবে টাকার বিনিময়ে ভিসার আবেদন করতে হয়।